Advertisement
E-Paper

সমকালীন ছবি  ও গড়পড়তা  মানুষের কথা

ছবির বিষয় গড়পড়তা রোজকার জীবন হলেও, ছবির ভাষা ও গল্প বলার ধরনে ভারতীয় দরবারী অণুচিত্রের প্রভাব গভীর।

শর্মিষ্ঠা বসু

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২২ ০৮:২৪
প্রতিচ্ছবি: ‘বিটুইন দ্য সেল্ফ অ্যান্ড দ্য সিলুয়েটস’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

প্রতিচ্ছবি: ‘বিটুইন দ্য সেল্ফ অ্যান্ড দ্য সিলুয়েটস’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

পড়ন্ত দুপুর। রাস্তার ফেরিওয়ালার ডাকে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন পাড়ার মানুষজন। ঈষৎ আলস্য ও কৌতূহল তাঁদের ভঙ্গিমায়। কেউ সবেমাত্র স্নান সেরে ভিজে চুলে গামছা জড়াচ্ছেন, কারও হাতে চায়ের কাপ, কেউ বা তোশক-বালিশ রোদে দিতে ব্যস্ত। এ সবের মাঝখানে ফেরিওয়ালা স্ত্রী ও পুরুষ দু’দিক দিয়ে মেলে ধরেছে ফুল-পাতার নকশা সেলাই করা বড় একটি চাদর। মফস্‌সলের ইট-পাথরের ভিতরে সুদৃশ্য নকশাদার চাদরটি যেন এক টুকরো বাগানের আরাম।

এমনই এক দুপুরের ছবি এঁকেছেন শিল্পী সোমা দাস। ছবির নাম ‘দুপুরের ফেরিওয়ালা’। উপন্যাসোপম ছবিটিতে চরিত্র অনেক এবং প্রত্যেকেই আপন আপন প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র। তাদের পোশাক ও দেহভঙ্গিমায় আটপৌরে জীবনযাত্রার ছাপ স্পষ্ট। শহর ও শহরতলির দৈনন্দিন জীবনের অনেক ছবি দেখা গেল কলকাতার ইমামি আর্ট গ্যালারিতে সোমা দাস ও অঞ্জন মোদকের যুগ্ম প্রদর্শনী ‘বিটুইন দ্য সেল্ফ অ্যান্ড দ্য সিলুয়েটস’-এ।

এই ছবিটিতে যেমন, তেমনই ইমামি আর্টের প্রদর্শনীতে রাখা সোমা দাসের অন্য ছবিতেও বিষয় হিসেবে বারবার উঠে এসেছে অতি সাধারণ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা টুকরো গল্প। ছবির বিষয় গড়পড়তা রোজকার জীবন হলেও, ছবির ভাষা ও গল্প বলার ধরনে ভারতীয় দরবারী অণুচিত্রের প্রভাব গভীর। ছাত্রজীবনে একসময়ে তিনি মোগল ও পাহাড়ি অণুচিত্র অনুধাবন করেছিলেন। বহু পরিপ্রেক্ষিত, বর্ণনার পুঙ্খানুপুঙ্খতা, সরু তুলির কাজ, নকশার কারুকার্য ও উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার তাঁর ছবিকে দর্শকের কাছে এনে দেয়।

ছবিতে দেখা যায় প্যাটার্ন ও টেক্সচারের প্রতি শিল্পীর বিশেষ আকর্ষণ। পটভূমি নির্মাণে কখনও ব্যবহার করেছেন নকশাদার কাপড়ের টুকরো বা ফুলছাপ কাগজ। ছাপা সুতির কাপড় ও গামছার সরাসরি ব্যবহার ছবিতে নিয়ে আসে এক বিশেষ আর্থসামাজিক অনুষঙ্গ।

এক-একটি ছবি যেন এক-একটি কাহিনি। এ সব কাহিনিতে মহিলারাই প্রধান চরিত্র। অবান্তর লাস্যভারে ক্লান্ত নয়, বরং প্রাত্যহিক দিনযাপনে অতি স্বাভাবিক তাঁদের উপস্থিতি। এই পরিণত শিল্পবোধের পরিচয় পাই ‘প্রাইভেসি’ নামক ছবিতে। কোভিড লকডাউনের সময়ে যখন পরিবারের কেউই ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না, ইট দিয়ে উঁচু করে তোলা কাঠের চৌকির নীচে মুড়ি, কেরোসিন পাত্রের পাশে কোনওমতে পোশাক পাল্টানোর জন্য অল্প একটু জায়গা করে নিয়েছে এক কিশোরী। থাক করে রাখা তোশক-বালিশের স্তূপ, বাসি জামাকাপড়, ফোনের চার্জার পড়ে থাকে খাটের উপরে। অভাব-অনটনের এমন বর্ণিল চিত্রায়ন করুণা বা সমবেদনার উদ্রেক করে না, বরং আমাদের এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি এনে দেয়।

নিজেকে ও অপরকে কী ভাবে দেখেন একজন শিল্পী? সমাজের নানা স্তরের মানুষকে চেনার অভিজ্ঞতা কি বদলে দেয় নিজেকে জানার গতিপথ? এমনই কিছু প্রশ্নকে ছুঁয়ে রয়েছে এই যৌথ প্রদর্শনীর ছবিগুলি।

সাধারণ মানুষের ছবি এঁকে চলা দুই শিল্পীর কাজে বিষয়গত সান্নিধ্যের পাশাপাশি রয়েছে মাধ্যম নির্বাচন ও ভাষা ব্যবহারের স্বকীয়তা। অঞ্জন মোদকের ছবিতে দেখি শহুরে জীবনের ধূসর বাস্তবতা। সাদা কাগজের পেক্ষাপটে কালি-কলমের নিপুণ ব্যবহারে ফুটে উঠেছে শ্রমিকজীবন ও নগরকেন্দ্রিক সমাজের বিভিন্ন দিক। শ্রমিকের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে অঞ্জন মোদকের ছবিতে। অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্বাভাবিক কারণেই বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।

‘এক্সাইল ইন দ্য সিটি’ ছবিটিতে দেখি অসংখ্য টালির বাড়ির ভিড় এক ঘিঞ্জি বস্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি বাড়ির মধ্যে মানুষ, তাদের ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি এক শ্বাসরোধকারী অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে। সূক্ষ্ম রেখা ও বিন্দুর সমন্বয়ে বস্তির প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে এক পুঞ্জীভূত মেঘের আকার। এই মেঘ অঞ্জন মোদকের নানা ছবিতে নানা প্রসঙ্গে ফিরে আসে— কখনও আশঙ্কা, কখনও হতাশা, কখনও বা বিপর্যয় হিসেবে। এ ক্ষেত্রে ইটের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশালকায় মানুষ, পরিচয়হীন এক অবয়ব, এই ধোঁয়া মেঘের পটভূমিতে সমস্ত বস্তিটিকে দু’হাতে ধারণ করে আছে। অন্য দিকে, একটি নিরাবলম্ব হলুদ চোখ, যা বিচারকের দৃষ্টিতে দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতি পরিমিত রঙের ব্যবহার ম্লান হয়ে আসা প্রাকৃতিক ও মানবিক অস্তিত্বের আভাস দেয়।

অঞ্জন মোদকের ছবিতে মানুষ ও তার বাসস্থানের পাশাপাশি, পশুপাখির চিত্রায়ন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পশু এখানে মানুষেরই বিভিন্ন চরিত্রগুণের রূপক। তাঁর ছবিতে পশু ও মানুষের যে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে, তার অনুপ্রেরণা এসেছে বিশেষত পঞ্চতন্ত্রের গল্পমালা থেকে। যেমন হিংস্রতা ও শক্তির রূপক হিসেবে এসেছে বাঘ, তেমনই গতি ও ভীরুতার রূপক হয়ে এসেছে হরিণ। ‘দ্য গ্রিডি টাইগার’ ছবিতে দেখি, প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বাঘ— কখনও বাক্স, কখনও হাঁড়ি বা বালতিতে ঢাকা তার মুখ। তবু চলনে শৌর্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট।

রেখা ও রূপক প্রাধান্য পেয়েছে অঞ্জন মোদকের ছবিতে। পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কল্পনা ও পরাবাস্তবতা তাঁর রচনার মূল ভিত্তি। শরীর, শ্রম ও সংগ্রাম এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের কোনও কাহিনি নয়, এক সাধারণ বিমূর্ত শ্রেণির প্রতিরূপায়ণ।

প্রদর্শনীতে দুই শিল্পীর ছবি স্বতন্ত্রভাবে প্রদর্শিত। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের ছবি পাশাপাশি রাখায়, একটি সংলাপের আবহ তৈরি হয়েছে। এই যুগ্মপ্রদর্শনীর কিউরেশনের দায়িত্বে শিল্পী ও অধ্যাপক অদীপ দত্ত।

review Paintings
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy