দেশের অন্যান্য রাজ্যে এর আগে একক প্রদর্শনী হলেও এই প্রথম কলকাতায় ‘ওয়ান ম্যান শো’ করলেন শিল্পী অজিত শীল। কিউরেটর মেঘালি গোস্বামীর দায়িত্বে পরিবেশিত হল ‘হুইসপার্স ইন প্রিন্ট, দ্য ভিসুয়াল পোয়েট্রি অব অজিত শীল’। দিনকয়েকের জন্য কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস হয়ে উঠেছিল ছাপাই চিত্রের জাদুঘর।
বিষয় ও পদ্ধতি অনুযায়ী সাজানো ছিল নতুন-পুরনো মিলিয়ে ২১৫টি ছাপাই চিত্র। রিয়্যালিজ়ম অনুসরণ করে আলোছায়ার মাধ্যমে গভীর পথ রচনা করেছেন শিল্পী। দীর্ঘবাহী চর্চায় প্রকাশ পায় তাঁর স্টাডির জোর এবং তৈরি হয় ছাপচিত্রের নতুন মোড়। যদিও অজিত শীলের বক্তব্যে উঠে আসে সমস্যার কথাও। বিভিন্ন কারণে শিল্পীরা এখন ঐতিহ্যবাহী ছাপাখানা হারানোর দ্বারপ্রান্তে আছেন। এর মধ্যে একটি হল লিথোগ্রাফি প্রক্রিয়া, যা শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। এবং কখনও কখনও শিল্পীরা আশানুরূপ ফল পেতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, লিথো পাথর খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল।
প্রিন্টের নিরন্তর সাধনার বিচারে এই মুহূর্তের অন্যতম সেরা প্রিন্টমেকার অজিত শীল। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তাবড় শিক্ষকদের। পরিশ্রম আর চূড়ান্ত আগ্রহে কোনও ফাঁকি ছিল না অজিত শীলের। সেই স্বভাব আজও রয়েছে। তাঁর মগ্নতা এবং আবিষ্কার অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এখনও রেখাপাত করে চলে।
প্রদর্শনীতে ছিল লিথোগ্রাফির প্রচুর প্রিন্ট। এ ছাড়া এচিং, কাঠ-খোদাই, এনামেল পেন্টিং ও প্লেট লিথো। প্লেট লিথোর কাজের বৈশিষ্ট্য, যতগুলি কালার ব্যবহার, তত বার প্রিন্ট নেওয়া। যেমন ১৪টি রঙের ১৪টি প্রিন্টের কাজের নমুনা দেখা গেল। পরপর টোন অনুযায়ী করার পর সাদা-র ব্যবহার। বোঝাই যায়, ড্রয়িংয়ের গুরুত্ব প্রয়োজন। নিসর্গ, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, দেবদেবী, অবতার ইমেজের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় সেই দক্ষতা ফুটে ওঠে। অনেক ছবিতে রেমব্রান্টের মতো নাটকীয় ফোকাস ফেলা। এ ক্ষেত্রে শিল্পী উল্লেখ করেন অগ্রজ শিল্পী সনৎ করের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছিলেন, আমরা যে ছবি তুলি, ছবির মধ্যে ফোকাস করি, সেই ফোকাসটা এখানেও রাখা দরকার। সেই জন্যই কোনও না কোনও জায়গায় সেই পার্টিকুলারটা আছে এই কাজগুলিতেও। অজিত শীলের কিছু পুরনো কাজে গণেশ পাইনের টেম্পারার কাজ মনে পড়ে যায়।
অজিত শীল অসমের সরকারি কলেজ থেকে চিত্রকলায় ডিপ্লোমা করেন ১৯৭৯ সালে। তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভবেশ সান্যাল। তাঁর সুপারিশপত্র নিয়ে দিল্লির গ্রাফিক স্টুডিয়োয় যুক্ত হন অজিত। তখন ছিলেন মনজিৎ বাওয়া, পরমজিৎ সিংহ, অর্পিতা সিংহ, জি কে সন্তোষ, কৃষ্ণ খন্না, গোগি সরোজ পাল প্রমুখ শিল্পী। এই মানের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করা এবং তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ পাওয়ায় শুরু হয় অজিত শীলের প্রিন্টমেকিং-এর নতুন জগৎ। দু’বছর প্রশিক্ষণের পর এই বিষয়েই পোস্ট ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন তিনি শান্তিনিকেতনে।
কলাভবনে সোমনাথ হোর, সনৎ কর, শান্তনু ভট্টাচার্য, এস কে ডেভিডের শিক্ষায় লিথোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাঁর। পিতৃসম সোমনাথ হোরের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা পান। তাঁরই কাছে শেখেন হাতে তৈরি কাগজ, পাল্প, ছাপার কালি বানানোর প্রক্রিয়া। মূলত মুদ্রণযন্ত্রের প্রযুক্তিগত উপাদান ও কলাকৌশল সবটাই শিল্পী অজিত শীল আয়ত্ত করেন। এ ছাড়া ইন্টাগ্লিওর বৈশিষ্ট্য শিখিয়েছিলেন সনৎ কর। সুতরাং শিল্পীর অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ছাপচিত্র শিক্ষালাভের একটি মজবুত আরোহণ। তবে শুধুই শিক্ষা এবং কর্মজীবন দিয়ে কেউ সফল চিত্রকর বলে প্রমাণিত হন না। নতুন নতুন সৃষ্টিতে নিয়ত লেগে থাকার সুফলই শিল্পীর আসল পরিচয়। এর যথার্থ প্রমাণ অজিত শীল।
প্রদর্শনীতে মনে গেঁথে যাওয়ার মতো কাজ ছিল প্রচুর। কর্মসূত্র ও বেড়ে ওঠার সূত্রে অসমের প্রকৃতির ছাপ লক্ষ করা যায় তাঁর কাজে। প্রকৃতির নিভৃত আসরে গড়ে ওঠে একাধিক লিরিক্যাল সম্পর্ক। সেই প্রতিষ্ঠায় তৈরি হয় ফ্যান্টাসির রূপকল্প। সুররিয়্যালিজ়মের টেকনিকে নতুন নতুন ফর্ম, আবেগ বেরিয়ে আসে। জীবনের আনন্দ, বেদনা, শ্রম মিলেমিশে পূর্ণ প্রাপ্তির দৃশ্যায়ন।
২৩ বছর অসমে কর্মরত থাকার পরে ২০০৭-এ তিনি যোগদান করেন কলাভবনে। গ্রাফিক্সের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নেন ২০২৩-এ। ফলত, শান্তিনিকেতনের শিক্ষা, প্রকৃতি-পাঠ তাঁর কাজে সর্পিলরেখায় ঘোরে-ফেরে। সে সবই এক এক করে ছিল দেখার মতো— লিথোর ‘রিদম’, ‘শেলমেট’, ‘জয় অব লভ’, ‘ময়ূরের নৃত্য’ বা ‘ক্যাডেন্স’। বর্ণিল লিথোর ‘সোয়ান লেক’, ‘হারভেস্ট’, ‘কূর্ম অবতার’, ‘কন্ট্যাক্ট’ জুড়ে শুধুই মুগ্ধতার রেশ।
বেশির ভাগ ছবিতেই অরণ্য একটি মুখ্য ভূমিকায়, যার কোলে সরল সভ্যতার বাসভূমি। জীবনের এই গতি ধরা পড়ে খোদাইয়ের কারিকুরি, সূক্ষ্মতা এবং ছন্দের অরণ্যে। যেমন, কাঠখোদাই-এর ‘নেক্টার’, ‘প্যাশন’, ‘ট্রাভেল’, ‘ফিল’ ইত্যাদি। পশু, কীটপতঙ্গ ও মানব-মানবীর ক্রস হ্যাচিং-এর যৌথ গাথা। আবার এনামেল পেন্টিং-এর সাদাকালোর ‘অনামা’, ‘পেয়ার’, ‘গ্লিফুল’। অসাধারণ সব অভিব্যক্তি নিয়ে কাজ করে চলেছেন শিল্পী। যেমন লিথোগ্রাফির ‘আনউইন্ড’-জলরং স্বচ্ছতার পরিপূরক। একই ব্যঞ্জনা নিয়ে ‘শেড’, ‘মিডো’উল্লেখ করার মতো রচনা। এ ছাড়া এচিং-এর ‘কসমস’, ‘বাকেট’ ইন্টাগ্লিওর ‘নিম্ফ’ নিয়ে আসে অচেতন স্তরের অলীক সুখ।
পরাবাস্তবতা ছাড়াও গ্রামবাংলার চিরন্তনী ডিজ়াইন, তাঁর ছাপচিত্রে মোলায়েম আবেশ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন মেটাল, হলদি কাঠ, গামারি কাঠের সরঞ্জামে ভরপুর আয়োজন। আর সে সবের রূপান্তর ছিল দেখার মতো।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)