E-Paper

বাঁধা ছাঁদ যখন ছিন্নভিন্ন

পশ্চিমি আধুনিক ছবি আঁকার জগতে প্রধানত পরীক্ষানিরীক্ষা হয় আঙ্গিক নিয়ে। সম্ভবত এটি আরম্ভই হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৭:০৭
ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি।

ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি।

সিমা গ্যালারিতে চলছে সামার শো, যার নাম ‘শিফ্টিং প্যারাডাইমস’। এই রকম একটি প্রদর্শনী প্রত্যেক বছরই রাখি সরকার আয়োজন করে থাকেন। তবে এ বারের আয়োজনটি বেশ কিছুটা অন্য রকম। এটি একটি দলীয় প্রদর্শনী, যেখানে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে নতুন প্রতিভাকে জায়গা করে দেওয়ার অভিনব প্রয়াস দেখা গেল। শিল্প সম্পর্কিত পুরনো ধ্যান-ধারণার বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসে প্রচুর নবীন শিল্পী অপ্রত্যাশিত ভাবে, আনকোরা নতুন চোখে যে ভাবে শিল্পকে দেখেছেন, সেই পর্যটন এখানে সাগ্ৰহ গ্ৰহণ করা হয়েছে। এই মঞ্চে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে জায়গা করে নিয়েছেন ৩৫ জন শিল্পী। প্রদর্শনী চলবে আগামী ২ অগস্ট পর্যন্ত।

পশ্চিমি আধুনিক ছবি আঁকার জগতে প্রধানত পরীক্ষানিরীক্ষা হয় আঙ্গিক নিয়ে। সম্ভবত এটি আরম্ভই হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। শিল্পজগতে যুক্তিসিদ্ধ কাজের ভাবধারায় তখন শিল্পীরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এ সব ঘটনা মোটামুটি শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই লক্ষণীয়। ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই বলা যায়। তার পরে ছিলেন নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ‘কলকাতা গ্রুপ’ আর ‘প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’ (মুম্বইয়ের) ভারতীয় আধুনিকতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। তার পর পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শিল্পীরা প্রধানত দেশজ আচার এবং রীতিনীতি নিয়ে আধুনিক গঠনে ছবি আঁকতে শুরু করেন। এই শিল্পীদের মধ্যে আছেন কে জি সুব্রহ্মণ্যম, গণেশ পাইন, অর্পিতা সিং, সোমনাথ হোর, লালুপ্রসাদ সাউ, এম এফ হুসেন প্রমুখ। সিমার প্রদর্শনীতে এই সকল শিল্পীর ছবি দর্শকের মনোরঞ্জন করবে।

এর পর প্রদর্শনীর চলার গতিতে আসে আঁকাবাঁকা জড়ানো রেখার অতি আকৃষ্ট নকশা। ’৮০ এবং ’৯০-এর দশকের শিল্পীদের কাজ দেখানো হয়েছে। সেখানে আছেন অঞ্জু চৌধুরী, জয়া গঙ্গোপাধ্যায়, প্রদীপ রক্ষিত, সমীর আইচ, অখিলেশ এবং শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়। এঁদের ছবিও এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।

এর পরে এল তরুণ শিল্পীদের একেবারে ছাঁচ থেকে বেরিয়ে নতুন পথ হাঁটার পালা। এখানে তাঁরা রিসাইকলড উপাদান, পরিবেশবান্ধব পদার্থ, জৈব রং ইত্যাদি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন জীবনরসে জারিত সব ছবি। কারণ এঁরা সব সময়েই চিন্তিত পরিবেশ দূষণ নিয়ে।

দর্শক এখানে দেখলেন বসবাসের উদ্দেশ্যে শিকড় উপড়ে স্থানান্তরে যাওয়া, নিজের পরিচয় এবং লিঙ্গ নিয়ে অনবরত লড়াইয়ের সম্মুখীন হওয়া আজকের মানুষের ছবি। এই সব কাজের শিল্পীরা হলেন অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দন বেজ বড়ুয়া, রিমি আদক, কল্পনা বিশ্বাস এবং তার সঙ্গে শাকিলার দৃপ্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এই সামার শোয়ের বিশেষত্বই হচ্ছে যাবতীয় পরিচিত ঘরানা, চেনা আঙ্গিক থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন পরিচয়ে প্রকাশিত হ‌ওয়া। এই নবীন শিল্পীরা যেন ইতিহাস এবং প্রাসঙ্গিকতা মাথায় রেখেই নতুন এক অচেনা দিগন্তের পথিক।

কিংশুক সরকারের ‘বাস্তব’ বলে ছবিটি কার্বন, সোনাঝুরি গাছের গঁদ, চামড়ার আঠা এবং মাটি দিয়ে ট্রিটেড ক্যানভাসের উপরে করা। যন্ত্রণায় বিকৃত একটি মানুষের আকৃতি। রঙের প্রাধান্য নেই একেবারেই। স্কেচধর্মী কাজ, কিন্তু চোখ ফেরানো যায় না। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া একটি মানুষের ভাঙা ফর্ম।

জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজটি শিরোনামহীন। কালি-কলমে করা কাগজের উপরে। এখানেও এক বিকলাঙ্গ নারীমূর্তি দেখা যায়। অবজ্ঞা, অপমান, অবহেলা, ক্ষুধায় মানুষের যখন পশুত্ব প্রাপ্তি হয়, এটি সেই রকম এক ছবি।

সুমন্ত চৌধুরীর ছবির‌ও শিরোনাম নেই। কাগজের বোর্ডের উপরে মিশ্র মাধ্যমের কাজ। মেজাজ একেবারে পাল্টে গেল এই কাজে। কিছুটা মিনিয়েচার ছাঁদে গড়া কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিজস্ব একটি ছবি সৃষ্টি করেছেন, যাতে রং, কাঠামো, পরিসর সবটা মিলিয়ে মনোরম একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছবি মন ভাল করে দেয়।

এর পরের সুন্দর ছবিটি শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে গড়া অ্যাক্রিলিক রং, অ্যাপ্লিক এবং সেলাইয়ের সুচের ফোঁড়ে উঠে এসেছে। ছবির নাম ‘ইন ক্লাস্টার্স’। দলবদ্ধ ভাবে মানুষের বসবাস দেখিয়েছেন শিল্পী। কোথাও কোনও অশান্তি বা উদ্বেগ নেই। শান্তিতে বসবাস করছেন মানুষ। আশাবাদী শিল্পী মনুষ্যসভ্যতার প্রতি আস্থা রাখেন।

অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘সুন্দরবন টু সোনারপুর’ আবার কিছুটা বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে দর্শকের মনকে। কাগজের উপরে গোয়াশের কাজ। শিল্পী এখানে বলছেন, আজকের সভ্যতায় মানুষ শহরের যেখানেই যাক না কেন, সব বাড়ি-ঘরের চেহারা মোটামুটি এক‌ই ধরনের। স্থাপত্যকলার কোন‌ও অভিনবত্ব নেই, সব যেন লুপ্ত। তেমন বৈচিত্র নেই, নেই কোনও নিজস্ব চরিত্র। আরও অভাব কোনও রঙের বৈচিত্রের, সে সুন্দরবন হোক বা সোনারপুর‌।

এ ছাড়াও আছে যোগেশ দশরথের মিশ্র মাধ্যমের কাজ, অবিনাশ ভরদ্বাজের কালি-কলমের কাজ ‘আ ট্রি অব ম্যাজেস্টিক থটস’, রিমি আদকের ক্যানভাসের উপরে মিশ্র মাধ্যমের কাজ ছাড়াও জ্যোতি ভট্টের ‘রিমেন্স অব দ্য ওল্ড বাংলো’, চন্দন বেজ বড়ুয়ার উডকাট ইত্যাদি অনেক অন্য রকম কাজ দেখতে পাবেন দর্শক।

এর পর দেখা যায় শাকিলার ক্যানভাসের উপরে কাগজের কোলাজের ছবি। দর্শককে মুগ্ধ করবে শিল্পীর গ্রামীণ অনুভূতি, রং-চয়ন, আঙ্গিক এবং টোনের জ্ঞান। গ্রামের জীবনের একটি ছবি যেন তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে। কিছু সময় দর্শককে এই ছবির সামনে দাঁড়াতে হবে, ভাবতে হবে। কাগজ ছিঁড়ে করা, তবে কি এ ছবি নয়? অসামান্য কাজ!

প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মধ্যে নজর কাড়ে সমীর আইচের কাজ। কাগজের উপরে রং, কালি, তুলি এবং সূক্ষ্ম ভাবে করা পেনের ড্রয়িং। সভ্যতার সঙ্কটের সময়ে মানুষ, পশু এবং যন্ত্র যেন মিলেমিশে একাকার। একে অপরকে ধ্বংস করতে উদ্যত।

রশ্মি বাগচি বড়ুয়া, সুবীর দে, যশশ্রী দুগার, কুন্তল দত্ত, সুহানি জৈন, পরেশ মাইতি, মণীশ মৈত্র, আকবর পদমসী, গণেশ পাইন, অরুণাংশু রায়, শান্তনু রায়, সত্যজিৎ রায়, শুভান্বিতা সাহা, প্রশান্ত সাহা, অভিজিৎ সরকার, অজিত শীল, অমরনাথ সেহগাল, কুসুমলতা শর্মা, লালু প্রসাদ সাউ, কে জি সুব্রহ্মণ্যম এবং কল্পনা বিশ্বাসের কাজ এই প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে।

তরুণ শিল্পীদের অভাবনীয় সব কাজ দর্শকের ভাল লাগবে। কিছু নিছক‌ই ছবি, কিন্তু তার গঠনশৈলী আলাদা। কিছু কাজ ভাস্কর্যধর্মী, অন্যান্য কাজগুলিতে শিল্পীরা নিজেদের কল্পনার ডানায় ভেসে ভেবেছেন। যুক্তিতে তার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। কিন্তু চিত্রকল্প তো যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না, তাই রসিক দর্শক এই প্রদর্শনী থেকে মনের খোরাক যথেষ্ট সংগ্রহ করতে পারবেন বলেই আশা করা যায়।



(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

CIMA Gallery

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy