দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসের নিবেদনে ‘রামকিঙ্কর উৎসব ২০২৫’-এ গোপাল ঘোষের একক চিত্র প্রদর্শনী উদ্যাপিত হল, যার নাম ‘দৃষ্টিপথ থেকে চিত্রপট’। কবি বিষ্ণু দে-র সংগ্রহে থাকা শিল্পী গোপাল ঘোষের রং ও রেখার কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী চলছে।
বাবার কর্মসূত্রে গোপাল ঘোষের শৈশবের অনেকটাই কেটেছিল সিমলায়। সেনাবাহিনীতে ছিলেন তাঁর বাবা। হিমাচলের সেই পাহাড়ি উপত্যকা এক অন্য রকম উপলব্ধি জাগিয়েছিল তাঁর মনে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন গোপাল, আর তাঁর বাবা প্রচুর কাগজ আর রং কিনে দিতেন। বাবা অবসর গ্রহণ করার পরে বারাণসীতে চলে আসতে হয় তাঁদের। তখন আবার একেবারে অন্য এক জগতের মুখোমুখি হলেন তিনি। কাশীর বিখ্যাত গলি, তীর্থযাত্রী, মন্দির, ঘাট শিল্পীকে যেন এক অন্য জগতে এনে ফেলল।
ইলাহাবাদে (অধুনা প্রয়াগরাজ) থাকাকালীন ম্যাট্রিক পাশ করে, আই.এ-র পাঠ শুরু, কিন্তু জড়িয়ে পড়েন অসহযোগ আন্দোলনে, বিতাড়িত হতে হয় কলেজ থেকে। তারপর জয়পুর মহারাজা আর্ট স্কুলে শিল্পশিক্ষার পাঠ শুরু। সেখানে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পাদর্শে দীক্ষিত শৈলেন্দ্রনাথ দে। তাঁর কাছেই বঙ্গীয় শিল্পকলার পাঠগ্রহণ। কলেজের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর টানে মাদ্রাজের (অধুনা চেন্নাই) গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ।
১৯৩৮ সালে গোপাল ঘোষ কলকাতায় চাকরি পেলেন, অবনীন্দ্রনাথের ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টে। ছুটিতে সাইকেলে সারা ভারত ঘুরে এলেন। এর পরে শিবপুর বি ই কলেজে স্থাপত্যকলা শেখাতেন। শেষ পর্যন্ত রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁকে সাদর ডেকে নিলেন, সরকারি চারুকলা বিদ্যালয়ে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্টে অধ্যাপনা করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে তাঁর সমসাময়িক আধুনিক ভারতীয় শিল্পী নীরদ মজুমদার, প্রদোষ ও কমলা দাশগুপ্ত, রথীন মৈত্র, শুভ ঠাকুর, পরিতোষ সেন, প্রাণকৃষ্ণ পালের সঙ্গে গোপাল ঘোষও কলকাতা গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
শিল্পী ছোটনাগপুর অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ, ঢেউখেলানো পাহাড় এবং উপত্যকাগুলিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর কাজের বিষয়বস্তু ছিল গাছপালা-সহ রুক্ষ মাঠ, দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা ধানখেত, সেখানে খুব কমই কারও দেখা মেলে... যেমন হয়তো কোনও আদিবাসী মহিলা কিংবা কোনও গবাদি পশু। গাছ, পাখি, পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, মেঘ— সব কিছুই শিল্পীকে আকর্ষণ করেছে। উজ্জ্বল আলো-ছায়া, ঋতু পরিবর্তন, পরিবেশ প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতির বিভিন্ন মেজাজ তিনি ধারণ করার চেষ্টা করেছেন নিজের কাজে। তাঁর অত্যন্ত সাবলীল অথচ দৃঢ় লাইনগুলি প্রকৃতির সৌন্দর্যের সূক্ষ্মতায় উদ্ভাসিত।
কবি বিষ্ণু দে-র ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা গোপাল ঘোষের রেখা ও রঙের এই প্রদর্শনীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তড়িৎরেখার ক্ষিপ্রতায় কী ভাবে যেন তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন দেখার ছন্দটিকে। তাঁর আঁকা পাখিটি যেন আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাঁর রেখায় চিত্রিত শিশুমুখ যেন আমাদের ঘরের আঙিনায় ক্রীড়ারত শিশুটির অন্তর।
তার এই অতি সংক্ষিপ্ত প্রদর্শনীতেও রং এবং রেখায় এক সুরের আগুনকে অনুভব করতে পারি আমরা, যা তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল সর্বব্যাপ্ত দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এখনকার বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রধান শিল্পী যাঁরা, গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী, লালুপ্রসাদ সাউ— এঁরা একদা ‘মাস্টারমশাই’ গোপাল ঘোষকে পেয়েছিলেন তাঁদের কলেজজীবনে। এঁদের প্রত্যেকের স্মৃতিচারণায় জেগে আছে একটি ফুল, কোনও পাখি কিংবা একটি পতঙ্গকে কী ভাবে দেখতেন গোপাল ঘোষ। আসলে এই দেখার চোখই যে ছিল তাঁর সারা জীবনের আবিষ্কারের আনন্দ। তাঁর চিত্রশৈলীর বৈশিষ্ট্য হল, দ্রুত আঁকা ক্যালিগ্রাফিক রেখা এবং কল্পনাপ্রসূত উজ্জ্বল ওয়ার্ম কালারটোনের ব্যবহার।
জলরং, টেম্পেরা, কলম এবং কালি-তুলি ছাড়াও প্যাস্টেল রঙের নিয়ন্ত্রণে দক্ষ গোপাল ঘোষ চিত্রকলার ধারার পুনর্ব্যাখ্যার জন্য নিজের জীবদ্দশায় একজন কিংবদন্তি শিল্পী হয়ে ওঠেন। অসংখ্য কাজ করেছেন তিনি। জলস্রোতের মতো আসত তাঁর জলরঙের নিসর্গচিত্র। সাদা ব্যবহার করে জলরংকে অস্বচ্ছ করেছেন। কখনও কখনও প্যাস্টেল, কাঠকয়লা, জলরঙের মিশ্রমাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। অনবদ্য সেই সব ছবির কিছু কিছু এই প্রদর্শনীতে দেখতে পাবেন দর্শক।
গোপাল ঘোষের ছবিতে নিসর্গ তার আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে যায়। স্থান-কালের সীমানার বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ্যের যে মূল চরিত্র, তাই ধরতেন তিনি। আলো-হাওয়া-পাহাড়-পর্বত-গাছপালা-ফুল। নির্জনতম শিল্পী গোপাল ঘোষ যেন ছিলেন রূপতন্ময়। রঙের সুর শুনতেন কান পেতে। নিসর্গের ভিতরে যে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে রোজ, লিখিত হচ্ছে যে সব কাব্য, ভেসে চলেছে যে রাগ ও সঙ্গীত, রোদ এবং জলের যে আলিঙ্গন, হাওয়ায় যে আনন্দ-অস্থিরতা ও বেদনার মূর্ছনা, তিনি সব অনুভব করতে পারতেন। শিল্পী গোপাল ঘোষ ছিলেন প্রকৃতির হোলিখেলার রূপকার। এই প্রদর্শনীতে সংবেদনশীল দর্শক সেই রেখা এবং রঙের আগুনকে নিশ্চয়ই স্পর্শ করতে পারবেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)