দীর্ঘ ১২ বছর পরে কলকাতায় মলয় সাহার একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল গ্যালারি বি কাফে-তে। প্রদর্শনীতে শিল্পীকে নতুন করে পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে বেশ কিছু দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন মলয়। কিন্তু এ বারে শিল্পীর কাজের যে বিকাশ দেখা গেল, সেটা তাঁর অবচেতন থেকে উঠে আসা প্রত্যয়ের প্রকাশ।
শিল্পী মলয় সাহা রবীন্দ্রভারতী থেকে পাশ করে চলে যান শান্তিনিকেতনের কলাভবনে, যেখানে তিনি ফাইন আর্টসে মাস্টার্স করেন। শহর কলকাতায় যে ভাবে আশপাশের মানুষ এবং বাড়িঘর দেখেছিলেন, তা পাল্টে গেল শান্তিনিকেতন গিয়ে। প্রকৃতিকে কাছে পেয়ে অন্য রকম একটা বিশ্বাস জন্ম নিল, যেটাকে অন্তরে গ্রহণ করতে কিছুটা সময় লেগেছিল শিল্পীর। কলেজ ছাড়ার পর থেকে কোনও দিনই বাস্তবধর্মী ছবি আঁকেননি। সে সময়ে কিছু দিন আঁকা বন্ধ রেখেছিলেন। তখন তিনি নিজের মধ্যে প্রবেশ করেছেন এবং উত্তর খুঁজেছেন। মাথায় প্রশ্ন চলছিল, কেন আঁকব, কী আঁকব এবং কার জন্য আঁকব। আসলে শিল্পী তাঁর নিজস্ব ভাষা খুঁজছিলেন।
ইতিমধ্যে মাস্টারমশাই হিসেবে পেলেন কে জি সুব্রহ্মণ্যমকে। শিল্পী মলয় সাহার কাছে ছবিতে স্পেস বা জায়গা বিভাজন খুব প্রয়োজনীয় বলে মনে হল। কাগজে বা ক্যানভাসে রচনা শৈলীতে নতুন ভাবে বিভাজন বা ডিভিশন রেখা এনে টুকরো টুকরো ফর্মে ছবি আঁকতে শুরু করেন মলয়। এর আগে মিনিয়েচার ছবিরও কিছু প্রভাব পড়েছিল তাঁর ছবিতে। মিনিয়েচার ছবিতে যেমন দর্শককে অনেক সময়ে পুরো দৃশ্যটাই উপর থেকে দেখানো হয়। যাকে বলে বার্ডস আই ভিউ। মলয়ের অনেক ছবিই দর্শক ঠিক সেই রকম উপর থেকে দেখতে পাবেন, যা খুব অন্য রকম একটা মজা এনে দেয়।
ছোট ছোট ছবি একসঙ্গে গেঁথে আঙ্গিকের প্রচলন করলেন শিল্পী। ছবিতে বহুবিধ দৃষ্টিকোণ এসে গেল এবং ছবিকে স্তরে স্তরে নির্মাণ করতে আরম্ভ করলেন তিনি। ছবি তখন তাঁর কাছে আর সমতল, মসৃণ এবং একমাত্রিক রইল না। মলয় সাহার প্রিয় শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যম এবং হেনরি মাতিস।
পরে আবার যখন কলকাতায় ফিরেছেন, তত দিনে নগর কলকাতার চরিত্র রীতিমতো পাল্টে গিয়েছে। চারদিকে বহুতল বাড়ি এবং গাড়ির জঙ্গল যেন শ্বাস বন্ধ করতে আসছে। চিন্তাশীল শিল্পীর ভাষায় আবার এল পরিবর্তন। জায়গার অভাবে দেখলেন মানুষের আবদ্ধতাভীতি বা ক্লসট্রোফোবিয়া। এ বার শহরটাকে দেখাতে চাইলেন সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। ছবিতে দেখা দিল ছোট ছোট ঘর। সেখানে আঁকলেন টেবিল, চেয়ার, বিছানা, বালিশ ইত্যাদি। সমস্ত আসবাবের মধ্যে চেয়ার তাঁর কাছে রূপকাত্মক হয়ে উঠল। একটি চেয়ার তার হাত-পা-মাথা-অবয়ব এই সমস্ত কিছু নিয়ে যে কোনও জায়গাতেই প্রাধান্য পায়, আধিপত্য করে। এ ছাড়াও পুরো শহরটাকে ধরার চেষ্টা করেছেন শিল্পী— রাস্তাঘাট, ল্যাম্পপোস্ট... ইত্যাদি সবই আছে তাঁর ছবিতে।
এখন তাঁর ছবিতে চলে এল মাটিতে পাতা মোটা বুননের পাপোশ জাতীয় আচ্ছাদনের মতো খসখসে, কিছুটা সেলাই করা জমির মতো কাজ। ছবির কিছু অংশে কালো রং ফ্ল্যাট করে লাগানো। তার পাশাপাশি এই রকম বুনোটের টেক্সচার এনে ছবিকে মনোগ্রাহী করে তোলেন শিল্পী। ব্যবহার করলেন উজ্জ্বল লাল রং।
মলয় সাহা এখন আর দ্বিমাত্রিক ছবি আঁকেন না। তাঁর ছবি এখন অন্য রকম ত্রিমাত্রিক। উঁচু-নীচু নানা রকম সারফেস সৃষ্টি করেন। মাঝেমধ্যে সেখানেও বৈচিত্র আনেন। সে সব সৃষ্টি করতে সাহায্য নিয়েছেন কাগজ, কার্ডবোর্ড ইত্যাদির। মলয় যেন দর্শককে ঠিক বাইরে থেকে তাঁর শিল্পকর্ম উপভোগ করতে দিতে চান না। ভিতরে টেনে আনতে চান দর্শকের নজরকে। দেখাতে চান নিজের কাজের খুঁটিনাটি।
মলয় সাহা এখন চতুর্ভুজ আঙ্গিক থেকে বৃত্তাকার গড়নে চলে এসেছেন। তাঁর উত্তরণ ঘটেছে বাঁধা জায়গা থেকে গোলাকৃতি জায়গায় স্তরে স্তরে কাগজের কাজ করে। যেখানে শিল্পী হয়তো মুক্তাঙ্গন খুঁজছেন, গতি খুঁজছেন। মলয় সাহার ছবির আঙ্গিকে অসম্ভব নিজস্বতা, বুদ্ধি এবং দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও হয়তো হৃদয়ের ছোঁয়া পাওয়া যায় না, ভালবাসা থাকে না। মলয় সাহা যদি তাঁর ত্রিমাত্রিক বৃত্তাকার ছবিতে একটু প্রেমের ছোঁয়া দিতে পারেন, তবেই হয়তো তাঁর শিল্পীমনের ক্রমবিকাশ ধরা পড়বে এবং স্থান বা পরিসর নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা শিল্পরসিকদের মন্ত্রমুগ্ধ করবে।
মলয় সাহার একক প্রদর্শনী দেশ-বিদেশের বহু জায়গায় সমাদৃত। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে তাঁর কাজ। শিল্পী মলয় সাহার ছবি গতিশীল। তাঁর শিল্পভাবনাও পরিবর্তনশীল। শিল্পপ্রেমী মানুষ অপেক্ষায় থাকবেন তাঁর আগামী কাজের।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)