বিস্তৃত প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার শিল্পের খোরাক জোগায় নিরন্তর। সেই রকমই কিছু ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে কলকাতার চারুবাসনা প্রদর্শশালায় সম্প্রতি শিল্পী প্রমা বসুর ‘অধরা মাধুরী’ নামাঙ্কিত একক প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল।
এ জগতের বিবিধ বস্তুর মধ্যে শিল্পীর বিশেষ অনুপ্রেরণার বিষয় হল গাছপালা, আনাজপাতি— মূলত কুমড়ো ও লাউ— তার লতা, পাতা, ফল, ফুল, বীজ ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে এ সবই বাঙালির গার্হস্থ জীবনের দৈনন্দিন রসনার অঙ্গ। কিন্তু এখানেই একজন শিল্পীর দেখার সঙ্গে অন্যদের দেখার মধ্যে যে পার্থক্য, তা সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে। অর্থাৎ এই অনায়াসে প্রাপ্ত শাকসবজিগুলি যে এই শিল্পীর চোখে কোনও সাধারণ জিনিস নয়, বরং তার আকার, রং, রূপ ও ছন্দসমূহ এক অভিনব অনুভূতির আস্বাদে সম্পৃক্ত, সেই পরিচয় পাওয়া যায় প্রমার কাজে। শিল্পীর কল্পনার রসে সিক্ত হয়ে ক্যানভাসে যেন তারা এক আবেগময় উপস্থাপনে সমৃদ্ধ।
শিল্প ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ‘স্টিল লাইফ’ শৈলীর ধারা বহু প্রাচীন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ছবিগুলি শুধু স্টিল লাইফ পর্যায়ে থেমে না থেকে, এক আত্মিক খোঁজের ভাবে যেন নিমগ্ন হয়েছে। লাউ অথবা কুমড়োলতা যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করে, চিত্রপটকে চমৎকার ভাবে অলঙ্কৃত ও গতিময় করে তুলেছে। প্রচলিত বাংলা ভাষায় লাউ-কুমড়োর বিশাল আকার প্রায়শই হাস্যকৌতুক বা বিদ্রুপের আভাস বহন করে। কিন্তু সেই তরিতরকারি যখন তাদের বাহ্যিক রূপের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এক পিকটোরিয়াল ফর্মের সংজ্ঞা অর্জন করে, তখন তা শিল্পের ভাষায় খুবই উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।
‘অধরা মাধুরী’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে প্রমার প্রদর্শিত কিছু কাজ, যেমন ‘জ্যোৎস্না’ অথবা ‘হারমনি’-র মতো কিছু কাজে কুমড়োলতার পেলবতা, তার প্রাকৃতিক ছন্দ, লতার গায়ের নিখুঁত আঁশ বা টেক্সচার, আধো ফুটন্ত হলুদ বা নীল ফুলের লুকোচুরি দর্শককে প্রায়শই এক সাঙ্কেতিক ও অতিজাগতিক স্তরে নিয়ে যায় যেন। সাধারণ থেকে অসাধারণের দিকে উন্নীত করে এই সাধারণ জিনিসগুলিকে। এই জাতীয় সুপার-রিয়্যালিজ়মের সঙ্গে ডিজ়াইন বা অলঙ্করণের যে মেলবন্ধন, প্রমার কাজগুলিতে তা বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। অন্য দিকে ‘মিস্টেড অ্যাবান্ডান্স’ ছবিটিতে মূলত কালো-সাদা প্রলেপের মধ্যে একটি ছিন্ন কাঁঠালগাছের গুঁড়ির দু’দিকে দু’টি হলুদ-সবুজ কাঁঠাল ফলের যে উপস্থাপনা— তা যেন ধ্বংসের মাঝে ফলগুলির দুর্দমনীয় বেঁচে থাকার আকুতিকে প্রকাশ করে। প্রকৃতির বিনাশের ভয়াবহতার প্রতি দর্শককে যেন বিশেষ ভাবে সজাগ করার এক বার্তা বহন করে।
প্রায় প্রতিটি কাজের মধ্যেই প্রমা বসুর গভীর একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও তার সৃষ্টিসত্তাকে খুঁজে দেখার দিকগুলি প্রতিভাত হয়। তেমনই আবার এক হিমায়িত মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার ছোঁয়াও বিশেষ ভাবে প্রকাশ পায়।এ ক্ষেত্রে প্রকৃতি যেন শিল্পীরআত্মার এক স্বরূপসম— সত্যের সন্ধানে ব্রতী।
প্রমা বসুর এটি চতুর্থ একক প্রদর্শনী। আগামী দিনে সম্ভাবনাময় এই শিল্পীর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের এমন সুচারু শিল্পকর্মের আরও নজির দেখার প্রত্যাশা রাখেন দর্শক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)