E-Paper

এক সময়োপযোগী পদক্ষেপ

পেন্টার্স এইটির কাজ আগের মতোই চেতনার গভীরে আশ্রয় নেয়। চর্চার সজীবতা নির্বাচিত চিত্রগুলিকে সচল করে তোলে।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ০৭:৫০
সমবেত: চারুবাসনায় আয়োজিত পেন্টার্স এইটি দলের বার্ষিক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সমবেত: চারুবাসনায় আয়োজিত পেন্টার্স এইটি দলের বার্ষিক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

কলকাতার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদল পেন্টার্স এইটি-র প্রদর্শনী সম্প্রতি হয়ে গেল ‘চারুবাসনা’য়। শিল্পকে অবলম্বন করে টিকে থাকার গরিমায় এই গোষ্ঠী ৪৪ বছর ধরে পথ চলছে। গ্যালারির দু’টি কক্ষ জুড়ে এ বারের প্রদর্শনীতে ছিল সদস্যদের ছোট ছোট নানা কাজ।

১৯৮০ সাল থেকে দীর্ঘ যাত্রার সংযোজন-বিয়োজনের পরে দলে বর্তমান শিল্পীর সংখ্যা ১৩। দলটি গড়ার মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের তৎকালীন শিক্ষক ও শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। তাঁরই উৎসাহে সে দিনের তরুণরা যে ভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন, তা বিফলে যায়নি। বেশির ভাগই পরবর্তীকালের সফল চিত্রকর্মী। এরই মধ্যে সদ্য প্রয়াত হয়েছেন দলের সভাপতি পণ্ডিত-প্রাবন্ধিক অনিরুদ্ধ লাহিড়ী, সকলের প্রিয় চাঁদদা। দলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু হল এই বিশেষ প্রদর্শনী।

পেন্টার্স এইটির কাজ আগের মতোই চেতনার গভীরে আশ্রয় নেয়। চর্চার সজীবতা নির্বাচিত চিত্রগুলিকে সচল করে তোলে। নন্দনতত্ত্বের পরিভাষায় আত্ম-অনুভূতিকে স্বতন্ত্র রূপে প্রত্যক্ষে মেলে ধরেন তাঁরা। বেশ কিছু নতুন ভাবনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে।

স্পষ্টবাদী শিল্পী প্রদোষ পালের কাছে অবজেক্টিভ সৌন্দর্যের দাবি সে ভাবে নেই। পরিবর্তে যন্ত্রণা, যা একান্তই স্পর্শকাতর। একাকিত্ব বোধের আকুতি রয়েছে ছবিতে। যদিও এই একাকিত্বের দৌলতে, প্রদোষের ক্যানভাস স্পর্ধিত হয় মহাজাগতিক বোধে। ‘অনামা’ চিহ্নিত কাজে সাদাকালো, ধূসর মিশেলের অ্যাক্রিলিক মাধ্যম। আকাশের অগণিত টেক্সচার ও ধু-ধু জমির ঐকান্তিক বুননে ফুঁসে ওঠে কেন্দ্রীয় ইমেজ। হাহাকার ছাপিয়ে প্রতিবাদী রোষানল ঘুরপাক খেতে থাকে। আর একটি লক্ষ করার মতো কাজ। দুমড়ে মুচড়ে পড়া একটি স্কেলিটন। ব্রাশিংয়ের ক্লাসিক আঁচড়ে টুকরো টুকরো ব্যথার ফর্ম তৈরি হয়। মননশীল নির্মাণে সমাজের প্রতি শিল্পীর দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়।

অমিত দেবনাথের মিশ্র মাধ্যমের কাজগুলি কফির পাতলা জল মিশিয়ে ক্যানসন পেপারে করা। ‘এক্সপ্রেশন অব মাইন্ড’ নামের ছবিগুলি বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের একপ্রকার দলিল। যেমন পা বেঁধে রাখার প্রতীকে নিজের পরাধীনতা স্পষ্ট করা। এই অবস্থার তিনটি কাজ। সাদা পটে জটিল বহমান রেখায় বেষ্টিত নারীর তির্যক চাউনি। আবার এলোপাথাড়ি চাপানোয় বেরিয়ে আসে দু’টি ক্রোধের মুখ। জলরঙের স্বচ্ছতায় ফ্লোটেল ইমেজ নিয়ে কাজ করেছেন অপু দাশগুপ্ত। তুলির নরম চেষ্টায় নারীর লাবণ্যযোজনা মন্দ নয়।

ছোট ছোট অলঙ্করণে পার্থিব জগৎ ঠাঁই নিয়েছে শিল্পীর কল্পিত আননে। রূপের মধ্য দিয়ে ভিতর-বাহির কর্মক্রিয়ায় রত বিভিন্ন অবজেক্ট। এক নজরে মনে হয় কোলাজ-কাহিনি। গোয়াশ মাধ্যমের রেখাপ্রধান এই কাজগুলির স্রষ্টা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। মিশ্র-মাধ্যমের কম্পোজ়িশন এবং মায়াজালে বহুমাত্রিক ধারণা এনেছেন দেবাশিস বারুই। তছনছ আক্রমণে জমির রূপান্তর ঘটে। উর্বরতার মৃত্যুভূমি তৈরি হয়। বিভিন্ন মেটেরিয়ালস-যোগে দেখানো হয়েছে বর্তমান স্থানচিত্র। কাজের আয়তনে সে ভাবে ছোট-বড়র প্রশ্ন না-ই আসতে পারে। কিন্তু কিছু ছবির বিষয় এবং তার পরিমাপ সার্বিক বোধের ব্যাঘাত ঘটায়। স্পেস ও দূরত্ব নিরিখে ছবি দর্শনে স্বতঃস্ফূর্ততা বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ উল্লেখ করার মতো কয়েকটি ছবি ছিল।

নিপুণ জলরঙে দুটি ভিন্ন বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক দেখিয়েছেন শিল্পী দীপঙ্কর দত্ত। ছবির রং, ড্রয়িং এবং পার্সপেক্টিভে পূর্ণ মাত্রার রিয়্যালিটি প্রতিভাত হয়েছে। সাদা কাগজের মধ্যবর্তী ঊর্ধ্বাংশে ঝুলন্ত ক্যানভাস। কোনাকুনি টেবিলে রাখা দরকারি উপাদান। কোনওটি সবুজ, কোনওটি হলুদ দোসর। ‘কনভারসেশন’ আয়োজিত বিষয়ের যোগসূত্রে রয়েছে অনিবার্য একটি কালো টেবিল ও সাদা দেওয়াল। অতিরিক্ত রঙের তৃষ্ণা নেই। রয়েছে অব্যক্ত এক নিবিড় যাপন। জলরঙের আর এক চিত্রকর নারায়ণ সাহুর কাজের নামও ‘কনভারসেশন’। প্রয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে বিমূর্ত শাসিত পোস্ট ইম্প্রেশনিজ়মের কিছু ভাঙচুর নির্মাণ, যা প্রকারান্তরে জটিল ভাষ্যের পরিণাম।

ভাল লাগে রাজীব ভট্টাচার্যের হ্যাচিং স্টাইলের সুনিয়ন্ত্রিত বোধ। ছবির নাম ‘আরবান কুপ’। নগর ঘিরে অসন্তোষের কাঠামো। রেখার টানটান বাঁধুনির আনাচকানাচে জ্বলজ্বল করছে অস্তিত্বের সঙ্কট। বৌদ্ধধর্মের লোটাস সূত্র অনুসারে শিল্পী তিমির ব্রহ্মর পুষ্পরাজি আশার ঝলক দেখায়। শিল্পী নির্মাণে ব্যবহার করেছেন সানমাইকার উপরে কালি ও অয়েল প্যাস্টেল। মিশ্রণের টেকনিকে উঁকি মারে গ্রাফিক্সের ছোঁয়া।

গোয়াশ ও ট্রান্সপারেন্ট কৌশলে শিল্পী স্নেহাশিস মাইতির ‘ট্রি লাভার’ মোচড় দেওয়া অনুভূতি তৈরি করে। কেন্দ্রীয় আলোয় নতজানু এক পুরুষ। সহজ, সুন্দর দ্বিমাত্রিক ভেদে তার অবস্থান। আর একটি হৃদয় বিদীর্ণ করা ছবি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। জলরং মাধ্যম হলেও প্রয়োজন মতো ওপেক স্টাইলে বিষয় এসেছে। কালো-বাদামির শুকনো চরাচর। বন্দি এক টুকরো গাছের খণ্ড শূন্যে ঝুলছে। কোথাও এতটুকু আশ্রয় নেই। বিবর্ণ রং-রেখার একটি প্রতীকী ছবি।

বিশিষ্ট শিল্পী অমিত চক্রবর্তীর ভাবনায় মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব কয়েকটি ফর্মে নির্মিত হয়েছে। জলছবির এই শিরোনাম, ‘কসমোজেনেসিস’। জ্যামিতিক নকশায় শিল্পীর আধ্যাত্মিক উন্মোচন ভাল প্রয়াস। দেবাশিস মান্নার ‘অনামা’ নির্দিষ্ট চারটি কাজই স্বতন্ত্র জীবনের এস্টাব্লিশমেন্ট। কাজের প্যাটার্নে নাইভ আর্টের কল্পনাশক্তি প্রকাশ পায়। পোস্ট মডার্নিজ়মের পথ বেয়ে শিল্পের একচেটিয়া সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়। বাহবা পায় শিল্পী।

সব মিলিয়ে এই শিল্পীদলের সমবেত প্রচেষ্টা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। যেন এক নতুন শিল্পরীতির উত্থান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

exhibition

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy