মায়া আর্ট স্পেসে সম্প্রতি প্রদীপ সাহার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। কলকাতায় তাঁর এই তৃতীয় একক প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল, ‘জার্নি উইদিন’।
ছবি আঁকা একেবারে ছোটবেলা থেকে শুরু। স্কুলের মাস্টারমশাই আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক পাশ করে তবেই আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়। চিরকালই ভারতীয় শিল্পকলার ধরনটাই পছন্দ ছিল তাঁর। সেই কারণেই তিনি ভারতীয় শিল্পীদের ছবির সঙ্গে পরিচিত অল্প বয়স থেকেই। আর্ট কলেজে কমার্শিয়াল আর্টে ভর্তি হওয়ার পরে শিক্ষক অশেষ মিত্র নিজের ক্লাসে লাইফ স্টাডি করাতে করাতে প্রদীপকে ফাইন আর্টসে চলে যেতে উপদেশ দেন। সেই সময়েই চলে আসা ফাইন আর্টসে।
চতুর্থ বছরে শিক্ষক হিসেবে পেলেন শিল্পী গণেশ হালুইকে। জীবনটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নিল তাঁর। সেই সময় থেকেই বাইরে গিয়ে অফুরন্ত স্কেচ করার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেন প্রদীপ। আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার ছবি, নিউ মার্কেটে গিয়ে পাখির স্কেচ। গোয়ালে গরুর ভঙ্গিমার পেনসিল ড্রয়িং। রাস্তায় চায়ের দোকানের আশপাশে মানুষের অসংখ্য স্কেচ করে ফেলেছেন তখনই। ইতিমধ্যে জীবিকা ধারণের জন্য চাকরি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তায় জ়ুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় নিজের যাবতীয় স্কেচ নিয়ে তিনি হাজির হলেন এবং তৎক্ষণাৎ আর্ট সংক্রান্ত একটা চাকরিও হয়ে গেল।
অফিসে কর্মরত অবস্থায় সুযোগ এল গাছপালা, জীবজন্তুর সান্নিধ্যে আসার। ‘ইমপ্রেশন ৮৭’ নামে একটি দলের সঙ্গেও কাজ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁর ছবি প্রকৃতিপ্রধান হয়ে ওঠে। এর পরের অধ্যায়ে সরকারি চাকরির সুবাদে ধানবাদে, বালুরঘাটে, ত্রিপুরায় বিভিন্ন ভাবে এবং ভাষায় মিউরাল করতে যেতে হয়। কখনও গ্লাস কোলাজ বা মোজ়েকের মাধ্যমে, কখনও টেম্পেরায়, কখনও বা সিমেন্ট রিলিফে। এই ধরনের বহু কাজের জন্যে তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন।
গণেশ হালুইয়ের কাছে টেম্পেরার বিশেষ পাঠ নেওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নিজস্ব এক আঙ্গিকে টেম্পেরার কাজে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পী প্রদীপ সাহা। প্রথম জীবনের মানসিক দ্বন্দ্ব, বেদনা, একাকিত্ব, অজানা আশঙ্কা ইত্যাদি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে তাঁর যেন এক নতুন পথচলা দেখা গেল এই প্রদর্শনীতে।
এখানে প্রায় সবই শাল-তাল-তমাল-পর্বতভিত্তিক ছবি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে পাহাড়ের নিঃসঙ্গতা বোধ শিল্পীকে এই ধরনের ছবি করতে বাধ্য করেছে। নিঃসঙ্গ পর্বতমালা যেন এক-একটি মানুষ, তাদের মনের কথা বলছে। পাহাড়ের আনাচকানাচে শিল্পী মানুষের অব্যক্ত অবয়ব এঁকেছেন। নিজের ভিতরে ঢুকে যেন তিনি পাহাড় পর্বতের অন্তরিন কথা জেনে ওদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন।
গণেশ হালুইয়ের অনুপ্রেরণায় প্রাচীন গুহাচিত্রে যে ধরনের টেক্সচার ব্যবহার করা হত, সেই ভাবে প্রদীপ সারফেস বা পৃষ্ঠতল তৈরি করেছেন একটার পর একটা প্রলেপ চাপিয়ে। প্রথমে পুরু বোর্ডের উপরে তুলট কাগজে গ্লু বা গাম অ্যাকাসিয়া ইত্যাদি লাগিয়ে রোলার দিয়ে পেতে দেন। তারপর প্রাকৃতিক রং দিয়ে, পাউডার রং ব্যবহার করে, পোস্টার রং আঠার সঙ্গে মিলিয়ে স্তরে স্তরে বেশ এক অভিনব টেক্সচার সৃষ্টি করেন মোটা ব্রাশ দিয়ে, যেটা প্রদীপ সাহা-ই করে থাকেন। ওঁর ছবিতে পাহাড়ের গায়ের মতো পাথরের খসখসে ভাব অনুভব করার মতো। সেখানে আবার মস বা শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের ভাবও আছে। গণেশ হালুইয়ের প্রিয় ছাত্রের টেম্পেরার ব্যবহার সত্যিই একক এবং অনন্য।
অধিকাংশ ছবিতেই পাহাড়ের গায়ে মানুষের অবয়ব বা মুখশ্রী লক্ষণীয়। কোথাও এক বৃদ্ধ গালে হাত দিয়ে চিন্তান্বিত এবং কিছু বলছেন। অপর এক বৃদ্ধ তার কথা শোনায় মগ্ন।
আবার অন্য কোথাও পর্বতপৃষ্ঠে ফার্ন জাতীয় গাছের সঙ্গে মিলেমিশে একটি বালিকা, যার মুখে বিস্ময়। অসাধারণ অনুভূতি সৃষ্টি করে ছবিটি।
আর একটি ছবিতে পাহাড়ের পটভূমিতে যেন এক আফ্রিকান মহিলার পার্শ্বমুখ। ভারী সুন্দর ছবিটি। মেয়েটির মাথার আবরণে এবং গয়নায় মণিরত্ন এঁকেছেন যত্ন সহকারে। এখানেও দেখার মতো প্রকাশভঙ্গি এবং টেক্সচার।
আরও একটি ছবিতে পাহাড়ের একাংশে বেশ কয়েকটি পুরুষের মাথা মুখোমুখি। এখানে আবার অদ্ভুত সব অভিব্যক্তি। তাঁরা যেন কিছু গুপ্ত আলোচনায় মশগুল এবং বেশ উত্তেজিত। এই রকম ভাবে যেন শিল্পী প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। প্রথম জীবনে ঘন জঙ্গলে, বিপুল পর্বতমালায়, সমুদ্রতটের সীমাহীনতায়, নদীর আঁকেবাঁকে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখানে তারই মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এখন শিল্পীকে বারাণসী বা কাশী টানছে। তাঁর কাছ থেকে এর পরে নতুন কিছু ছবির সম্ভার আশা করবেন দর্শক।
অনুষ্ঠান
অনুষ্ঠানের মুহূর্ত।
- সম্প্রতি পুনশ্চ নৃত্যকলা কেন্দ্র তরঙ্গ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সন্ধ্যার সূচনা হয় “চিদানন্দবিলাস” দিয়ে। এটি একটি ভরতনাট্যম এবং নাট্যশাস্ত্র প্রযোজনা। নৃত্য পরিকল্পনায় নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভাবনায় স্বস্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পণ্ডিত দেবজ্যোতি বসুর সুরসৃষ্টি ও নিলয় সেনগুপ্তর পোশাক পরিকল্পনায় এই পরিবেশনা ছিল এক ধ্যানমগ্ন ও গভীর অভিজ্ঞতা। স্বস্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনা ও নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য নির্দেশনায় এক পরিবেশনা উৎসর্গীকৃত ছিল সর্দার বল্লভভাই পটেলের উদ্দেশে। অসম, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, বাংলা ও রাজস্থানের লোকনৃত্য ও শাস্ত্রীয় নৃত্যের ধারাবাহিক উপস্থাপনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়। শেষ নিবেদন ছিল ‘বন্দে মাতরম’।
- সম্প্রতি বিজয়গড় নিরঞ্জন সদনে সঙ্গীতাচার্য গৌরাঙ্গ সাহার জন্ম শতবর্ষ হয়ে গেল। আয়োজনে রিদম অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক। তাদের ৪৪তম বাৎসরিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম নিবেদন ছিল ১৫জন শিশুশিল্পীর ‘তাল বিচিত্রা’। তবলা ছাড়া ঢাক, কাঁসর, ঢোল, শঙ্খ, বেহালা, বাঁশি ও কণ্ঠসঙ্গীতের অপূর্ব মেলবন্ধনে দাদরা, কাহারবা, ত্রিতালের বিভিন্ন ছন্দে ইমন, যোগ, দুর্গা ও লোকসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। পরিচালনা ও পরিকল্পনায় পণ্ডিত সুজিত সাহা। শিল্পী ডালিয়া রাহুত খাম্বাজ রাগে ঠুমরি পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের আকর্ষক অংশ ছিল তিন প্রজন্মের তবলা লহরা। শুরুতে সঙ্গীতাচার্য গৌরাঙ্গ সাহার গাওয়া দাদরা কিছু অংশ শোনানো হয়। পরে তিন তালে উঠান, পেশকার, কায়দা ছাড়াও পণ্ডিত সুজিত সাহার রচিত গৎ, টুকরা ও চক্রধার শোনান পণ্ডিত সুজিত সাহা, সুরজিৎ সাহা ওঋতজিৎ সাহা। এর পর পুরিয়া রাগে খেয়াল শোনান পণ্ডিত সন্দীপন সমাজপতি।
- বিশিষ্ট কত্থক নৃত্যশিল্পী তন্বী চৌধুরী তাঁর নৃত্যগুরু অসীমবন্ধু ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য, পণ্ডিত রনু মজুমদারের সঙ্গে মঞ্চে আনলেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ‘দ্য সোজার্ন- দ্য স্টোরি অফ হেভেন’। এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য সন্তুরে, পদ্মশ্রী পণ্ডিত রনু মজুমদার (বাঁশি), গুরু অসীমবন্ধু ভট্টাচার্য, তন্বী চৌধুরী কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি করলেন। কথায় কথায় গল্প বুনলেন বাচিকশিল্পী সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে ছিলেন গল্পদিদি প্রিয়াঙ্কা চট্টোপাধ্যায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)