E-Paper

বিপন্ন বাঘের বিচরণভূমি

তমাল ভট্টাচার্য একজন ভাস্কর। তিনি মনে করেন যে, শিল্পীর ধর্মই তাঁর শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষকে জাগানো। এখানে একটি অতীব সুন্দর বাঘের মূর্তি গড়েছেন নিজস্বতা দিয়ে।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:২৬

সম্প্রতি মায়া আর্ট স্পেসে একটি অন্য রকম দলীয় প্রদর্শনী হয়ে গেল। নাম ‘ক্যানভাস ইন স্ট্রাইপস’। যে পশুদের অবয়বে স্ট্রাইপ বা ডোরাকাটা রয়েছে, তাদের নিয়ে বার্তা দিতেই এই প্রদর্শনী। প্রাণিজগৎ থেকে সেই বাঘের বিলুপ্তি যে কত বড় সর্বনাশা এক ঘটনা, সেটা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু বর্ষীয়ান শিল্পীর সঙ্গে তরুণ শিল্পীদের‌ কাজ‌ও দেখা গেল। বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যাঘ্র-সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বাপ্পা ভৌমিক। এই প্রদর্শনীর মূল ভাবনা তাঁরই।

যোগেন চৌধুরীর ছবির নাম, ‘শিরোনাম-বাঘ’। এখানে দম্পতির জীবনে পুরুষটি কোনও কারণে বাঘের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে তার স্বামী ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করেছেন। শিল্পী হরেন ঠাকুরের ছবির নাম, ‘বাঘ নেবে না কি গো’। শিল্পী দেখিয়েছেন যে কোনও দিন হয়তো ডাইনোসরের মতো বাঘ‌ও সাজানো ছবি হয়ে যাবে। একটি ছোট মেয়ে মাথায় এক ঝাঁকা বাঘ-পুতুল নিয়ে বিক্রি করতে চলেছে। এটি ক্যানভাসের উপরে মিশ্র মাধ্যমে আঁকা।‌ কী অনবদ্য ভাবনা!

শিল্পী অশোক মুখোপাধ্য়ায়ের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে অবিভক্ত বিহার এবং অখণ্ড ওড়িশার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব পালনে। ছোটবেলায় ওড়িশায় কাটানোর ফলে অরণ্যের সঙ্গে গভীর পরিচয় থাকা ছাড়াও বন্যপ্রাণীদের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ ভালবাসা। তিনি আগেও হাতি, হরিণ, চিতাবাঘের ছবি এঁকেছেন। ওড়িশার পটচিত্রে প্রায়ই পশুপাখির মোটিফ দেখা যায়। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পটচিত্র এবং লোককাহিনির ধরনে এঁকেছেন একটি চিতার মোটিফ। বেশ চড়া গোয়াশ রং ব্যবহার করেছেন।

তমাল ভট্টাচার্য একজন ভাস্কর। তিনি মনে করেন যে, শিল্পীর ধর্মই তাঁর শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষকে জাগানো। এখানে একটি অতীব সুন্দর বাঘের মূর্তি গড়েছেন নিজস্বতা দিয়ে। এটি তৈরি হয়েছে সেরামিক স্টোনে। বাঘের ভঙ্গিতে যে বিমূর্ততা সেটি অত্যন্ত আকর্ষক।

শিল্পী অভিজিৎ সাহা জলরঙে নেপালি কাগজে বাঘের মুখে একটি অতি বিরক্তির অভিব্যক্তি দেখিয়েছেন। এই শিকারি পশুর বাঁচার অধিকারে সে আক্রমণাত্মক। সে বাঁচলে সমগ্র উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ বাঁচবে।

অন্য দিকে, শিল্পী শমীক দে একটি ভারী মিষ্টি ছবি এঁকেছেন। সমস্ত হিংস্রতা বর্জন করে বাঘটি ফুল, ফড়িং ইত্যাদির সঙ্গে খেলায় মেতেছে। বাঘের চরিত্রের এক নমনীয় দিক দেখিয়েছেন। বাঘ যেন মানুষের মনের হিংসা, উগ্ৰতা ইত্যাদির রূপ। সেই বিভীষিকাময় মনকে এক মুহূর্তে বশ করা যায় ফুল, প্রজাপতি ইত্যাদির মতো কমনীয় উপাদান দিয়ে। ছবিটি কাগজের উপরে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা।

এ ছাড়াও তরুণ শিল্পী সায়ন্তনী দে তাঁর ছবিতে তাঁর‌ই সৃষ্ট বাঘকে বাংলার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো শক্তিশালী, রাজকীয় এবং মহিমান্বিত দেখিয়েছেন। ওর পাশেই বনদেবী তাকে শক্তি জোগাচ্ছেন। প্রকৃতির দৈবিক শক্তির প্রতীক যেন এই বাঘ।

কাকলি চট্টোপাধ্যায় মনে করেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আমাদের সকলের সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। তিনি শুধুই বাঘেরগায়ের ডোরাকাটা অংশটির ছবি এঁকেছেন।

স্বাগতা চক্রবর্তী দেখিয়েছেন ‘রয়্যাল বন্ড’! মিনিয়েচার স্টাইলে আঁকা এক রাজকীয় মহিলা এবং এক বাঘের সখ্য দেখা যাচ্ছে। এ যেন শাসনক্ষমতায় থাকা একটি মানুষ তার প্রজার প্রতি সহানুভূতিশীল। সম্পর্কের বাঁধনে কিছুটা সখ্য, কিছুটা কর্তব্যপরায়ণতা এবং সুপ্ত ভালবাসা দেখা যাচ্ছে।‌

এই প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা বাপ্পা ভৌমিকের অনবদ্য এক ছবি দেখলেন শিল্পরসিকরা। ছবির নাম ‘প্রভাবশালী যখন বাস্তুচ্যুত’! করুণ রসে সিক্ত এক ছবি। মানুষের তৈরি বেড়াজালের অন্তরে বিশাল ব্যক্তিত্বময় বাঘের মর্মস্পর্শী ছবি। ছোট ছোট টুকরো টুকরো অংশের ভিতরে অন্যান্য পশুপাখি, মানুষের অস্তিত্ব, সমাজের আচার-বিচার, ধর্মানুষ্ঠানের প্যারাডক্সের গ্ৰিডে বাঁধা এক প্রবল শক্তিশালী অস্তিত্বের এখনকার অসহায় প্রতিষ্ঠান। এটি একটি রূপকাত্মক ছবি।

সৌরভ দাসের ‘রোর ইন সাইলেন্স’ একটি ভাস্কর্য। কাঠ খোদাই করে লাল রঙে রঞ্জিত করে বাঘ গড়েছেন শিল্পী। মুখের ভিতরের দন্তরাশি যেন প্রবল শক্তির হিমায়িত রূপ। জমাট বেঁধে আছে এক মুহূর্তের আধিপত্য। হিংস্র এক স্তব্ধতার ছবি। ভারী সুন্দর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Art exhibition

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy