তাঁর ডায়েরির পাতায় ১৯৬৯ সালে শেষ লেখা ছিল— “৯ই নভেম্বর থেকে জীবনযাত্রা হয়তো মোড় নেবে, কিছুটা সচ্ছলতার আভাস পাওয়া যাবে।”... ঠিক ৯ নভেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন অশোক মুখোপাধ্যায়। ১২ নভেম্বর সব শেষ হয়ে যায়। সচ্ছলতার আভাস দেখে যাওয়া হয়নি। স্বেচ্ছায় যে ব্রত নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তার মূল্য দিয়ে গিয়েছেন। ‘ফিরে দেখা’ নিবন্ধে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন শিল্পীর স্ত্রী অণিমা মুখোপাধ্যায়। লেখাটির মধ্য দিয়ে অজানা এক মানুষকে আবিষ্কার করা যায়, প্রায় অন্তরালে থাকা একজন শিল্পীকে পাওয়া যায়।
শিল্প ও ব্যক্তিত্ব একই রেখায় দাঁড়িয়ে উচ্চারিত হয়। অথবা বলা চলে, সততা এবং নিষ্ঠার ধ্যানে অতিবাহিত হয় শিল্পের মৌলিক ভাষা। সদ্য তার প্রমাণ পাওয়া গেল গ্যালারি চারুবাসনায়। ‘রিদমস অব লাইফ’— বিস্মৃতপ্রায় চিত্রকর অশোক মুখোপাধ্যায় রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনী। উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক মন্দার মুখোপাধ্যায়। শিল্পী যোগেন চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে আয়োজিত প্রদর্শনীটির দায়িত্বে ছিলেন দেবজ্যোতি রায়।
অশোক মুখোপাধ্যায়ের ছবি নিয়ে আলোচনার আগে, শিল্পীকে জানা দরকার। শিল্পশিক্ষা প্রসঙ্গে মন্দার মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁর বাবা কলাভবনে পড়তে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বেঁচে। পুলিশের ছেলে বলে, পুলিশ বিভাগ থেকে অনুমতি পাননি। পরে জীবিকার কারণে কমার্শিয়াল আর্ট নিয়ে সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। যদিও সারাজীবন চাকরি না করে প্রাণভরে ছবি এঁকে যান।
শিল্পী অশোক মুখোপাধ্যায়ের ছোটবেলা কেটেছিল ওড়িশায়। পিতা প্রফুল্লকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন ওড়িশা পুলিশের কমিশনার। তিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে প্যারিসে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু স্বদেশের জঙ্গল, সমুদ্র ছেড়ে যেতে রাজি হননি তিনি। গঙ্গার ধারে খড়দার পৈতৃক বাড়ি ছিল আজীবন সঙ্গী। ওখানেই গড়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব ধারা।
আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে বসন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সতীশ সিংহের মতো মাস্টারমশাইদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন। অবলীলায় দু'হাতে ছবি আঁকতে পারতেন। ওড়িশার পটচিত্র, লোকশিল্প, মাইথোলজির প্রতি ছিল প্রবল ভালবাসা। শিল্পী নিজেই এক সময়ে লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘পটশিল্প একমাত্র অকৃত্রিম এবং অপ্রচলিত শিল্পধারা। কোনও ভাবে এই শিল্প আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে।’ ওড়িশার বিভিন্ন লোকচিত্র গভীর ভাবে তিনি নিরীক্ষণ করতেন। রং-রেখা এবং সূক্ষ্ম অলঙ্করণের বনেদিয়ানা, শিল্পীর মনে এক নতুন পথ তৈরি করে।
১৭৯টি চিত্রকর্ম থেকে প্রদর্শনীতে সাজানো হয়েছিল ৩৮টি ছবি। একটি বিরল পূর্বাপর প্রদর্শনী। আজীবন নিজের কাজে ডুবে থাকা সাধকের কাহিনি। বহির্জগতে মানুষ তাঁকে কতটা চিনল, জানল— সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ মাত্র ছিল না। তরুণ বয়সে তাঁর আঁকা ছবি ও কার্টুন প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি পত্রিকায়। সেই সময়ে প্রশংসিত হয় ‘দামড়ি সিং’, ‘মাদার’, ‘যিশু’, ‘বন্ধ্যা রমণী’ ইত্যাদি ছবি।
মুখের অভিব্যক্তি, জীবজন্তু, বনানী... ইত্যাদির মধ্যে জীবনের গতি ধরা পড়ে। ১৯৬০ সালে করা জলরঙের ‘দ্য জাঙ্গল র্যাবিট’, ফ্রেমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনুসারে ইয়েলো অকার, গ্রে, ক্রিমসন, ইন্ডিয়ান রেডের লেপন। ছুটে চলেছে একটি খরগোশ। পুরোটাই ইমপ্রেশন রেখে টান। আর একটি ছবি একই ভাবে মুগ্ধতা আনে, ‘দ্য সেলর’ (১৯৪৯, জলরং) বাদামি-লাল মিশ্রিত একটি ব্যাকগ্রাউন্ড। ঘর বা রেস্তরাঁর জৌলুসহীন দেওয়াল। সামান্য মুখ ফেরানো নাবিক। চোখে অসহিষ্ণুতার ছাপ। একপাশে মদের বোতল। কোনও বিশেষ রং বা ধরে ধরে কাজ নয়। মুহূর্তের অভিব্যক্তি ধরতে ব্রাশের টান ও পোঁচ— যেটুকু দেওয়ার মতো। একই ভাবে লক্ষণীয় ‘ফেস’-এর কাজগুলি। মোটা দাগের আঁচড়, একবারে ব্রাশের অনেকটা টান। স্থান বিশেষে হালকা রঙের ভলিউম।
রং-রেখা ও আলোছায়ায় পর্যবসিত কিছু কাজে পশ্চিমি রীতির ছাপ স্পষ্ট। একরঙা জমিতে বাদামি-কালোর ‘দি ব্ল্যাক গার্ল’, ‘ইয়ারনিং’, ‘দি ব্যারেন উয়োম্যান’ দু’-তিনটি টোনের জলরঙে মূর্ত হয়ে ওঠে। জলরঙের সেই মোলায়েম স্বচ্ছতা নেই। আছে রঙের প্রাণশক্তি, যা ধার করা নয়। একটু হালকা স্বাদের হলেও, সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির ‘দি ফক্স’, ‘দি চিতা’। গায়ের দাগগুলি রং ও ফর্ম অনুযায়ী অলঙ্কৃত।
ছবির আগাগোড়া মিশে আছে আত্মানুসন্ধানের স্রোত। বস্তুজাত বিষাদে একের পর এক ভাঙাচোরা মুখাকৃতি। মনে হয়, কোনও সুপ্ত ক্রোধের প্রতিচ্ছবি। ফলে ছবির দর্শনে শিল্পীকে বোঝা কিছুটা সহজ হয়। বেশির ভাগ ছবির ভাব রঞ্জিত হয়েছে হতাশা, উদ্বেগ মিশ্রিত উৎকণ্ঠায়। বাস্তববাদী বিষাদে একের পর এক ভাঙচুরের মননশীল ছাপ। তাঁর কাজের স্টাইলে বিশেষ ভাবে প্রভাব পড়েছে অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, গগ্যাঁ ও তুলুজ লোত্রেকের শৈলী।
আনুমানিক ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বম্বে, দিল্লি, ওড়িশা এবং খড়দায় নিজের স্টুডিয়োঘরে প্রদর্শনী হয় শিল্পীর। এর পর বন্ধু অক্ষয় সুরের তাগিদে তাঁর ছবির একক প্রদর্শনী হয় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে ১৯৬৫-তে।
সেই সময়ে তাঁর ছবি প্রসঙ্গে কমলকুমার মজুমদার লিখেছিলেন, ‘একজনের স্ট্রোক যে কত চাবুক হতে পারে, এ ছবিতে তার প্রমাণ আছে।’ একই গ্যালারিতে ৪২টি তেলরঙের ছবি প্রদর্শিত হয় ১৯৬৭ সালে। জীবিতকালের শেষ চিত্র-প্রদর্শনী। সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে জলরং ছাড়া ছিল গোয়াশ, কালি-কলম ও তেলরঙের কাজ। এবং ন্যূনতম রেখার দুর্লভ স্কেচ ‘গুরুদেব’ এবং ‘চ্যাপলিন’।
৫৬ বয়সের সীমারেখা নিয়ে শিল্পীর অভিজ্ঞান লক্ষ করার মতো। অশোক মুখোপাধ্যায় যে নিজের সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)