E-Paper

নৈঃশব্দ্যের ছন্দে বিমূর্ত ছন্দহীনতা

গ্যালারি আকার প্রকারে শিল্পীর যে সব ছবি দেখা গেল, সেগুলো হালুইয়ের খুব পুরনো ছবি নয়। গত তিন চার বছরে আঁকা নির্বাচিত শিল্পকর্ম।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৭:০৭
বর্ণময়: গণেশ হালুইয়ের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

বর্ণময়: গণেশ হালুইয়ের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

ভারতীয় চিত্রকলার অন্যতম প্রবীণ শিল্পী গণেশ হালুইয়ের একক প্রদর্শনী হয়ে গেল গ্যালারি আকার প্রকারে। প্রদর্শনীটির নাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘সেন্সেস উইদিন’। কবি অমিয় চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘এক সূক্ষ্ম চৈতন্যের স্তব্ধ তটে’। গণেশ হালুই এখন তাঁর ছবি সম্পর্কে বলেন যে, তিনি যা দেখেন তা আঁকেন না, যা আঁকেন সেটাই তিনি দেখেন।

১৯৩৬ সালে গণেশ হালুইয়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর গ্রামে। সরকারি কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট থেকে স্নাতক হয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে। ঠিক পরের বছরই আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া থেকে অজন্তার মুরালের ছবি আঁকার কাজটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব গণেশ হালুইয়ের উপরে ন্যস্ত করা হয়। সাত বছর ওখানে কাটিয়ে অজন্তার অসংখ্য ড্রয়িং করেছিলেন। এ ছাড়াও গ্রামের লোকেদের সঙ্গে, মজুর সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সময়ে তাঁদের বহু প্রতিকৃতি এবং নানা ধরনের ছবি আঁকা সম্পন্ন করে ফেরার পরে সরকারি আর্ট কলেজে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হন এবং সেখানেই অবসর নেন।

গ্যালারি আকার প্রকারে শিল্পীর যে সব ছবি দেখা গেল, সেগুলো হালুইয়ের খুব পুরনো ছবি নয়। গত তিন চার বছরে আঁকা নির্বাচিত শিল্পকর্ম।

এর আগের নানা ছবিতে ছেলেবেলায় দেখা খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে শিল্পীর ছোটবেলার জামালপুরের স্মৃতি খুব উজ্জ্বল ভাবে ধরা পড়েছিল। আঙিনায় ঢুকে আসা বন্যার জল, চারদিকে প্রকৃতির সবুজের ব্যাপ্তি, নিসর্গকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে সেই কিশোর প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শিখেছিল। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মানুষটির মানসপটে পশুপাখির স্মৃতি এবং প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের স্মৃতিটুকু সম্পূর্ণ ভাবে ধরা ছিল। শিল্পী যে ভাবে প্রকৃতিকে দেখেছিলেন ঠিক সেটাই চিত্রপটে উঠে আসেনি। বরং তার সঙ্গে নিজের মনের মাধুরী মেশানো এক অনবদ্য চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে।

এই প্রদর্শনীতে যে সব ছবি দেখা গেল, সেগুলির ভাষা অন্য রকম। বক্তব্যও অনেক পাল্টে গিয়েছে। ছবিতে অনেক নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে। যে সমস্ত উপাদান ছবিতে তুলে এনেছেন, সেগুলোর সঙ্গে দর্শকের যেন মনে মনে একটা কথোপকথন চালু থাকে। যে রকম প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চেতনার একটা সংযোগ তাঁর ছবিতে অনবরতই পাওয়া যায়।

হালুই ছবিতে মোটামুটি আলোক-অভেদ্য (ওপেক) এবং অর্ধস্বচ্ছ ( ট্রান্সলুসেন্ট) গোয়াশ রঙের ব্যবহারে অপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস বাতিল করে শুধু মূল, জরুরি কথাটাই বলতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে বিমূর্ত। ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া ভূদৃশ্য এবং তার সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ, প্রকৃতির গোপন রহস্যের মিশ্রণে কাগজে উঠে এসেছে অনবদ্য সব ছবি। সেখান থেকে মানুষ সরে যেতে পারে না, শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। নিজের ছবিকে আলাদা করে মূর্ত বা বিমূর্ত আখ্যা তিনি দিতে চাননি, কারণ সে দু’টি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে তাঁর বেশির ভাগ কাজেই।

প্রদর্শনীতে যে সব ছবি দেখা গেল, সেখানে কিছুটা যেন সভ্যতার সঙ্কটের সঙ্কেত দেখতে পাওয়া গেল। প্রকৃতির উপরে মানুষের আগ্রাসনের রং পাল্টে দিয়েছেন। প্রকৃতির কোলে নানা টোনের সবুজের প্রাধান্য, তার সঙ্গে অন্য রকম হলুদ, খয়েরি এবং কালো রঙের প্রাধান্যে মানুষের আবাসন দেখিয়েছেন। একটা ছবিতে দেখা গেল, মাটির তলায় গাঢ় নীল জলের স্তর, তার উপরে প্রকৃতির মোলায়েম সবুজ এবং তার উপরে সভ্যতার বিশাল ভারী টারবাইন-উপস্থিতি ওদের যেন পিষে ফেলছে।

আর একটি অনবদ্য ছবিতে দেখা গেল ধ্বংসের পূর্বাভাস। মস্ত একটা বনস্পতি টুকরো টুকরো হয়ে মূলসুদ্ধ উপড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে। এখানে যেন আশ্রয় নেই। বাড়ি ভেঙে পড়ছে। সভ্যতার ভাঙনের প্রতীক। অসাধারণ একটি ছবি। কিন্তু এত হতাশার মধ্যেও শিল্পী দেখিয়েছেন আশার আলো। কোথাও একটু নীল আকাশের ছোঁয়া, হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, সুসময় আসবে।

আরও একটি অসাধারণ মোনোক্রোম্যাটিক ছবি, যেখানে সাদা কাগজে শুধুই কিছু গাছের ছবির বিমূর্ত ড্রয়িং। গাছগুলি কবিত্বে ভরা। ওদের মধ্যে যেন পলি পড়েছে এবং তার পেলব ছাপ অনুভবও করা যায়। কিন্তু তারা আজ মানুষের লোভের মুখে পড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায়, আকাশভরা ওদের কান্নার নৈঃশব্দ্য। এই ছবি আঁকা হয়েছে কালি তুলির সাহায্যে।

অপর একটি কালি তুলির ছবিতে শিল্পী দেখিয়েছেন নিসর্গ প্রকৃতির উপরে মানুষের সভ্যতার বলাৎকার। ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ওরা যেন আর্তনাদ করছে। এই দু’টি ছবিই ২০২২ সালে আঁকা। এর পরবর্তী ছবিগুলিতে গণেশ হালুই প্রধানত নেপালি কাগজে গোয়াশ রং ব্যবহার করেছেন।

মূল কথাটা ধরতে গিয়ে শিল্পী যেন প্রকৃতির অন্তরাত্মার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পেরও নাভিবিন্দুতে পৌঁছতে চেয়েছেন। তার গত কয়েক বছরের ছবি উজ্জ্বল এক বর্ণময়তা নিয়ে দর্শকের সামনে এসেছে। এই ছবিগুলি প্রধানত গোয়াশে আঁকা আর এই বিশেষ গোয়াশ কিন্তু শিল্পজগতে শিল্পী গণেশ হালুইয়ের নিজস্ব এক অবদান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Artist Ganesh Haloi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy