E-Paper

আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে

শিল্পীর ১৬৫টি ছবি এবং কিছু লেখা নিয়ে এক মনোজ্ঞ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল গ্যালারি সংস্কৃতি।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ০৭:২০
চিরকালীন: শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

চিরকালীন: শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

শিল্পী ও সাধক রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতি ও মানবজাতির সহজাত রূপ তুলে ধরে নিজের দেশ চিনিয়েছেন। শহরের জটিলতা তাঁকে এতটুকু গ্রাস করতে পারেনি। জনাকীর্ণ কোলাহলে বাস করেও মগ্ন হয়ে যান গ্রামের পরিবেশে। তিনি কিংবদন্তি এক শিল্পী। গীতিকবিতার মতোই তাঁর প্রতিটি ছবি আবেশ ছড়িয়ে দেয়। নির্মাণ-মহিমার সরল ছন্দে আশ্বাসভূমি তৈরি করেন।

“আমার ছবিরা কেউ অক্ষম নয়। সবাই সহজ, সরল, সাবলীল। আসলে ছবি সচল হলে, মনে প্রাণ আসে। ছবির শক্তি এমনই হয় যে, দর্শককে খানিক দাঁড় করিয়ে দেয়।... আমায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ছবি আঁকো কেন?’ এর উত্তর হয় না। ছবি হল ঝরনা।” শিল্পীর এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ ছিল তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর দেওয়ালে। চমৎকার উপলব্ধি!

শিল্পীর ১৬৫টি ছবি এবং কিছু লেখা নিয়ে এক মনোজ্ঞ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল গ্যালারি সংস্কৃতি। ১৯৯০ সালে রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্যালারিতেই প্রথম একক প্রদর্শনী করেছিলেন। এখন তিনি নব্বই। স্বাভাবিক নিয়মেই বয়সের ভারে চলা মুশকিল। তবুও শিল্পীর উপস্থিতি এবং কালজয়ী ছবির সঙ্গে পুনর্মিলনের শোভা ছিল আন্তরিক।

প্রদর্শনীর নাম ‘সম্বন্ধ— অ্যাফিনিটি উইথ লাইনস অ্যান্ড কালার্স’। রেখা এবং রঙের সঙ্গে সখ্য। স্বজ্ঞাত অনুসন্ধানে সম্বন্ধের প্রকৃত আনন্দের সৃষ্টি। সরলতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নিবেদন জানিয়েছেন তিনি বারবার। ললিতরেখার স্বাধীনতায় গড়ে ওঠে ছবির পর ছবি। যেমন কোমল টানে উপচে পড়ে ‘মা-ছেলের বাৎসল্য রস’, ঘরের দাওয়ায় বসে মায়ের পুত্রকে পড়ানো। সঙ্গী দুই সবুজ পাখি। অল্প রেখার জাদুর কী মায়া! গোটা ছবিতে ড্রাই প্যাস্টেলের হলুদ গুঁড়োর লেপন। ডান দিক ধরে সামান্য কমলা আভা। হাতের তালু দিয়ে আলতো করে ঘষে ঘষে বুলিয়ে দেন। এতে ট্রান্সপেরেন্ট এফেক্ট আসে। প্রয়োজন অনুযায়ী হাইলাইটার ব্যবহার করেন।

আর একটি ছবির অনুভূতি প্রকাশ না করলেই নয়। প্রেক্ষাপট একটু গাঢ় হলুদ। বাদামি গুঁড়ো রেখার ফ্রেমবন্দিতে তিনটি ফিগার— প্রসূতি, সদ্যোজাত শিশু কোলে ধাইমা। প্রসববেদনার অবসানে যে ক্লান্তি ও শান্তি তার অত্যন্ত মরমি প্রকাশ। কতটা সমবেদনা ও শ্রদ্ধা থাকলে একজন শিল্পীর সৃষ্টি এই পর্যায়ে যেতে পারে! আছে দুই সখী বা সহকর্মীর সবুজ রেখার আলাপন। দুই নারীর গোপনে কথা বলা। ছবিগুলি শুধু রেখা বা ঘষে দেওয়া রঙের কথাই বলে না, উঠে আসে জাগতিক অভিব্যক্তি। বিস্ময় জাগে, পটের এক দিক যেমন আয়োজনে ভারী, অন্য দিকের খালি অংশ জুড়ে একটি বা দু’টি উপকরণ। বস্তুগত সাপোর্ট না থাকলেও, মনে হয় না শূন্যতায় ভরা ছবি, এতটাই রেখা ও রঙের ব্যালান্স। কোথাও দুঃখ, বেদনার ছায়া নেই। আড়ম্বরকে এতটুকু প্রশ্রয় না দিয়ে, মৃদু রেখার লালিত্য আর সামান্য রঙের ছোঁয়ায় আনন্দের পরিবেশ তৈরি করেছেন।

শিল্পী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে চরিত্রও তৈরি করতে হয়, তার দুর্লভ প্রমাণ রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। জোনাকির আলোর মতোই যে কোনও পরিস্থিতিতে তাঁর ছবি, ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করে। ‘চিত্রকরের রোজনামচা’য় তিনি বলছেন, ‘ত্যাগের দীক্ষা না নিতে পারলে, পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। ত্যাগ হল নিজেকে সঠিক রাখার এক বিশেষ সঞ্চয়’।

গ্রামবাংলার নরনারী, বৃক্ষরাজি, পশু-পাখি সুষমামণ্ডিত হয়ে উঠেছে বর্ণিকার সাধনায়। রৈখিক বাঁকের নমনীয় গুণ অনুসরণ করে দৈনন্দিন জীবনের সূক্ষ্ম ভঙ্গি, স্নেহ, প্রেম দর্শক প্রাণ ভরে দেখে। শিল্পী নিকটজনের মতো লালনপালন করেন। তার যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায় বাদামি আলোছায়ায় নারী ও বাছুরের ভাব বিনিময়ে। পুকুরঘাট না দেখিয়েও কয়েকটি টানে পিছন ফিরে নিপুণ ভঙ্গির নারী, কলস ও পাখি। ছবিতে পাখির ভূমিকা প্রায়ই অনিবার্য প্রাণের স্পন্দন হিসেবে এসেছে। যেমন বাদামি ও ইয়েলো অকারের ঘুমন্ত রমণীর বিশ্রাম, উপবিষ্ট নারীদলের ছায়া, প্রতিচ্ছায়া, আবার কন্টুরের মজবুত আঁচড়ে চরম আধুনিকতা। ছবিতে বাংলার লোকশিল্প এসেছে। যেমন গৃহবধূর শিষ্টাচার, বাগানে এসে পড়া কমলা রোদে দুই সখীর সান্নিধ্য। নিছক ছবি তো নয়, গ্লানি, উদ্বেগ দূর করার চিত্ররূপ এক প্রলেপ যেন।

প্রদর্শনীতে শোভিত ছিল কিছু সামান্য পুরু কালি দিয়ে মানব-মানবীর বিবিধ ভঙ্গি। এক একটি রচনা, এক একটি আখ্যান। এ ভাবেই শিল্পী আমাদের দেশ চেনান। চেনান আদিবাসী, বাউল, সাধু-সন্তদের। হিন্দু-পুরাণের দেবদেবী অধিষ্ঠিত হয় ঘরের একজন হয়ে।

শিল্পী রামানন্দর জীবন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এ বিষয়ে বহু মানুষই জ্ঞাত। ‘বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট’-এর ঘরানায় তৈরি তাঁর কাজ। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে নন্দলাল বসুর অনুগত ছাত্রই শুধু নন, সুযোগ্য উত্তরসূরি তিনি। এ প্রসঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ে যায় শিল্পীর। ছোটবেলায় মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমায় আর্টিস্ট হতেই হবে’। তখন গ্রামে থাকতেন তাঁরা। ছোটবেলায় দেওয়ালে ছবি আঁকতেন। রং ছিল না। তাঁর মা পানের বাটা থেকে খয়ের, হলুদ বাটার হলুদ দিয়ে রং করার জন্য উৎসাহ দিতেন। পরবর্তী কালে কলাভবনে নন্দলাল বসু ছাড়াও পেয়েছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেজ, গৌরী ভঞ্জর মতো গুরুদের।

আজও অশক্ত শরীরে, অনায়াস রং-রেখায় ধ্রুপদী সুর আনেন রামানন্দ। নিভৃতে দিনের অর্চনা শুরু করেন এ ভাবেই। চিত্রকল্পের ঐতিহ্যের মতোই উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে শিল্পীর সিগনেচার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy