Advertisement
E-Paper

বাবা-বাবা খেলা দিয়েই হয়েছিল আমার ট্রেনিং

জাদুকর প্রতুলচন্দ্র সরকার। পি সি সরকার। কেমন ছিলেন মানুষটা? গল্পের ঝুলি উপুড় করলেন তাঁর ছেলে প্রদীপচন্দ্র সরকার।জাদুকর প্রতুলচন্দ্র সরকার। পি সি সরকার। কেমন ছিলেন মানুষটা? গল্পের ঝুলি উপুড় করলেন তাঁর ছেলে প্রদীপচন্দ্র সরকার।

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
জাদুকর প্রতুলচন্দ্র সরকার।

জাদুকর প্রতুলচন্দ্র সরকার।

রূপকথার মানুষটা, যে নাকি স্টেজের মধ্যে কী না কী করছে, তারও যে আবার পায়ে ব্যথা হয় বা বাড়িতে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উরুটা চেপে ধরে বলতে হয়, ‘উফ’, তার সাক্ষী আমি।

বাবাকে আমি খুব ভালবাসতাম। যখন খেয়েদেয়ে বিছানায় শুতেন, কয়েক মিনিট আমার জন্য বরাদ্দ থাকত। আমার নাম বা আমার জন্য নয়, আমার সৌভাগ্যে। বাবা শুয়ে আছেন, হয়তো একটা পত্রিকা পড়ছেন বা মা’র সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু পা-টা তো খালি। আমি টিপে যাচ্ছি। একটা সময়ে বাবা ঘুমিয়ে পড়তেন। বুঝতে পারতাম। আলতো করে, আস্তে আস্তে, হাতটা তুলে নিতাম। নইলে ঘুমটা ভেঙে যাবে।

বাবা মারা গেলেন জাপানে। ওঁরা আমার জন্য কফিনের ডালাটা বন্ধ করেননি। গিয়ে দেখি বাবা ঘুমিয়ে আছেন। যেন একটা খোলস ঘুমোচ্ছে। শুকনো আগ্নেয়গিরি। পা টিপলেও কিছু হবে না, হাত সরিয়ে নিলেও না।

হঠাৎ মনে হল, আমার কানে কে একটা হাত রাখল।

বাবা আমার কান ধরতে ভালবাসতেন। বকুনির জন্য নয়। উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য, পিছন থেকে খপ করে ধরতেন। কী মিস করি!

কাজে মগ্ন

তো, ঠিক সেই ভাবে যেন কানটা ধরল কেউ। বুঝতে পারলাম, খাপের থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। বলেছিলাম, “তুমি তো পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেছ। তোমার কোনও শরীর নেই। ফেলে দিয়েছ। কেন ফেলে দিয়েছ, জানি না। জামাটা তো ভালই ছিল! আমরা খুব ভালবাসতাম। কিন্তু তুমি যে একটা অভাবে আছ, আমি জানলাম।” আমি মেলে ধরলাম আমার শরীরটা, “এসো। গ্রহণ করো।”

কেমন যেন ভারী হয়ে গেলাম। বললাম, “শো শুরু করুন। আমি আসছি, জামা পরে।” সেই যে শো শুরু হল, এখনও চলছে।

আর চলবেও।

রূপকথাকে স্পর্শ করেছি আমার বাবার মধ্য দিয়ে। আর তার জন্য আমি গর্বিত।

বাবার সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত দেখা হয়। স্পর্শ করতে পারি না। বাবা হাত বাড়িয়ে দেন। আমিও হাত বাড়িয়ে দিই। আয়নার ওপারে। আমি আমার বাবা। আমিই তিনি। উপনিষদ পড়ছিলাম। ব্রহ্মের কথা লেখা রয়েছে। ও মা! দেখি আমার বাবার কথাটাই লিখে দিয়েছে— বাবাকে সৃষ্টি করা যায় না, ধ্বংস করা যায় না, বাবাই বাবাকে তৈরি করেন।

আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। যদি বাবা নামক জিনিসটি ঈশ্বর হয়ে থাকেন। আমি বলেছি, “ঈশ্বর, তুমি আমাকে যতটা বিশ্বাস করো, আমিও তোমায় ঠিক ততটাই বিশ্বাস করি। তোমার আমাকে যেমন প্রয়োজন, আমারও তোমাকে সে রকম প্রয়োজন। সুতরাং, হ্যান্ডশেক করো।”

ঈশ্বর হ্যান্ডশেক করেছেন। আমার বাবার মাধ্যমে।

অথচ, ছেলেবেলায় বাবা আমার সঙ্গে কোনও দিন হ্যান্ডশেক করেননি।

আমার ছিল দুটো বাবা। দুটো আলাদা লোক। একজন পি সি সরকার। পিসি সরকার সিনিয়র। স্টেজে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। একবার একটা বাচ্চা উঠে এল দর্শকাসন থেকে। বাবা তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। আমার খুব হিংসে হল। মাকে এসে দুঃখ করেছিলাম।

সেই লোকটাই আবার বাড়িতে এসে আমায় অঙ্কের পড়া ধরবে। মানায় কখনও? একদিন তো আমাকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন। সেই নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলাম, পুরোটা মনে নেই।

ব্যাপারটা কী? আমি বই খুলে বসে আছি। মা দেখে গিয়েছেন আমার চোখ বইয়ের দিকে। আর তাতেই সন্তুষ্ট। এ দিকে বাবা দেখে গিয়েছেন, কত নম্বর পাতাটা খোলা। আধঘণ্টা পর এসে দেখেন, তখনও তাই। অমনি ধমক। সেই সময়ে বাবাকে অতটা ভালবাসতাম না। শুধু বকে। “খালি পায়ে হাঁটছ কেন? যাও চটি পরো।”

আমি ভালবাসতাম পি সি সরকারকে। রংচঙে জামা পরেন। কত মজার মজার কাণ্ড করেন। হাওয়ায় ভাসতে পারেন। অন্যকে ভাসাতে পারেন। গাড়ি অদৃশ্য করে দেন। কত কিছু!

আমার তখন একটাই বিস্ময়, বাবা কী করে পি সি সরকার হয়? বা পি সি সরকার কী করে বাবা হয়? মা বলতেন, “তোমার বাবা সেজেগুজে স্টেজে গিয়ে পি সি সরকার হয়ে যায়।” আমার বিশ্বাস হতো না। বা বিশ্বাস করলেও অস্বস্তি হতো।

ক্লাস সেভেন। স্কাইলাইটের জানালা দিয়ে বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে শুরু করলাম।

দেখতাম, দলের অন্যদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বলছেন, “এই স্টেজ। এটা আমার পজিশন। তোমার পজিশন এই। ঠিক এইখানে টেবিলটা। আমি যখন সরাতে বলব, তুমি সরিয়ে এ ভাবে পিছিয়ে আনবে। এ দিকে না। এই দিকে।” কেউ দেরি করে বুঝছে। তাঁকে ধমক দিচ্ছেন। বাবা নিজের সহকারীদের শেখাচ্ছেন আর শিক্ষাটা আসলে আমার হচ্ছে।

বাবা যে ঘরে কাজ করতেন সেখানে অন্য কারও ঢোকা বারণ ছিল। হয়তো লিখতে লিখতে উপরে ডাক এল, কলমটা রেখে চলে গেলেন। তখন কেউ যদি এসে খাতাটা ভাঁজ করে দিয়ে যায়, তা হলেই সর্বনাশ! তাল কেটে যাবে। সেই জন্য ঘর থেকে বেরনোর আগে বাবা তালা দিয়ে দিতেন।

বাবা যখন বেরিয়ে যেতেন, সহকারীরাও কেউ নেই, আমি আস্তে আস্তে ঘরটায় ঢুকতাম। আসলে আবিষ্কার করেছিলাম, অন্য একটা ঘরের চাবি দিয়ে ওই তালাটা খোলা যায়। চুপিচুপি সেখানে ঢুকে আমি ‘বাবা-বাবা’ খেলতাম। কল্পনা করতাম, অমুক সহকারী এখানে। তমুক সহকারী ওখানে। অমুক বুঝছে না, আমি ধমক দিচ্ছি, “দেখছ না এটা? দ্যাখো, আমি এ রকম ভাবে করব।”

এই ভাবে আমার ট্রেনিং।

প্রায় আড়াই বছর পর এল দিনটা। একজন সহকারী হঠাৎ বেঁকে বসলেন। বললেন, বেশি টাকা চাই। না হলে শো করবেন না।

বাবা বললেন, “বেরিয়ে যাও। লাগবে না। ম্যাজিকের মধ্যে বোঝাপড়াটাই বড় কথা। সেটাই নষ্ট করে দিয়েছ। তোমাকে আমি ভরসা করতে পারব না।”

স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে প্রতুলচন্দ্র সরকার

সে দিন বাবাকে প্রথম সিগারেট খেতে দেখেছিলাম। বুঝলাম, আমার আলমারির উপর থেকে নেমে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। সোজা ঘরে ঢুকে পড়লাম। ওই অবস্থায় বাবা আমাকে দেখে খেপে উঠলেন।

বললেন, ‘‘তুমি এই ঘরে কেন?’’

ভয়ে ভয়ে জবাব দিলাম, ‘‘আমি সব দেখেছি বাবা। ওই জানালাটা থেকে।’’

বাবা খেয়ালই করেননি ওখানে জানালা রয়েছে। বললাম, ‘‘বাবা, ওদের পার্ট আমি রোজ করেছি। আমি পারি।’’

বাবা বললেন, ‘‘ধ্যাৎ! কী বলছিস!’’

করে দেখিয়ে দিলাম। আমার ট্রেনিংয়ে কোনও গলদ নেই। আমার গুরু পি সি সরকার।

কয়েক দিন পরে নিউ এম্পায়ারে শো। দর্শক হাততালির ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। বাবা আড়চোখে তাকাচ্ছেন আমার দিকে।

বাবার মৃত্যুর পর আমি ফিরেছি। অনেক দিন কেটে গিয়েছে। এসে দেখি, মা সাদা থান পরে আছেন। ও ভাবে মাকে দেখতে অসহ্য লাগল। মা আমার মুখ দেখে বুঝতে পারলেন প্রশ্নটা। মা’র
চোখে জল নেই। বললেন, “জল ফুরিয়ে গিয়েছে।” অনেক কথা বলেছিলেন সে দিন। বাবা-মা’র বিয়ের গল্প।

বাবা তখন অচেনা একটা পেশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কী, নাকি ম্যাজিক করবেন!

তাঁর সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট প্রমথনাথ মজুমদারের বড় মেয়ে বাসন্তীদেবীর বিয়ের সম্বন্ধ। বিয়ের দিনই একজন বলেছিলেন, “মাইয়াডার গলায় দড়ি বাইন্ধ্যা, পাথর বাইন্ধ্যা কুয়াতে ফ্যালাইয়া দিলেন! ডাক্তারবাবু, এডা আপনি কী করলেন?” ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, “আমি তো ডাক্তার, নাড়ি টিপে ভিতরটা বুঝি। প্রতুলকে স্পর্শ করে বুঝে গিয়েছি, ভিতরটা কী! পরে বুঝবে।” সমাজও বুঝেছে। দেখেছি, বাবার সমস্ত কাজের অনুপ্রেরণার পিছনে যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, আমার মা।

আমি সদ্যোজাত, এ পার বাংলায় এলাম। দাঙ্গা লেগেছে। শুনেছি, আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে অনেক হত্যালীলা। বাবা অনেক কষ্ট করে একটা বাড়ি ভাড়া পেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে। একটা মাত্র ঘর, পুরো পরিবারের জন্য।

তার পর? ম্যাজিক! কপর্দকহীন পি সি সরকার, এক বছরের মধ্যে বাড়ি করলেন। যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ছুঃ! বাড়ি হয়ে গেল! বালিগঞ্জে। ফুঃ আবার একটা বাড়ি! অন্য কোনও ব্যবসা নেই। ম্যাজিক দেখিয়ে, মানুষের মনোরঞ্জন করে, টিকিটের পয়সায়। ট্যাক্স মিটিয়ে। বাবা কারও তাঁবেদারি করেননি কখনও। কারও তোয়াক্কা করেননি।

দেশভাগের সেই সময়টায় বাবা ম্যাজিক করছেন, ব্যাপারটা ঠাকুরদার পছন্দ ছিল না। ম্যাজিক আমাদের রক্তে। ঠাকুরদাও ম্যাজিক করতেন। ঠাকুরদার বাবাও ম্যাজিক জানতেন। কিন্তু দেখাতেন না। বলতেন, ম্যাজিক জানাটা এক জিনিস। কিন্তু দেখাতে হলে দর্শককেও শিক্ষিত হতে হবে। নইলেই মুশকিল। ম্যাজিককে চট করে লোকে তুকতাক, ভূতপ্রেতের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পারে। সেটা হলে কুসংস্কারকে তোল্লাই দেওয়া হয়। ঠাকুরদা বলতেন, “খুব সাবধানে চলতে হবে। ম্যাজিক শুধু মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য। শিক্ষার জন্যও। কিন্তু কোনও মতেই ‘বাবাগিরি’ চলবে না।”

বাবার সেই কথা মনে রেখেই অনেক বাবাজিকে হাওয়া করে দিয়েছি! সেটা আমার কৃতিত্ব নয়, বরং দুঃখের কারণ। ওঁরা ধর্মের এত সুন্দর দর্শনকে বিকৃত ভাবে ছাইভস্ম করে দিচ্ছিলেন। আর ভারতচন্দ্র তো কবেই বলে গিয়েছেন, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই...’ সেই কথা মেনে, ওই বাবাদের ছাইগুলো উড়িয়ে অমূল্য রতন পেয়েছি। পেয়ে গিয়েছি কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের মূল মন্ত্র।

সেটা হল ম্যাজিক। ম্যাজিক দেখাও। দেখিয়ে বলো, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করবেন না। গুরু, বাবাটাবা তো বটেই, আপনার নিজের চোখকেও বিশ্বাস করবেন না। চোখ একটা ক্যামেরা। ক্যামেরা দিয়ে যেমন কারসাজি করা যায়, চোখ দিয়েও সে রকম ভুল দেখানো যায়। ভুল ভাবানো যায়।

বিজ্ঞান যত এগোচ্ছে, মানুষও বুঝছে। ম্যাজিকের রূপকথার জীবন আর বাস্তব জীবন এক হয়ে যাচ্ছে। কাল যেটা ছিল রূপকথা, আজ সেটাই গতানুগতিক। দর্শকও যে বদলাচ্ছে সেটা টের পাই শোয়ের পরে।

একটা সময় ছিল, যখন ম্যাজিক দেখে এসে প্রণাম করতে চাইত লোকজন। পরে একটা সময় এল, অটোগ্রাফের। এখন সেটাই হয়ে গিয়েছে সেলফি-র।

বাবার একটা বিখ্যাত খেলা ছিল। স্টেজ থেকে অদৃশ্য হয়ে দর্শকের মধ্যে হাজির হতেন। সেটা তো আর কোনও মন্ত্রে হওয়ার নয়, বাবাকে হেঁটেই আসতে হতো। স্টেজের মধ্যে তখন একজন ডামি বাবার পোশাকটা পরে ঠেকনো দিতেন। দর্শক এত তন্ময় হয়ে দেখতেন যে, খেয়াল করতেন না।

বাবা অসমের এক জায়গায় শো করতে গিয়েছেন। আমি তখন সহকারী। শো শেষ হওয়ার পরেও টুকটাক কাজ থাকে। সে সমস্ত সেরে দোকানে চা খাচ্ছি। দেখি কতকগুলো স্থানীয় ছেলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, “জানিস, পি সি সরকার এখান দিয়ে যায়! ওই যে, ওটা ডামি। আজ আমি ধরব। তোরা আয় আমার সঙ্গে। দেখি কী করে বলে, ‘আই অ্যাম হিয়ার’!”

শুনে তো আমার চা খাওয়া মাথায় উঠেছে! ওরা ঠিকই বলেছে। বাবাকে গিয়ে বললাম। পাত্তা দিলেন না। বললেন, “ও রকম অনেক বলে। আসলে কিছু করে না। আমি অনেক ফেস করেছি। তোমার চিন্তা নেই।”

বাবা আমার কথা শুনছেন না, বুঝছেন না। একটা কিছু করতে হবে!

ওই ছেলেগুলো শুধু জানে পি সি সরকার কোন রাস্তা দিয়ে যান। কখন যাবেন, সেটা জানে না। আমরা নিখুঁত সময় জানি, বাজনার মধ্যে ঠিক কোন সময়টা। আমি ড্রেসিংরুমে গিয়ে বাবার একটা পোশাক গায়ে চড়ালাম। অন্ধকারের মধ্যে বাবার আগেই, বাবাকে না বলে লাগালাম হাঁটা।

যথারীতি ছেলেগুলো খপাত করে আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। নিয়ে গেল বাগানের মধ্যে। কয়েকটা কিল, ঘুসিও পড়ল পিঠে। আমার মুখ চেপে ধরে আছে। এমন সময় চিৎকার। আসল পি সি সরকার দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছেন, “আই অ্যাম হিয়ার। আমি এখানে।”

ওরা থ! তা হলে এটা কে? আমাকে ছেড়ে দে দৌড়। ওরা সে দিন জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাজিক দেখেছিল। আমিও সবচেয়ে বড় ম্যাজিকটা দেখিয়েছিলাম। বাবাকে বলার পরে বকুনিও খেয়েছিলাম, আদরও। বাবা পরে অনেককে গর্ব করে বলতেন ঘটনাটা।

কয়েক মাস আগে আমরা উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে শো করতে গিয়েছিলাম। ঝমঝম করে টানা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেও লোক এসেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। এত শান্ত অডিটোরিয়াম সচরাচর দেখা যায় না। অথচ পরদা ওঠার পর দেখি ঠাসা লোক। চুপ করে সবাই প্রতীক্ষা করছেন, কখন শো শুরু হবে। টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ। ভিতরে বারোশো লোক। তাঁরা বৃষ্টিকে সুযোগ দিচ্ছেন কথা বলার। যেই পরদা উঠল, আমি এলাম, ওঁদের মধ্যে প্রাণ ফিরে এল। তাকিয়ে দেখি, মাই গড! বারোশোখানা বাবা। সব বসে আছে আমার বাবা! কী হাসিমুখ! প্রোগ্রাম জমবে না তো কী?

এ প্রসঙ্গে আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমেরিকায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে সব সাহেব দর্শক। তাঁদের মধ্যে একজন সাহেব বাংলা জানতেন। সেখানে বাবা আমাকে টুকটাক নির্দেশ দিচ্ছেন। আর কেউ না বুঝলেও সেই বাংলাজানা সাহেব ঠিক বুঝতে পারছিলেন যে, বাবা আমাকে কী বলছেন। এ ভাবে তিনি অনেক গোপন কথা বুঝে যাচ্ছিলেন। আমি ওঁর চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছি যে, উনি বাংলা জানেন।

অন্ধকারে ঢিল ছুড়লাম। জাপানি ভাষায় বাবাকে বললাম যে, ওই লোকটা বাংলা জানেন। সব বুঝতে পারছেন। বাবাও জাপানি ভাষায় বললেন, তাই নাকি! এ বার দেখলাম, ওই সাহেবের চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। উনি জাপানি জানতেন না!

এ রকম অনেক খেলা খেলেছি আমরা। ভাষা নিয়ে খেলা। বাবা বহু ভাষা জানতেন। আমি বাবাকে সাবলীল ভাবে ফরাসি বলতে শুনেছি। রাশিয়ায় গিয়ে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতে দেখেছি।

বিদেশে বাবার শোগুলোতে খুব মজা হতো। বাবা কথা বলতেন সেই সমস্ত দেশের ভাষা আর বাংলা মিলিয়ে। স্টেজে নির্দ্বিধায় বাংলা বলতেন গড়গড় করে। আমিও তাই করার চেষ্টা করি। রাশিয়ায় গিয়ে বাংলা বলেছি। কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে গিয়েছি তো!

এক বার উত্তরপাড়ায় শো করলাম। আমি মহাজাতি সদনে শো করতে পারছি না। মেরামতির কাজ চলছিল। হঠাৎ দেখি, আমার মধ্য থেকে কে যেন কথা বলে উঠল। দেখি বাবার গলার আওয়াজ, ‘‘তুই কোনও একটা নির্দিষ্ট হলে যাবি কেন? বরং সব জায়গায় ম্যাজিক দেখানোর মঞ্চ তৈরি কর।’’

বাবার কথায় আর আশীর্বাদে সাহস পেয়ে উত্তরপাড়ায় তৈরি করলাম ম্যাজিকের নতুন মঞ্চ। সেই একই প্রোগ্রাম। কিন্তু উচ্ছ্বাসের কোনও কমতি নেই। একই রকম কলরব। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শকদের দাবি, আরও শো বাড়াতে হবে।

তার পর আবার দেখি কে যেন আমার জামা ধরে টানছে... ‘‘ম্যাজিক দেখানোর মঞ্চ কি শুধু কলকাতায় হবে? আমাদের বোম্বেতে হবে না? পুণেতে হবে না? মাদ্রাজে নয়? বা দিল্লি? সেটাই বা বাদ যায় কেন!’’

আমি বললাম, ‘‘হবে! হবে!’’

তার পর তো ম্যাজিক! বাবার শেখানো সেই ম্যাজিকের হাত ধরে আর কোনও একটা শহরের কোনও মঞ্চে নয়। বরং বলা যায়, শহর-গ্রাম-রাজ্য-দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র তৈরি হল স্বপ্নের মঞ্চ।

দর্শকদের অকুণ্ঠ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা ছাড়াও বাবার ঝুলিতে অনেক সম্মান! পেয়েছিলেন ‘দ্য স্ফি‌ংস’, যাকে বলে ম্যাজিকের দুনিয়ার অস্কার। ১৯৬৪ সালে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করা হয় বাবাকে। ভারত সরকার বাবার নামে তৈরি করেছে ‘জাদুসম্রাট পি সি সরকার সরণি’। বাবা আসলে সম্রাটই ছিলেন। নিছক বাস্তব দুনিয়ার নন, ইন্দ্রজালের সম্রাট তিনি!

শিক্ষাগত দিক দিয়ে অঙ্কে স্নাতক হলেও আমার বাবা আসলে ছিলেন ম্যাজিকঅন্তপ্রাণ। আর তাই তো তিনি ইন্দ্রজালের স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন আমার মধ্যে।

এরিয়াল সাসপেনশনের থিয়োরিতে তৈরি ভেসে থাকা মহিলা অর্থাৎ ‘ফ্লোটিং লেডি’র মতো ম্যাজিক তো বাবার হাত ধরেই এসেছিল। কলকাতা আর জাপানে নিয়মিত শো করা ছাড়াও বাবা যে ভাবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় ইন্দ্রজালকে তুলে ধরেছিলেন, তা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব।

মায়ের কাছে শুনেছি, আমি কলামন্দিরে শো করছিলাম। বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। তার কয়েক দিন আগেই আমি সেই বাক্সবন্দি হয়ে সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার খেলাটা দেখিয়েছি। বাবা একটু ভাবের ঘোরে ছিলেন। বাড়ি ফেরার পর মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেমন লেগেছে? বাবা বলেছিলেন, “এ বার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।”

তার দু’মাস পর বাবা মারা যান। যদি আমি আগে জানতে পারতাম, আমি সে দিন একেবারে বাজে প্রোগ্রাম করতাম। জঘন্য, যাচ্ছেতাই প্রোগ্রাম করতাম।

‘বাবা’ নামের ফেনোমেনন, বাবা মানুষটাকে আমি দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে পারি না। তিনি এতই বিশাল। তিনি হিমালয় পর্বতমালার মতো। বাবা আমার কাছে আদর্শ, স্বপ্ন, রূপকথা, ভবিষ্যৎ... আমার সমস্ত কিছু। বাবার বাইরে আমি কিচ্ছু নই। আমি যা শিখেছি, আমার বাবার কাছে শিখেছি। বাবা যে আমার নাম প্রদীপচন্দ্র সরকার, মানে পি সি সরকার রেখেছেন, তাতেও আমার হাত নেই। বাবা আমার কান ধরে স্বীকার করিয়েছেন, তুই পি সি সরকার জুনিয়র। অনন্ত জুনিয়র। যত দিন আমি জুনিয়র থাকব, প্রমাণিত হবে, দেয়ার ইজ আ সিনিয়র। আমার বাবা নাকি চলে গিয়েছেন?

যেতে পারবেন না।

অনুলিখন: ঋকদেব ভট্টাচার্য

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

P. C. Sorcar Magician পি সি সরকার প্রতুলচন্দ্র সরকার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy