নৈহাটিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাড়ি, ২০১৪ সালের ছবি
আবিষ্কারক, পথিকৃৎ
‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অবদান বিষয়ে যাহা জান লিখ’— এ-হেন প্রশ্নের উত্তরে অনেকে মাথা চুলকে বলবেন, ‘ওই তো, চর্যাপদের আবিষ্কারক না?’ ইদানীং বাংলা ভাষা ও তার ব্যবহার-অপব্যবহার নিয়ে অতি স্পর্শকাতর বাঙালি ‘চর্যাপদ’-কে সেই মাধ্যমিকের বাংলা সিলেবাসেই ছেড়ে এসেছে। নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে এই পুঁথি ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এ তথ্য কারও কারও জানা। এই আবিষ্কারের বাইরে বিতত হরপ্রসাদকে চেনেন-জানেন কম মানুষই। চর্যাপদ এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রাচীন এই গ্রন্থকে উদ্ধার করে হরপ্রসাদ আসলে বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বকে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। শুধুই চর্যাপদ? সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’— যা একই সঙ্গে সীতাপতি রাম ও সমসাময়িক পাল রাজা রামপালের প্রশস্তি-কাব্য— তারও সন্ধান, সম্পাদনা ও প্রকাশ শাস্ত্রী মশাইয়ের হাত ধরে। মৈথিলী ভাষার প্রাচীন পুঁথি ‘বর্ণরত্নাকর’, রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’, মানিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ধর্মমঙ্গল’ সংগ্রহ ও প্রকাশ, কাশীরাম দাসের মহাভারতের ‘আদি পর্ব্ব’ সম্পাদনা, আরও কত রত্নরাজি তাঁর মুকুটে!
উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারত, নেপাল— যেখানেই তিনি গিয়েছেন, দিনের আলোয় এসেছে অজ্ঞাতপূর্ব বহু তথ্য। বহু শিলালিপি, তাম্রশাসন অনুসন্ধান ও পাঠোদ্ধার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যের সুপ্রতিষ্ঠা তাঁর হাত ধরেই। বাংলার জনসমাজে বহু স্তরে নানা আচার-অনুষ্ঠানে কী করে মিশে আছে বৌদ্ধধর্মের নির্যাস, লিখে গিয়েছেন ‘ডিসকভারি অব লিভিং বুদ্ধিজ়ম ইন বেঙ্গল’- এর মতো বইয়ে। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কীর্তি ‘নোটিসেস অব স্যানস্ক্রিট ম্যানাস্ক্রিপ্টস’-এর মতো বিরাট কাজ, হরপ্রসাদ এগিয়ে নিয়ে যান তা। আজ থেকে ১২০ বছর আগে শাস্ত্রী মশাই শুরু করেন ‘নোটিসেস’-এর ‘নিউ সিরিজ়’, সেখানে হরপ্রসাদ-আলোচিত হাতে লেখা পুঁথির সংখ্যা চোদ্দোশোরও বেশি! ভারতবিদ্যার কোনও ‘হল অব ফেম’ নেই, নইলে অজস্র দুষ্প্রাপ্য পুঁথির খোঁজ ও আবিষ্কারের জন্যই হরপ্রসাদের সেখানে চিরস্থায়ী ঠাঁই হত। যে ভাবে তিনি এই সব মণিমুক্তোর প্রকাশনা, সম্পাদনা, বিবরণ ও মতামত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, তার গুরুত্ব বুঝতে পারা সাধারণের পক্ষে মুশকিল। দিয়ে গিয়েছেন বিপুল এক আকর, সেখানে সংস্কৃত, বাংলা ও অন্য ভাষারও সাহিত্যের ইতিহাস রচনার অমূল্য উপাদানের ছড়াছড়ি।
‘বৃন্দাবনটা সেরে এসো!’
একে মস্ত পণ্ডিত, তায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত ও বাংলার প্রধান, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির মতো পদাধিকারী, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গী, অভিভাবক। ‘মহামহোপাধ্যায়’ আর ‘শাস্ত্রী’ উপাধি তো আছেই, আবার ঢাকা ইউনিভার্সিটির ডি লিট, ব্রিটিশ সরকারের ‘কম্প্যানিয়ন অব দি (অর্ডার অব দি) ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ (সিআইই) খেতাবধারী। বাড়ির লাইব্রেরিতে বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ইতিহাস, কাব্য, অলঙ্কার— আরও কত বিষয়ের বাঘা বাঘা বই, দেশ-বিদেশের তাবড় গ্রন্থাগারের ‘ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ’। এই মানুষ কি রাশভারী না হয়ে পারে? আশ্চর্যের কথা, ব্যক্তি হরপ্রসাদ ছিলেন সহজ আলাপী মানুষ। রোম্যান্টিকও— প্রিয় কবি কালিদাসের মন বুঝতে পর পর তিন বছর রামটেক গিয়েছিলেন বর্ষায়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন এক বার নাটক করিয়েছিলেন, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’। ঐতিহাসিক নাটকের সময়কালটা ঠিক করে ধরতে পোশাক ও অলঙ্কারের নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন নিজে!
শাস্ত্রী মশাই ভোজনরসিক ছিলেন। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসতেন, তাঁর স্মৃতিকথায় গুণমুগ্ধদের বয়ানে সরস্বতীপুজো বা বাড়িতে বিয়ে-উপনয়নের মতো উৎসব-অনুষ্ঠানে বিস্তর খাওয়াদাওয়ার জবরদস্ত হাজিরা। নৈহাটির গজা খেতে ভালবাসতেন। যে জায়গার যে মিষ্টি নামকরা— বর্ধমানের মিহিদানা-সীতাভোগ, পেনেটির গুঁপো সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, জনাইয়ের মনোহরা— বরাত দিতেন। টেবিলের ড্রয়ারে সন্দেশ রাখা থাকত, খেতেন মাঝেমধ্যে। এক বার কেউ একটা কাজ করে দেওয়ার অনুরোধ করেছে, প্রৌঢ় হরপ্রসাদ তরুণ সহকারীর সাহায্য নিয়ে করে দিলেন। অর্থের ব্যাপার নেই, তা বলে কি ছোকরা সহকারীর কাজের দাম নেই? সের দুই সন্দেশ পাঠিয়ে দিতে বললেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য! একাদশী থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা খেতেন সাবুর খিচুড়ি, পানিফলের লুচি-রুটি। বৈশাখ মাসে পাতে নিমফুলভাজা ছিল খুব পছন্দের। বলতেন, সম্রাট অশোকও নিমফুলভাজা খেতেন!
ছিলেন সুরসিকও। বাংলার জনসমাজ ও লৌকিক জীবনকে তার প্রাচীন শিকড়সুদ্ধ জানতেন বলেই হয়তো, তাঁর রোজকার কথাবার্তা-রসিকতায় মিশে থাকত জনজীবনের লব্জ, প্রবাদ, ছড়া, গানের বোল, এমনকি আদিরসের ছোঁয়াও। বার্ধক্যেও রসবোধ ছেড়ে যায়নি। যুবক সহকারীদের অনেকে তাঁর কাজের প্রয়োজনে বাড়িতেই থাকত-খেত। এক দিন কাজে নতুন যোগ-দেওয়া এক সহকারীর জন্য ভৃত্য রামলালকে পাঠালেন, শিঙাড়া-রসগোল্লা আনাতে। পরের দিনও একই নির্দেশ দিতে সহকারী বললেন, ও সব কী দরকার, রোজ রোজ কেউ ও সব খায় না কি? অল্প মুড়িমুড়কি আনালেই হবে। শুনে শাস্ত্রী মশাইয়ের সহাস্য উত্তর, তুমি তো বেশ চালাক দেখছি! শিঙাড়া-রসগোল্লা তো দু’-এক দিন খাইয়েই বাদ দিতাম, এখন সামান্য মুড়িমুড়কি আটকাই কী করে? এক সহকারী এক বার বাথরুম যাওয়ার মুখে হরপ্রসাদ ও জনৈক অতিথির কথা শুনছেন, শাস্ত্রী মশাই হঠাৎ তাঁর উদ্দেশে বলে উঠলেন, “যাও না হে কর্তা! বৃন্দাবনটা সেরে এসো না!” ‘হঠাৎ বৃন্দাবন বললেন কেন’ প্রশ্নে পরে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে তাঁর উত্তর, “ঐ ভদ্রলোকের সামনে পাইখানা যাও বল্লেই বুঝি ভাল হত?”
নীতি ও নৈতিকতা
সুদীর্ঘ ব্রাহ্মণ্য-পরম্পরার স্রোত তাঁর বংশে, কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী বলা যাবে না। তাঁর রক্তে টোলও আছে, ইংরেজি শিক্ষাও! সংস্কৃতের সনিষ্ঠ পাঠ আছে, ইতিহাস-পুরাতত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত বোধও! এক দিকে তিনি একাদশীর উপবাস করেন, অন্ন খান না। মদ স্পর্শ করেন না— উনিশ শতকীয় বাবু কালচারের স্রোতে ভেসে নয়, অসুস্থ হলে ডাক্তারি পরামর্শেও নয়। চিঠিতে বিহার-প্রবাসী ছেলেকে লেখেন, সে যেন ‘পাখিটাকি’ না খায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নিজের অফিসঘরে তেষ্টা পেলে গ্লাসে জল খান না, ডাব এনে দিতে বলেন। বৈদিক মন্ত্রে বিশ্বাস ছিল, আহ্নিক ও গায়ত্রীজপ করতেন। এটুকুই। পুজোপাঠের বাহুল্য ছিল না। উপনয়নে বিশ্বাস করতেন, দীক্ষায় নয়। বলতেন, দীক্ষা এসেছে বৌদ্ধধর্ম থেকে, ওর দরকার নেই। তাঁর নীতিনিষ্ঠা মানবিক নৈতিকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। যে যখনই অর্থী হয়ে এসেছে, পাশে দাঁড়িয়েছেন— তা সে অর্থসাহায্যই হোক বা চাকরির শংসাপত্র। ঢাকায় জগন্নাথ হল, মুসলিম হলের ছাত্রদের সাহায্য করেছেন। বঙ্গভঙ্গ থেকে অসহযোগ, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংস্রব রাখেননি কখনও। তবে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইয়ে একটা পরিচ্ছেদের নাম ছিল ‘ভারতে ইংরাজ শাসনের সুফল’, জীবনের উপান্তে সহকারীকে বলেছিলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে আর মিথ্যে কথা লিখতে পারবেন না, পারলে ‘সুফল’ শব্দটা কেটে ‘কুফল’ করে দেন। শেষে তাঁর নির্দেশে অধ্যায়টার নাম হয়েছিল ‘ভারতে ইংরাজ রাজত্বের ফল’।
বন্ধু ও বৈরী
বিজ্ঞজন বলেন, হরপ্রসাদের সূত্রে এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠান যেমন লাভবান হয়েছিল, তেমনটা হতে পারত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও। হয়নি, তার কারণ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বনিবনার অভাব। নানা গল্পগাছা চালু। একটা এই, আশুতোষ তাঁর বিধবা মেয়ে কমলার ফের বিয়ে দেওয়ায় হরপ্রসাদের সঙ্গে মতান্তর। খটাখটি ছিল কাজেও। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চপদে নির্বাচন নিয়ে দু’জনের দ্বৈরথ। তবে তা মতান্তরই, মনান্তর নয়, হরপ্রসাদ নিজেই বলেছেন। স্বার্থান্বেষী স্তাবকেরা আশুতোষকে ভুল বুঝিয়েছিল। আসল ছবিটা হল, হরপ্রসাদের পাঠানো সন্দেশের ভক্ত ছিলেন স্যর আশুতোষ। দেরি হলে বা ক’দিন না এলে চিঠিতে জানাতেন তা। আর সবচেয়ে বড় হরপ্রসাদি প্রমাণ— স্যর আশুতোষের পুত্রদের সকলের নামের সঙ্গে জুড়ে আছে ‘প্রসাদ’ আর হরপ্রসাদের ছেলেদের নামের সঙ্গে— ‘তোষ’!
গ্রন্থঋণ: হরপ্রসাদ-গ্রন্থাবলী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী স্মারক গ্রন্থ