এই সময়ে ‘দাদাঠাকুর’-এর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। যিনি সহজেই কশাঘাত করতে পারেন মানুষের বর্তমান মূল্যবোধহীনতাকে। যার আদর্শ, নীতিবোধ, জীবনধারা তরুণ প্রজন্মের কাছেও আদর্শ স্বরূপ। সম্প্রতি এই মানুষটির দেখা মিলল মঞ্চে, আর সম্ভবত এই প্রথম। এই মানুষটিকেই মঞ্চে আনার সাহস দেখালেন নির্দেশক দুলাল লাহিড়ী। প্রমাণও মিলল প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের সমবেত করতালিতে।
কিন্তু কে এই মানুষটি? ‘দাদাঠাকুর’ ওরফে শরৎ পণ্ডিত। ১৮৮১ সালে ইনি জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুরে। মাথা উঁচু করে বাঁচাই যাঁর মূল আদর্শ। কারও দান তিনি গ্রহণ করেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই যাঁর পণ। কোনও প্রলোভনের কাছে মাথা নত করেননি। জঙ্গিপুরেই যিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব ছোট্ট ছাপাখানা। সহজেই কবিতা তৈরি আর তাতে সুর বাঁধার ক্ষমতাও ছিল সহজাত। অর্থের অভাবে সংসারে হাঁড়ি না চড়লেও, সন্তানকে কঠিন অসুখ থেকে বাঁচাতে না পারলেও নিজ আদর্শে অবিচল। নানান প্রয়োজনে গ্রামের মানুষের রক্ষাকর্তাও তিনি। তার বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে হয় জমিদারকে। বশে আনতে পারতেন ইংরেজকেও।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের কলমে এবং দুলাল লাহিড়ীর নির্দেশনায় তিনি জীবন্ত হয়ে উঠলেন। আর যাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন অভিনেতা রজত গঙ্গোপাধ্যায়। ‘দাদাঠাকুর’ নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করলেন তিনি। এই চরিত্রের মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে, কথায় আছে যুক্তি, অথচ কথা বলার মধ্যে অদ্ভূত এক সারল্য ধরা পড়ে। যার মধ্যে রয়েছে মাটির টান। রজত গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাবলীল অভিনয় ক্ষমতায় খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দাদাঠাকুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি। এছাড়াও নাটকে গ্রামের মানুষ হিসেবে বেশ কিছু চরিত্র উঠে এসেছে। যাতে অভিনয় করেছেন একঝাঁক নতুন ছেলে-মেয়ে। তাদের অভিনয়ে খুব একটা পরিণতমনস্কতার ছাপ পাওয়া না গেলেও প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। গানও এই নাটকের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সত্য কথা অপ্রিয়ই, কিন্তু কমেডি বা হাস্যরসের আশ্রয়ে সেই কথাগুলোই সহজে বলে দেওয়া যায়। এই নাটকে ব্যবহৃত গানগুলি তার প্রমাণ। গানের পাশাপাশি হাসির মোড়কে অনেক ব্যঙ্গাত্মক কথাও উঠে এসেছে নাটকে। বর্তমানে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া মানুষকে এ নাটক যেন সাময়িক স্বস্তি দেয়। ‘দাদাঠাকুর’ নাটকটি পরিচালনার পাশাপাশি দুলাল লাহিড়ীকে এ নাটকে তবলাবাদক হিসেবেও পাওয়া যায়। নাটকের সঙ্গীত এবং আবহ রচনা করেছেন স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে আদর্শ মূল্যহীন
ইবসেনের নাটকে। মনসিজ মজুমদার
ইবসেনের ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’ (রচনা: ইবসেন, পরি: ওস্টারমাইয়ার) মঞ্চস্থ করলেন জার্মানির নাট্যদল শাউব্যুনে। চামড়ার কারখানার বর্জ্যে দূষিত শহরের স্পা-জলাশয়ের জল। একথা জানার পর ডাক্তার স্টকম্যান সকলকে সচেতন করতে চায়। প্রথমে স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক ও আরও অনেকে তাকে সমর্থন করে। কিন্তু শহরের মেয়র পিটার প্রবল বিরোধিতা করে কারণ, একথা প্রচার হলে শহরের আয় বন্ধ হয়ে যাবে, স্নানার্থী ট্যুরিস্টরা আসবে না। মেয়র আর্থিক ক্ষতির ভয় দেখিয়ে শহরবাসীদের স্টকম্যানের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। চতুর্থ অঙ্কে স্টকম্যান তার বক্তৃতায় বলে সঙ্কট অর্থনীতির নয়, অর্থনীতিই সঙ্কট। পুঁজিবাদ আর নির্বোধ সংখ্যাধিক্যের গণতন্ত্র সমাজকে দূষিত করেছে। শহরবাসী তাকে গণশত্রু বলে চরম হেনস্থা করে। স্টকম্যান দর্শকদের মত চায়। দর্শকরা তাকেই সমর্থন করেন। শেষদৃশ্যে শহরবাসীর আক্রমণে স্টকম্যান বিধ্বস্ত।
এদিকে স্পা-এর শেয়ারমূল্য কমে যাওয়ায় স্টকম্যানের শ্বশুর, চামড়ার কারখানার মালিক, মর্টেন কীল, সেগুলি কিনে নিয়ে জামাইকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেন যাতে সে মত বদলায়। স্টকম্যান বসে থাকে। পরাজিত নায়কের মতো। ইবসেনের নায়কের মতো বলে না যে, সে একা বলেই শক্তিশালী। নিখুঁত নির্দেশনায় নাটক ঝকঝকে আধুনিক ও সমকালীন। ডাক্তার স্টকম্যান (স্টেফান স্টার্ন) তার স্ত্রী (এভা মেকবেখ) সম্পাদক হোভস্টাড (ক্রিস্টোফ গহেন্ডা) সহ-সম্পাদক বিলিঙ (মারিৎস গোটওয়ান্ড) সকলেই তরুণ।
নাটকের শুরুতে রক ব্যান্ডের মহড়া দেয়। শুরুর ঐকতান শেষে বেসুরো হয়ে যায়, একমাত্র স্ত্রী ছাড়া স্টকম্যানের পাশে আর কেউ থাকে না। স্টেফান স্টার্নের স্টকম্যান অনাড়ম্বর আদর্শবাদী যুবা, তার বিপরীতে মেয়র (ইংগো হালসমান) সুচতুর রাজনীতিক।
পাপেলবাউমের মঞ্চ ব্ল্যাকবোর্ডের দেওয়ালে ঘেরা শিশুসন্তান সমেত তরুণ দম্পতির নতুন সংসারের ঘরদোর। খড়ির দেয়াল লিখন—যদিও দৃশ্যাবলির বিবরণ—যেন রাস্তার দেওয়ালে লেখা শ্লোগান, ঈঙ্গিত করে আসন্ন লড়াই যার চরম পরিণতিতে বিপর্যস্ত স্টকম্যান দম্পতির ঘর বার একাকার হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy