Advertisement
E-Paper

লা‘বন্য’ময় ভরতপুর

চারপেয়ী, সরীসৃপ, সাড়ে তিনশোর বেশি প্রজাতির লক্ষাধিক পাখি, রাজা-মহারাজের গল্প নিয়ে জমজমাট রাজস্থানের ভরতপুর। লিখছেন ঊর্মি নাথ চারপেয়ী, সরীসৃপ, সাড়ে তিনশোর বেশি প্রজাতির লক্ষাধিক পাখি, রাজা-মহারাজের গল্প নিয়ে জমজমাট রাজস্থানের ভরতপুর। লিখছেন ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
একঝাঁক রোজি পেলিক্যান

একঝাঁক রোজি পেলিক্যান

হাতে সময় কম, পকেটে রেস্তও অঢেল নেই। কিন্তু মন চাইছিল এমন এক জায়গায় যেতে, যেখানে দেখা মিলবে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পাখির, অনেক প্রজাপতির। সঙ্গে চারপেয়ে আর সরীসৃপের দর্শন হলে তো পোয়া বারো! আমার এই ইচ্ছে এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতে সে বলেছিল, ‘‘রাজস্থানের ভরতপুরে গেলেই পারো!’’ অন্যান্য অভয়ারণ্যের সাফারির খরচের কাছে এ নেহাতই শিশু। ভরতপুর মানে শুধু বন্যপ্রাণই নয়, এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাস। ভরতপুরের বেশ কাছে মথুরা এবং আগ্রা। পাখি, ইতিহাস, তাজমহল— প্রস্তাবটা মনে ধরে গেল। ক্যামেরা ও রুকস্যাক গুছিয়ে চেপে বসলাম ট্রেনে।

একরাত্রি ট্রেনে কাটিয়ে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম ভরতপুর। বিশ্রাম ও খাওয়া পর্ব চুকিয়ে সোজা ভরতপুর ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির দরজায়। এই স্যাংচুয়ারির অফিশিয়াল নাম ‘কেওলাদো ঘানা ন্যাশনাল পার্ক’। এখানে ঘুরে দেখার দুটো উপায়, সাইকেলে বা রিকশায়। দুটোই ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি চাইলে, গাইড আপনার সঙ্গে সাইকেলে পাশে-পাশে যাবেন। রিকশায় চালকই গাইড। এঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই ট্রেন্ড। এ বার বুঝলাম, কেন ভারতের অন্যান্য অভয়াণ্যের চেয়ে এখানে খরচ কম। ২৮৭৩ হেক্টর ন্যাশনাল পার্কের ম্যাপ দেখে মাথা ঘুরে গেল। গাইডই ভরসা। কোন পাখির কোথায় ডেরা, কোথায় চিতল হরিণ বা সম্বর, কোথায় নীলগাই... সাইকেলে পাশাপাশি যেতে-যেতে রিলে করছিলেন গাইড।

সম্বর

পার্কে ঢুকতে না ঢুকতেই স্বাগত জানল গাছের কোটরে বসা পেঁচার ছানারা, শিকারি পাখি শিকরা, লাফিং ডাভ, টিয়া, ময়ূর... বারবার সাইকেল থামিয়ে হাত চলে যাচ্ছিল ক্যামেরার শাটারে। ঘন ঘন দাঁড়িয়ে যেতে দেখে অভিজ্ঞ গাইডটি হেসে বললেন, ‘এটা তো সবে প্রিলিউড, গভীরে গিয়ে দেখুন, তখন তো আর সাইকেলেই উঠতে পারবেন না।’ সন্ধে হয়ে আসছিল, মন্থর গতি দেখে গাইড বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি পা চালান, অজগর, বুনো শেয়াল, লেপার্ড ক্যাট, বুনো শুয়োর সামনে চলে এলে বিপদ!’’ বিশেষ করে সাবধান করে দিলেন নীলগাই সম্পর্কে। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা। নীলগাই রাস্তা পেরোনোর সময় আগুপিছু দেখে না, তাই অসাবধান হলেই তাদের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এ যেন দৈববাণী! কথাটা শেষ হতে না হতেই সামনের সাইকেল চালককে কুপোকাত করে তিরবেগে চলে গেল এক নীলগাই!

লোহাগড় ফোর্ট

প্রথম দিনের আধবেলায় পার্কের অর্ধেকও দেখা হয়নি। ছবিও জমেনি সে রকম। তাই পরের দিন ভোর-ভোর হাজির হলাম আবার। পার্কে সারা দিন থাকার প্ল্যান ছিল, তাই সঙ্গে জল ও শুকনো খাবার ছিল। যদিও পার্কের ভিতরে একটি ক্যান্টিন আছে। কিন্তু ভোরে এসেও আশাহত হতে হল। পথ আটকে বসে ঘন কুয়াশা। এক হাত দূরত্বের মধ্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা অপেক্ষা! আর এই ফাঁকে গল্প জুড়ে দেওয়া গাইডের সঙ্গে। ‘কেওলাদো’ হল শিবের নাম। এই পার্কের ভিতর আছে বহু প্রাচীন শিবমন্দির। সেই মন্দিরের নামেই পার্কের নাম। আর ‘ঘানা’ মানে ঘন। এই অরণ্য প্রায় ২৩০ বছরের পুরনো। সতেরোশো খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি যা ভরতপুরের রাজা সুরজমলের প্রিয় শিকারের জায়গা ছিল। শীতকালে মজে থাকতেন বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী হাঁস শিকারে। ব্রিটিশ আমলেও সাহেবরা রাজাদের সাহায্যে জমিয়ে পরিযায়ী হাঁস শিকার করতেন। ক্রমশ শীতের মরসুমে হাঁস শিকার এক রকম প্রথা হয়েই দাঁড়ায়। একবার তো গভর্নর জেনারেল এবং ভাইসরয় অফ ইন্ডিয়া লর্ড লিংলিথগো একাই প্রায় চার হাজারের উপর মালাড ও টিল হাঁস শিকার করেছিলেন। ১৯৭২ পর্যন্ত ভরতপুর শিকারিদের স্বর্গরাজ্য ছিল। কিন্তু ক্রমশ পক্ষিপ্রেমীদের হস্তক্ষেপে সচেতনতা বাড়ল। বন্ধ হল শিকার। ১৯৮২ সালে একে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হল এবং ১৯৮৫-তে চিহ্নিত হল ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে। এই অরণ্যকে শিকারের বধ্যভূমি থেকে বন্য প্রাণীদের অভয়রাণ্যে রূপান্তিরত করার জন্য যিনি কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, তিনি হলেন ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। গল্প শেষ হতে ভাগ্যও প্রসন্ন হল।

সারস ক্রেন

পার্কের ভিতরে বিরাট অঞ্চল জুড়ে জলাধার। জলাধারের চারপাশ জুড়ে রোজি পেলিক্যান, মালাড, শোভলার, রাডি শেল ডাক, কম ডাক, রেড চেস্টেড পোচার্ড, লেসার হুইসলিং ডাক, স্পট বিল, বৈকাল টিল, নর্দার্ন পিনটেল-এর মতো প্রচুর পরিযায়ী পাখির অবস্থান। জলাশয়ের ধারে পাখিদের পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেষি করে আছে প্রচুর কচ্ছপ। ডাটার, পেন্টেড স্টক, পারপেল হেরন, আইবিশ, ময়ূর, স্পুনবিল, বি-ইটার, বিভিন্ন ধরনের পেঁচা, শিকারি পাখি, টিয়া এখানকার আবাসিক। তাদের সংখ্যাও অগণিত। পাখিদের কলতানে অভয়ারণ্য মুখরিত। প্রায় ৩৬৬ প্রজাতির পাখি দেখা যায় এখানে। পাখি ছেড়ে যখন সম্বরের ছবি তুলতে মগ্ন, তখন গাইড খবর দিলেন, দুটো সারস ক্রেনকে একটু আগেই দেখা গিয়েছে লম্বা শীর্ণ ঘাসের জঙ্গলে। জায়গাটা জেনে প্যাডেলে চাপ দিলাম। সারস ও সারসীর চরে বেড়ানো মুগ্ধ চোখে দেখলাম, ক্যামেরাবন্দি করলাম। ক্রেনের সন্ধান করতে গিয়ে রাস্তায় চোখে পড়েছিল শুকনো ঘাসের ঝোপে অজগরের রোদ পোয়ানো, লম্বা গলার ডাটারের মাছ শিকার, হরিণ-হরিণীর ছুটে চলা। পরিযায়ী পাখিদের মতোই প্রতি বছরই এই পার্কে ভিড় জমান দেশ বিদেশ থেকে আসা ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা।

বন্যপ্রাণের পর এ বার পালা ইতিহাসের। এই তালিকায় প্রথম লোহাগড় ফোর্ট। মহারাজ সুরজমল জলাধারের মাঝখানে দুর্গটি এতটাই শক্তিশালী করে তৈরি করিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশদেরও এটা কবজা করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। মিউজিয়াম ও গঙ্গামন্দিরের পর গাড়ি নিয়ে সোজা ৫৭.২ কিমি দূরে আগ্রায়। তাজমহল দেখে বিস্তর সুখস্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফেরা।

ফোটো: লেখক (লোহাগড়ের ছবিটি বাদে)

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে সরাসরি ট্রেনে বা আগ্রা বা মথুরায় নেমে বাসে বা ট্রেনে। নিউ দিল্লি থেকেও গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

কখন যাবেন অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। অবশ্য শুধু দেশীয় পাখি বা অন্য জীবজন্তু দেখার জন্য অগস্ট, সেপ্টেম্বরেও যেতে পারেন।

থাকার জায়গা

বনদফতরের লজ ও একাধিক ভাল বেসরকারি হোটেল।

Tour Diary Travel and Tourism Bharatpur Rajasthan ভরতপুর লোহাগড় ফোর্ট Lohagarh Fort
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy