Advertisement
E-Paper

জংলা পাহাড়ের ডাকে

এখানে এসে সবুজের হাত ধরে মেঘ। বৃষ্টি মাখে রূপকথার রাজ্য বক্সা-জয়ন্তী ও রায়মাটাং।নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বাঁক নিল ট্রেন। দূরে দেখা গেল হালকা পাহাড়ের স্কেচ। মনটা অমনি ভাল হয়ে গেল। সবুজ জঙ্গল, তিস্তা নদী, চা-বাগান-শেড ট্রির ভিতর দিয়ে কখন যেন আলিপুরদুয়ার এসে গেল। তখন দুপুর। নেমে শুনলাম, কী সব ঝামেলার জন্য নাকি গাড়ি কম। যাও বা গাড়ি মিলল, সে-ও মাঝ রাস্তায় দিল নামিয়ে।

সোহিনী দাস

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
স্বর্গরাজ্য রায়মাটাং

স্বর্গরাজ্য রায়মাটাং

ট্রেন তখনও ছুটছে— গ্রাম, জলছবির মতো রাস্তা। আমার মন খুঁজছে শুধুই পাহাড়-জঙ্গল আর তিরতিরে নদী। জুনের শেষ, বর্ষার সবুজ লেগেছে যেন ধুলোবালিতেও। সতর্কবার্তা শুনেছি, জঙ্গলসাফারি বন্ধ। সেই অক্টোবর পর্যন্ত। কুছ পরোয়া নেই। বর্ষায় জঙ্গলের রূপই নাকি আলাদা! আর তাই এ বারের গন্তব্য বক্সা-জয়ন্তী-রায়মাটাং।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বাঁক নিল ট্রেন। দূরে দেখা গেল হালকা পাহাড়ের স্কেচ। মনটা অমনি ভাল হয়ে গেল। সবুজ জঙ্গল, তিস্তা নদী, চা-বাগান-শেড ট্রির ভিতর দিয়ে কখন যেন আলিপুরদুয়ার এসে গেল। তখন দুপুর। নেমে শুনলাম, কী সব ঝামেলার জন্য নাকি গাড়ি কম। যাও বা গাড়ি মিলল, সে-ও মাঝ রাস্তায় দিল নামিয়ে। সামনেই বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্ট লেখা সিংহদুয়ার। সেখান থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে জয়ন্তী। গাড়ি হাত তুলেছে। অগত্যা বাস। কিন্তু বাস যায় সারা দিনে মাত্র দু’বার। পাক্কা দেড় ঘণ্টা পরে বাস এল। ঠাসা ভিড়। কোনও মতে দুলতে দুলতে শেষমেশ পৌঁছলাম জয়ন্তী।

পাহাড়ের রং আকাশের মতোই মনখারাপিয়া। সামনেই ফিতের মতো জয়ন্তী নদী। নুড়ি পাথর বুকে উপচে যাচ্ছে স্ফটিক জল। ফ্রেশ হয়েই ছুটলাম পা ভেজাতে। ছোট্ট তিরতিরে নদী তবু স্রোতে কম যায় না সে। নানা রংচঙে নুড়ি ব্যাগে ভরার লোভ সামলাতে পারলাম না। একটু দূরে ভাঙা রেলব্রিজ ছুঁয়ে সন্ধে নামল। ঘরে ফিরল পাখি।

মেঘপাহাড়ি জয়ন্তী

সকালে ঘুম ভেঙে ঘরলাগোয়া বারান্দায় পা দিতেই দেখি উঠোনেই এসে দাঁড়িয়েছে পাহাড়। কই, কাল খেয়াল করিনি তো! ছুটলাম নদীতে। স্রোতস্বিনী বয়ে চলেছে, যেন কবেকার বান্ধবী। ‘এ-গাছ ও-গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি’… দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে হাজির। এ বার বক্সা ফোর্ট।

দু’পাশে সবুজ রেখে গাড়ি ছুটল। মাঝরাস্তায় সঙ্গী হল গাইড। সান্তালাবাড়ির কাছে এসে গাড়ি থেমে গেল। সামনে খাড়াই রাস্তা। চারপাশে সবুজ, দূর পর্যন্ত নীল আকাশ। তার মাঝখানে পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা উঠছি। প্রকৃতির কাছে এলে নিজেকে কেমন যেন এইটুকু মনে হয়। পথে নানা গাছ চেনাচ্ছে গাইড। শোনাচ্ছে গল্প। স্থানীয় ভুটানি মানুষ। বেশ ভাব হয়ে গেল। মাঝপথে তিরতিরে ঝর্না, কতশত নাম না জানা ফুল, পাহাড়ি লতা, প্রজাপতির নাচানাচি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বক্সা দুর্গ।

ভুটান থেকে ভারতে আসার ১১টি রুটের মধ্যে অন্যতম বক্সাদুয়ার রুট। তার সুরক্ষার জন্যই তৈরি হয়েছিল এই দুর্গ। ১৭৭৪ ও ১৮৬৫ সালের ভারত-ভুটান যুদ্ধের সাক্ষী সে। শোনা যায়, কোচবিহারের রাজার আমন্ত্রণে ব্রিটিশরা এই দুর্গের দখল নিয়েছিল। তারাই বাঁশের দুর্গটিকে পাথরের দুর্গে রূপান্তরিত করে। খাড়া পাহাড় ও গভীর জঙ্গলে ঘেরা দুর্গম বক্সা ফোর্ট পরে পরিণত হয় কুখ্যাত জেলে। আন্দামানের সেলুলার জেলের পরে এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতের সব চেয়ে দুর্গম কারাগার। স্বাধীনতার পর থেকে বক্সা ফোর্টের গুরুত্ব কমতে থাকে। ষাটের দশকে এটাই হয়ে ওঠে রিফিউজিদের রিলিফ ক্যাম্প। সংরক্ষণের অভাবে সেই ফোর্ট আজ প্রায় ধ্বংসস্তূপ।

ঐতিহাসিক বক্সা ফোর্ট

‘এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে’— ডুংডুং ঘণ্টা বাজছে তাদের গলায়। পাশে ছোট বৌদ্ধ গুমটি। আমরা উঠছি। পায়ে পায়ে সঙ্গী হল একটা কুকুর। ধসে যাওয়া দেওয়াল। এখানে-ওখানে চারিয়ে গিয়েছে গুল্মলতা। কাদের দীর্ঘশ্বাসে এখনও ভারী ভাঙাচোরা কারাগার। এক একটা ফলক ইতিহাস পড়িয়ে চলেছে। বন্দি বিপ্লবীরা নাকি এক বার জেলেই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন। স্বয়ং রবিবাবু তখন দার্জিলিঙে। জানতে পেরে প্রত্যুত্তরে দু’পঙ্‌ক্তি লিখে পাঠালেন তিনিও। রয়েছে সেই স্মারকও। বসলাম গিয়ে দু্র্গের উপরের বিশ্রাম-উদ্যানের একটি দোলনায়। গাইড জানাল, এখান থেকে ট্রেক করে পৌঁছনো যায় লেপচাখা। একটু দূরেই ভুটান বর্ডার। এরই মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি সঙ্গী হল নামার পথে। দুর্গ থেকে বেরিয়ে পাশেই ব্রিটিশ আমলের একখানা ডাকঘর। এখনও চিঠি আসে কি না কে জানে!

নেমে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই হুড়মুড়িয়ে ছুটে এল মেঘ। তেড়ে বৃষ্টি নামল। পাহাড়ের পথে জল নামছে গর্জন করে। গাড়ি ছুটল ফের জয়ন্তীর পথে। সে দিন বিকেলটা অলস কাটল। এখান থেকে যাওয়া যায় পুখরি পাহাড়, ছোট মহাকাল এবং বড় মহাকাল। কিন্তু রইল সে সব পড়ে। পরদিন ভোর না হতেই গাড়ি ছুটল রায়মাটাং।

শুকিয়ে যাওয়া নদী পেরিয়ে গাড়ি যখন রায়মাটাং পৌঁছল, তখন ঝলমলানো রোদ। সে এক স্বপ্নরাজ্য। সামনেই পাইন গাছের সারি। তার পিছনে পাহাড়ের বুক জুড়ে থমকে রয়েছে তুলোর মতো মেঘ। আর তারই সামনে ছোট্ট একটা কাঠের বাংলো। একটু বাদেই বৃষ্টি নামল রোদ চিরে। এ বৃষ্টির সঙ্গে সে দিনের বৃষ্টির তুলনা হয় না। এ বৃষ্টি প্রেমিকার মতোই আদুরে। এখান থেকে জনবসতি বেশ নীচে। থমথমে সন্ধ্যা নামল, ক্রমে রাত। দূরে জঙ্গল থেকে কোটরা হরিণ ডেকে উঠল— বাক...বাক...বাক...

পরের দিন ভোর না হতেই ছুটলাম রায়মাটাং নদী দেখতে। দু’পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু একফালি রাস্তা। গত রাতের বৃষ্টিতে লেগে রয়েছে বুনো পায়ের ছাপ। বেশ খানিকটা শ্যাওলা-পাথুরে পথ বেয়ে পৌঁছলাম নদীর কাছে। এ নদী জয়ন্তীর মতো নয়, এ ষোলোর যুবতীর মতো উদ্দাম। পাথরে লেগে ছিটকে উঠছে জল। এ বার ফেরা। প্রথমে শ্যাওলাপথ ধরে জোঁকের ভয় কাটিয়ে বাংলোয়, আর তার পরে শহরে। চা-বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটল ট্রেন ধরাবে বলে।

মনখারাপের মেঘটা পিছু নিল নাকি কলকাতাতেও!

Travel Buxa Raimatang
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy