Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ১...

অপরাজিত

উইলিয়াম শেক্সপিয়র। ২৩ এপ্রিল তিনি ৪৫০ হলেন। আজও একচ্ছত্র, একাধিপতি। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যআজ থেকে ঠিক ৪৫০ বছর আগে এই দিন ২৬ এপ্রিল, ১৫৬৪ স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভন-এর ভিকার (যাজক) লাতিনে নথি লিখলেন ‘জুলিয়েলমুস ফিলিউস ইয়োহানেস সাক্সপেরে’। অর্থাৎ ‘জন শেক্সপিয়রের সন্তান উইলিয়ম’। জন ও মেরি শেক্সপিয়রের প্রথম দুই সন্তান ছিল কন্যা, এবং তাঁদের একজন শৈশবে ও আর এক জন আঁতুড়েই মারা যায়। উইলিয়ম ওঁদের তৃতীয় সন্তান এবং প্রথম পুত্র। উইলিয়মেরও বাঁচার সঙ্কট কম ছিল না। সে কথায় যাবার আগে জাতকের জন্মদিনটাই ঠিক করে নেওয়া যাক। এখনও মান্য করা হয় এমন একটি বিবৃতিতে ই.কে.চেম্বার্স লিখেছিলেন: ‘উইলিয়মের সত্যিকার জন্মদিনটা জানা যায়নি।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

আজ থেকে ঠিক ৪৫০ বছর আগে এই দিন ২৬ এপ্রিল, ১৫৬৪ স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভন-এর ভিকার (যাজক) লাতিনে নথি লিখলেন ‘জুলিয়েলমুস ফিলিউস ইয়োহানেস সাক্সপেরে’।

অর্থাৎ ‘জন শেক্সপিয়রের সন্তান উইলিয়ম’। জন ও মেরি শেক্সপিয়রের প্রথম দুই সন্তান ছিল কন্যা, এবং তাঁদের একজন শৈশবে ও আর এক জন আঁতুড়েই মারা যায়।

উইলিয়ম ওঁদের তৃতীয় সন্তান এবং প্রথম পুত্র। উইলিয়মেরও বাঁচার সঙ্কট কম ছিল না। সে কথায় যাবার আগে জাতকের জন্মদিনটাই ঠিক করে নেওয়া যাক। এখনও মান্য করা হয় এমন একটি বিবৃতিতে ই.কে.চেম্বার্স লিখেছিলেন: ‘উইলিয়মের সত্যিকার জন্মদিনটা জানা যায়নি।

একটা বিশ্বাস আছে যে তারিখটা ২৩ এপ্রিল, ঠিক যে তারিখে ১৬১৬-তে ওঁর মৃত্যু হয়। ধারণাটা অষ্টাদশ শতকের এক ঐতিহাসিক ভুলের উপর দাঁড়িয়ে।’

খুবই সম্ভব যে শেক্সপিয়রের জন্ম ২১, ২২ বা ২৩ এপ্রিলের কোনও একটি দিন, তবে ২৩-এ ফেললে জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে পড়ে বেশ নাট্য সঞ্চার হয়।

২৩ এপ্রিলে মৃত্যুর আগে বেশ ভুগেছিলেন শেক্সপিয়র, সম্ভবত টাইফয়েডে। চমৎকার যত্নআত্তির জন্য মৃত্যু একটু দেরিতে হয় এবং কষ্টটাও বাড়ে। সেকালে টাইফয়েড মানেই সমানে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, নিদ্রাহীনতা, জলতেষ্টা আর অস্বস্তি। মুখটাও শুকিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। সেটা আঁচ করা যায় ওঁর ডেথ মাস্ক থেকে সম্ভবত গড়া হোলি ট্রিনিটি চার্চে ওঁর মূর্তি দেখে।

মৃত্যুকালে শেক্সপিয়র তো সাহিত্যের বিস্ময় হয়েই গেছেন, ক’দিন বাদেই সমকালীন প্রতিভা বেন জনসন লিখেও দিলেন ‘হি ওয়জ নট অফ অ্যান এজ, বাট ফর অল টাইম!’

এবার ভাবা যাক, জগদ্বাসীর কী কপালটাই না পুড়ত, সাহিত্যলোকে কী ট্র্যাজেডিটাই না ঘটত যদি এই ট্র্যাজেডিয়ান জন্মাতেই না পারতেন। যার সমূহ সম্ভাবনা ছিল সে সময়টায়।

ইংল্যান্ডে সে বড় সুখের সময় নয়। স্ট্র্যাটফোর্ডে তিন দিনের উইলিয়মের নাম লিখেছেন যখন ভিকার জন ব্রেচগার্ডল, তখন সেখান থেকে মাত্র দু’দিনের ঘোড়ার গাড়ির দূরত্বে শিশুরা অহরহ মারা যাচ্ছে প্লেগে।

সেই ঐতিহাসিক ব্ল্যাক ডেথ-এর পর দেশের নানা জায়গাই ফের এক বীভৎস প্লেগের থাবায়। যখন উইলিয়ম জন্মাচ্ছে তখন মা মেরি শেক্সপিয়রের শহর ওই রোগের যাত্রাপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। প্লেগ ক্রমশ উত্তরে চড়ছে।

১৪ মার্চ চড়াও হল স্ট্র্যাটফোর্ডে। যাজক ব্রেচগার্ডল-এর বোন সিসেলি মারা গেলেন। দোরগোড়ায় যখন মৃত্যু, যাজকের দুশ্চিন্তা বাড়ল শহরের চেম্বার্লেন অর্থাৎ রাজসরকার জন শেক্সপিয়রকে নিয়ে। বেচারির দু’দুটি সন্তান অকালে গত, বৌটি সন্তানসম্ভবা, যে কোনও দিন প্রসব করবে, তারপর?

শিশুটি বাঁচল, প্লেগ পার করল, বড় হয়ে উইলিয়ম শেক্সপিয়র হল। কালে কালে যে নামটি দুটি জিনিসের সমার্থক হয়ে উঠল। এক, ইংরেজি ভাষা। দুই, সাহিত্য।

গত শতাব্দীর শেষে ‘টাইম’ পত্রিকা বিশ্ব জুড়ে এক মত যাচাই করে জানায় যে, দুনিয়ার মতে গত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকারের নাম উইলিয়ম শেক্সপিয়র। এই ভোটাভুটি না হলেও কারও সেটা জানতে বাকি ছিল না।

শেক্সপিয়র বাস্তবিকই একটা রূপকথার মতো। গবেষণার তো শেষ নেই ওঁর জীবন ও কাজ নিয়ে, তবে যতই জানা যায় ততই যেন রহস্য বাড়ে। সব চেয়ে বড় রহস্য এই যে, এই চারশ’ বছরেও ওঁর সাঁইত্রিশ নাটক, একশ’ চুয়ান্ন সনেট এবং ছ’টি কবিতাগুচ্ছের কোত্থাও কোনওখানে বয়সের ন্যূনতম ছায়া বা ছোঁওয়া পড়ল না।

এখনও পৃথিবীর কোথাও কিছু নতুন দেখলে যেমন কিছু অলস মস্তিষ্কের মানুষ মধ্যযুগীয় ভবিষ্যদ্বক্তা নোস্ত্রাদামুসের লেখাপত্তর ঘাঁটেন, তেমনি গভীর, মননশীল মানুষরা ফিরে যান শেক্সপিয়রে, দেখতে ওই বিষয় ও পরিস্থিতি বোঝাতে এভনের কবি কিছু বলে গেছেন কিনা। প্রায়শ খুঁজে পানও, কারণ মনের গভীরে খননকার্যে এমন মেধা পৃথিবী বড় একটা দেখেনি।

রহস্যের সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব সব রোমাঞ্চও ঘিরে আছে কবির জীবনে। ওঁকে আঁতুড়ে প্লেগ নেয়নি, এতেই জগতের সৌভাগ্যের ইতি? কেন, শেক্সপিয়রের এত এত কাজ যে শেষ অবধি অক্ষত রইল, এই বা কম সৌভাগ্য কী?

ওঁর সময়ের রচনার কত কিছুই যে হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হল তার কি কোনও হিসেব আছে? বলা হচ্ছে ১৫৬০ সাল থেকে (ওঁর জন্মের চারশ বছর আগে) ১৬৪২ সাল অবধি (ওঁর মৃত্যুর ছাব্বিশ বছর পর) যত যা নাটক লেখা হয়েছিল তার মাত্র এক ষষ্ঠাংশ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

শেক্সপিয়রকে যে আমরা পুরোটাই পেয়ে গেলাম তার কারণ দু’টো। এক, কবির কপাল (আমাদেরও), আর দুই, এতই সফল ও জনপ্রিয় তাঁর কাজ।

আরেকটি কারণও কিন্তু আছে। শেক্সপিয়রের জন্মের সময় থেকে পরের পঞ্চাশ বছরে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা তিরিশ লক্ষ থেকে বেড়ে পঁয়তাল্লিশ লক্ষে দাঁড়ায়। তাতে নাটকমনস্ক, বোঝদার দর্শকেরও একটা লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটে।

লন্ডন শহরও শেক্সপিয়রের জীবনে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মিলিত আশীর্বাদের মতো হয়েছিল। বলা বাহুল্য, বাণিজ্যের চাপ এবং ওজনদার, মেধাবী নাটকের দাবি দুটিই ওঁর উপর সমান ভাবে রেখে গেছে লন্ডন। নাটকের অভিনেতাদের কাজের পরিধি ও সেই কাজের সূক্ষ্মতা বাড়াতেও গোটা কর্মজীবনে তিনি নতুন, নতুন অভিজ্ঞতা ও চিন্তা নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছেন।

তাঁর জীবনীর পর জীবনী ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে, জীবনের তাবৎ পরিস্থিতি থেকে তিনি ক্রমান্বয়ে অন্তর্দৃষ্টি ও বিচার অর্জন করেছেন। মগজের ওঁর এই অনিঃশেষ উর্বরতাকে পাঠক, দর্শক ও অভিনেতারা কেবলই ‘অলৌকিক’ বলে থেমে পড়েননি, চেয়েছেন শৈল্পিক ও বৌদ্ধিক শক্তির চুড়ান্ত মিলন হিসেবে ব্যাখ্যা করতে।

আর তার পরেও যে প্রশ্ন ও রহস্যের সমাধান হল না তা তো উনবিংশ শতকের কবি ও সমালোচক ম্যাথু আর্নল্ড-এর ওঁকে নিয়ে সনেটেই ভাস্বর: ‘আদার্স অ্যাবাইড আওয়ার কোয়েশ্চেন, দাও আর্ট ফ্রি/ উই আস্ক অ্যান্ড আস্ক, দাও স্মাইলেস্ট অ্যান্ড আর্ট স্টিল/ আউটটপিং নলেজ।’ (‘আর সবাই আমাদের প্রশ্নের মুখে, তুমি স্বাধীন/ আমাদের শুধু জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা,/ আর তুমি? জ্ঞানসীমার উর্ধ্বে কোথাও/ স্মিতমুখে স্থির।’)

এই জ্ঞানসীমার ঊর্ধ্বে ওঠার সিঁড়িটা যে কী পৃথিবী সেই থেকে ভেবেই চলেছে। এত যাঁর নায়ক ও নায়িকা, খলনায়ক ও শয়তান, এত প্রেম, এত প্রেমিক, পোর্শিয়ার তর্কবিচার, রিচার্ড দ্য থার্ডের চক্রান্ত, হ্যামলেটের দ্বন্দ্ব, লেডি ম্যাকবেথের ক্রূর হিসেবনিকেশ, ওথেলোর ঈর্ষা, রোমিও-জুলিয়েটের নিষিদ্ধ মিলন কিংবা কিং লিয়রের করুণ দর্প....এই এত সব আসে কোত্থেকে, কী পড়াশুনো, কোন সংসর্গে, এর কী নিষ্পত্তি আমরা পাচ্ছি?

কবির ওই বহুচর্চিত ‘স্মল ল্যাটিন, লেস গ্রিক’ (সামান্য লাতিন, আরও কম গ্রিক) দিয়ে কী করে ‘জুলিয়াস সিজার’ বা ‘টাইমন অফ অ্যাথেন্স’ ফলে এ এক ব্রহ্মজিজ্ঞাসার মতো। রাফায়েল হলিনশেড-এর ‘ক্রনিকলস’ নামের ঐতিহাসিক গল্পমালা থেকে কী ভাবে ম্যাকবেথ নাটক ও চরিত্র বেরোয়, বাজারচলতি নাটক, লোকমুখে ধরা রহস্যকাহিনি বা প্রাচীন বৃত্তান্ত থেকে কী ভাবে উদ্ধার হয় ‘হ্যামলেট’ বা ‘কিং লিয়র’ এ অনুমান করাও মুশকিল।

শেক্সপিয়র কী পেলেন এবং তা নিয়ে অবশেষে কী করলেন, এই চিন্তাভাবনা থেকেই একটা শাস্ত্র দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা বরং ওঁর জীবনের দিকেই একটু তাকালে পারি।

এটা সত্যি, যে শেক্সপিয়র কোন রচনার কোনখানে যে তিনি নিজে অবতীর্ণ এ রহস্য রহস্যই রইবে। যদিও সমগ্র রচনাবলি জুড়ে সেই এক তিনিই তো নানা চরিত্রে, নানা সুরে, নানা মনে, নানা রকমে কথা বলে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁর জীবনের প্রলেপ কোথায়? এই সব যোগাযোগ, সংসর্গ নিয়েও শাস্ত্র গড়ে উঠেছে।

দুটি গল্প বলি।

শেক্সপিয়রের এগারো বছরের ছেলে হ্যামনেট (নামটা তাঁর প্রসিদ্ধতম নায়কের মতো শোনায় না?) মারা গেল।

অথচ বেন জনসনের মতো পুত্রশোকে কোনও রকম কাব্য করার দিকেই তিনি গেলেন না, যদিও মাঝেসাঝে বলা হয় যে ৩৭ নং সনেটে ‘অ্যাজ আ ডেক্রেপিট ফাদার টেকস ডিলাইট...’ (যেমন কোনও জীর্ণ পিতা হর্ষ পান....) তিনি নাকি ছেলের কথাই বলছেন। কে জানে!

তবে হ্যামলেটের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে পল্লির পুরোনো গির্জার মুখোমুখি বড়সড় বাড়িতে নিয়ে ওঠেন। স্ট্র্যাটফোর্ডের দ্বিতীয় বৃহৎ মকানটির জন্য কবিকে দাম গুনতে হয়েছিল ১২০ পাউন্ড। সময়ের বিচারে বেশ মোটা টাকা। অবশ্য ১৫৯৭-৯৮ সালে কবির অবস্থা খুবই ভাল। ‘নিউ প্লেস’ বাড়িটার সমস্যাও ছিল। দু’টো খুনের ইতিহাস সেখানে।

হিসেব করে নির্দয় খুনের যে চিত্র আঁকলেন শেক্সপিয়র তাঁর লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে, তাতে কিছুটা কি ছায়াপাত নিউ প্লেস-এর দুটি খুনের প্রথমটায়?

রাজা অষ্টম হেনরির ডাক্তার টমাস বেন্টলি ভাড়ায় থাকতেন বাড়িটায়। বাড়ির মালিক ক্লপটন থাকতেন ইতালিতে। তো ডক্টর বেন্টলি মারা যেতে দেখভালের অভাবে করুণ হাল হল বাড়ির। এই সুযোগে ১৫৬৩ নাগাদ বাড়িটা কব্জা করল জনৈক উইলিয়ম বট।

পাড়ার মুচি হোয়েলার-এর জবানি মতে বট তার কন্যাকে ওই বছরেই খুন করে ওখানে। কেন এবং কী করে? বলা হচ্ছে যে ইসাবেলার স্বামীর সম্পত্তি ছিল বাড়িটা এবং ওর বাবা বট বহুত চালাকি করে একটা দলিল নকল করে, যেখানে বলা হল যে ইসাবেলা যদি নিঃসন্তান থেকে মারা যায় তাহলে সম্পত্তি যাবে ওর বাবা উইলিয়ম বট-এর হাতে। স্বামীর দখলে নয়।

মুচি হোয়েলার স্বচক্ষে দেখেছিল বট পানীয়ে বিষ মিশিয়ে মেয়েকে খুন করছে। বৃত্তান্তটা আরও ক’জন সমর্থন করেছিল, কিন্তু খুনের মামলা রুজু হয়নি। কারণ ইসাবেলার স্বামী টের পেয়েছিল যে শ্বশুর বট তাহলে ওকে আইনের গেরোয় গেরোয় সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। বট বাড়িটা বিক্রি করেছিল উইলিয়ম আন্ডারহিলকে। যাঁর পুত্র, যাঁরও নাম উইলিয়ম আন্ডারহিল, বাড়িটা বেচলেন শেক্সপিয়রকে। বিক্রেতা আন্ডারহিল একেবারেই সুবিধের লোক ছিলেন না, তবে তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র ফুক বজ্জাতিতে বাপকে ছাড়ায়। সে বিষ খাইয়ে বাপকে মারল এবং দাবি করল বাবা মৌখিক ভাবে জমি, বাড়ি সব তাকে দিয়ে গেছেন।

১৫৯৯-এ ফুক আন্ডারহিল-এর (তত দিনে প্রাপ্তবয়স্ক) ফাঁসি হল এবং ১৬০২-এ তার ভাই হার্কিউলিসের হাত থেকে শেক্সপিয়র অবশেষে বাড়ির ন্যায্য কাগজপত্র হাতে পেলেন। ভোগান্তি পোহাতে হল প্রচুর, কিন্তু কবির আসল লাভটা অন্যখানে।

বট ও আন্ডারহিলের কেচ্ছাকাণ্ড থেকে তিনি গার্হস্থ্যখুনের আদিম আক্রোশ ও অন্তর্লীন ঘৃণাস্রোতের ছবি পাচ্ছিলেন। ঘটনার যা-যা তিনি জানতে পেরেছিলেন বট এবং আন্ডারহিল সংক্রান্ত সে সবকে তিনি এক মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা দিলেন তাঁর প্রসিদ্ধতম এবং সম্ভবত, সেরা নাটক ‘হ্যামলেট’-এ যা লেখা হল একেবারে ওই সময়েই, ১৫৯৯-১৬০০ খ্রি।

‘হ্যামলেট’-এর খুনগুলো ঠিক ওভিদ পাঠ থেকে উঠে আসে না, কবির ‘টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস’ নাটকের খুনের মতো হয় না। বরং সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আর অতুলনীয় বিচার ও কল্পনাশক্তির মিশেলে এক দুরন্ত বাস্তব হয়ে ওঠে।

অফুরান অর্থ, কূটার্থ, স্ববিরোধ, চূড়ান্ত ও বিহ্বলকর সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন ‘হ্যামলেট’ কিন্তু বহু ঝুঁকি নিয়ে গড়া এক সৌধের মতো। দর্শককে বিভ্রান্ত করেও প্রথম থেকেই বিপুল জনপ্রিয় এই নাটক। যার মধ্যে বোদ্ধারা থেকে থেকে ব্যক্তি শেক্সপিয়রের স্বর শুনতে পেয়েছেন। নানা নাট্যে ইস্কুলজীবন, প্রেম, বিবাহ, নাট্যমহল ইত্যাদির বাস্তব ছোঁওয়ার পাশাপাশি ‘হ্যামলেট’-এ অন্তত খুনের বাড়ি নিউ প্লেস-এর অনুপ্রবেশ নিয়ে ভাবার কিন্তু যথেষ্ট কারণ।

অবশ্য শেক্সপিয়র নিয়ে ভাবার জন্য মালকোঁচা বেঁধে মাঠে নামার উদ্যোগ নিতে হয় না কোনও দেশেই। শিশুকাল থেকেই সব দেশের ছেলে-মেয়েরা শুনে আসে যে সেরা প্রেমের গল্প ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, সেরা খুনের গল্প ‘ম্যাকবেথ’, সেরা ভূত ও গোয়েন্দা গল্প ‘হ্যামলেট’ এবং সব চেয়ে কষ্টের গল্প ‘কিং লিয়র’। দেশে দেশে বুলিতে বুলিতে রক্তে রক্তে শেক্সপিয়র।

আমার অধ্যাপক এবং ‘দ্য স্টোরি অফ ক্যালকাটা থিয়েটার’-এর লেখক সুশীল মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘জানো তো, কী ইংরেজিতে কী বাংলায় শেক্সপিয়র মঞ্চস্থ করা বামুনের ছেলের পৈতে হওয়ার মতো। আর এও বলি, সব নাটককরিয়ের কাছে শেক্সপিয়র হলেন হ্যামলেটের বাবার ভূতের মতো। রেহাই নেই।’

শেক্সপিয়র কী ভাবে আমাদের স্পন্দনে তার এক ছোট্ট গল্প শোনাই। সময়টা নকশাল আন্দোলনের। বোমাবাজি লেগেই আছে কলেজ স্ট্রিট মহল্লায়। তারই মধ্যে সন্ধেবেলায় প্রেসিডেন্সি কলেজের এম.এ পড়ুয়াদের ‘কিং লিয়র’-এর ক্লাস নিতে আসেন পণ্ডিতকুলমণি অধ্যাপক তারকনাথ সেন। প্রেসিডেন্সির লাইব্রেরির গায়ে এক কিউবিকলে আমরা বারো জন ছাত্রছাত্রী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওঁর ‘লিয়র’ পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনি। আমাদের জানা যে শেক্সপিয়রের সংলাপে শর্ট লাইনজ বা হ্রস্ব পঙ্ক্তির উপর ওঁর এক বিস্ময়কর রচনা আছে।,

তো সেই সন্ধ্যায় তারকবাবু নিবিড় ধ্যানে পড়ে যাচ্ছেন লিয়রের সংলাপ থেকে, যেখানে রাজা নিজের দুর্গতিতে খেদ করছেন প্রিয় সহচর বিদূষকের কাছে। বলছেন-

“ডাজ এনি হিয়র নো মি? দিস ইজ নট লিয়র:
ডাজ লিয়র ওয়াক দাস? স্পিক দাস? হোয়্যার আর হিজ আইজ?
.............
হু ইজ ইন দ্যাট ক্যান টেল মি হু আই অ্যাম?।”

তারকবাবু এত দূর অবধি এসেছেন যখন, গোটা কলেজ স্ট্রিট কাঁপিয়ে বিশাল একটা বোমা ফাটল। মুহূর্তের জন্য দিনের মতো ফর্সা হয়ে উঠল চারধার, কিউবিকলও কাঁপল। তারকবাবু কয়েক মুহূর্তের জন্য রোসলেন, চুপ রইলেন, বুঝি বা মাত্রা গুনলেন। তারপর ইত্যবসরে কিচ্ছু হয়নি, এমন ভাব করে ফুল বা ভাঁড়ের সংলাপের শর্ট লাইনে চলে গিয়ে বললেন“লিয়রজ শ্যাডো।”

‘আমি কে?’ এই গভীর, বিস্তৃত প্রশ্নের ছোট্ট, রসিক, নির্মম উত্তর ‘লিয়রের ছায়া’।

অন্য ঘটনাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙা বিল্ডিঙে ইংরেজির এম এ ক্লাসে। বসন্তের সকালে পঞ্চম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের এক ঘণ্টা অভিভূত করে রাখলেন অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। তাঁর অতুলনীয় ‘কিং লিয়র’ পড়ানো দিয়ে।

লিয়রের জারজ সন্তানের স্বগতোক্তি পড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর ঠোঁটে সেই উচ্চারণ ‘দিস ইজ দ্য এক্সেলেন্ট ফপারি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ আজও কানে বাজছে। তারপর ঘণ্টা পড়তেই বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে এই শেষ ক্লাস। এবার একটু অন্য পাড়ায় কাজ করতে হবে।’ সেই অন্য পাড়াটা রাইটার্স বিল্ডিং, যেখানে তিনি তথ্যমন্ত্রী হয়ে যোগ দিতে গেলেন। ওঁর ছাত্রছাত্রীরা সবাই আমরা ভেতরে ভেতরে হাহাকার করছি।

অনেক দিন পর গল্প করতে করতে একদিন সেই দিনের কথা বলতে স্যর ওঁর স্বভাববিনয়ে বলেছিলেন, ‘ও ক্রেডিট শেক্সপিয়রের। একটু বুঝে, ভালবেসে উচ্চারণ করলে হিজ ম্যাজিক টেকস ওভার।’

আসল কথাটা হল ম্যাজিক। এই যে ওঁর ম্যাকবেথকে অবলম্বন করে হিন্দি ছবি হল ‘মকবুল’ কী ‘ওথেলো’ অবলম্বনে হল ‘ওম্কারা’, সেখানেও তো সেই সাড়ে চারশো বছর বয়সি সাহেবের ম্যাজিক। কিংবা পরিণত বয়সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলায় ‘রাজা লিয়র’ করে দুনিয়াকে তাক খাইয়ে দেওয়া। কবির কালে রিচার্ড বার্বেজ যে কত বড় অভিনেতা তা ধরা পড়ত কী করে ‘কিং লিয়র’ লেখা না হলে?

তেমনি বাংলায়ও সৌমিত্রর পূর্ণ আত্মপ্রকাশের জন্য দরকার ছিল একটা ‘রাজা লিয়র’। কথায় কথায় আমাকে বলেওছিলেন, ‘বয়স পেরিয়ে যাওয়াতে হ্যামলেট তো আর করা হল না। তাই শেক্সপিয়র করার সুযোগ বলতে ছিল লিয়র।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মৃত কন্যা কর্ডেলিয়াকে বুকে ধরে বৃদ্ধের ওই কান্না ‘নেভার, নেভার, নেভার, নেভার!’ এর বাংলা ‘কখনও না কখনও না কখনও না....’ উচ্চারণ কি ধরে রাখেন শো থেকে শো-এ?’ বললেন, ‘না, না, কত কত ভাবেই তো বদলে যাচ্ছে সারাক্ষণ!’

শেক্সপিয়র বলেই না কথা! এত বৈচিত্র, গভীরতা, সংরাগ তাঁর বাণীতে যে তাঁদের কোনও অটল মূর্তি রচনা হবার নয়। মানুষের মনের মতোই ওঁর কথামালা, সারাক্ষণ বদলে বদলে অভিনব হচ্ছে। চারশ’ বছর ধরে এক অপরূপ সমকালীন লেখক। ইদানীং তো আরও এক সামাজিক লক্ষণ ধরা পড়ছে নিজের সময়ের আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করতে শেক্সপিয়রে ফিরতে হচ্ছে। বাজ লুরম্যান যেমন আজকের প্রেমের ছবি ফোটাতে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও-কে নিয়ে তুললেন নয়া আঙ্গিকে ‘রোমিও জুলিয়েট’।

তাঁর সিনেমায় দু’দুবার শেক্সপিয়রে আশ্রয় নিয়েছিলেন সিনেমার ‘শেক্সপিয়র’ আকিরা কুরোসাওয়া। কেরিয়ারের প্রথম ভাগে ম্যাকবেথকে জাপানি আদলে গড়ে ‘থ্রোন অফ ব্লাড’-এ। আর ফিল্ম জীবনের প্রান্তে এসে ‘কিং লিয়র’ অবলম্বনে ‘রান’ ছবিতে। হায়, হায়, কী ভয়ানক সুন্দর, মর্মভেদী ও মহৎ কাজ যার প্রশংসার শেষ দূরে থাক, শুরুই করা যায় না।

লরেন্স ওলিভিয়ে, জন গিলগুড, পল স্কোফিল্ড, রিচার্ড বার্টন বা পিটার ও টুল-এর শেক্সপিয়র অভিনয় দেখে যা হয় সেটাই ন্যায্য প্রতিক্রিয়া। প্রথমে স্তম্ভিত হওয়া, পরে শয়নে স্বপনে সেই দৃশ্যে, সেই ধ্বনিতে, সেই রহস্যে ফিরে যাওয়া।

এই ফেরার একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি। লন্ডনের থিয়েটার হলে হ্যামলেটের ভূমিকায় নেমেছেন রিচার্ড বার্টন। মাঝে মাঝেই সংলাপ বলতে গিয়ে খেয়াল করছেন যে হলের প্রথম সারির থেকে কে এক জন অতি মৃদু স্বরে ওঁর সঙ্গে সংলাপ গেয়ে যাচ্ছেন। এতটাই নিখুঁত ও সুরে যে ভেতরে ভেতরে হয়তো তারিফও করে ফেলেছেন।

শো শেষে গ্রিনরুমে এসে খবর পেলেন যে কণ্ঠস্বরটি ছিল স্যর উইনস্টন চার্চিলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE