Advertisement
E-Paper

আরেকটি লাস্ট বেঞ্চের গল্প

লিখছেন শতরূপা সান্যাল

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ১২:১৫

একে মিশনারি, তায় মেয়েদের। নিয়ম, নীতিতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা।

সকালে স্কুল শুরু হত প্রভুর প্রার্থনা দিয়ে। বিকেলে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ‘নমস্কার’ দিয়ে শেষ। যাতে নিয়মনিষ্ঠ ভাল মেয়ে হয়ে উঠতে বাধ্য হই। কিন্তু নিয়ম ভাঙার যে আনন্দ, তা তো কোনও পাঠ্যপুস্তকে নেই। কেউ শিখিয়ে পড়িয়েও দেয় না।

তবে এই ভাঙার দলে যে শুধু লাস্টবেঞ্চাররা থাকত, তা নয়। আসলে আমাদের বসার জায়গাগুলো ঠিক করে দেওয়া হত কে কত মাথায় বড়, তাই দিয়ে। ফলে ক্লাসের এক্কেবার ‘বিচ্চুয়েস্ট দ্য গ্রেট’-ও এক-দুই-তিন নম্বর সিটে বসতে বাধ্য হত। যে কারণে বিচ্চুমির কোনও নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র ছিল না।

পাশেই স্কটিশ কলেজ। কো-এডুকেশন। অনবরত জোড়ায় জোড়ায় হাঁটাহাঁটি চলতই। সুতরাং ওদিকের জানলা দিয়ে তাকানো-ও বারণ। তা’ও ওটাই যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ধাম। কিন্তু ঘাড় ঘোরালেই শাস্তি। এক তলায় যেখানে বাবা-মায়েরা এসে দাঁড়ান ছুটির পর, সেখানে একটা ঘড়ি ছিল। তার তলায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত।

সংস্কৃত খাতা না আনাটা ছিল মহা পাপ। এ ঘটনা ঘটলেই অনিবার্য ঠিকানা হয়ে উঠত ঘড়ির তলা। কোনও কোনও ক্লাসে দল বেঁধে ক্লাসের বাইরে মেয়েদের বের করে দিলে তো উৎসব! ভিতরে লক্ষ্মী মেয়েরা তখন শব্দরূপ-ধাতুরূপ আওড়াত।

টিফিনের পরের ক্লাসগুলোয় গুলতানি একটু বেশিই হত। তার স্বরও থাকত চড়া। তাতে নাকি স্কুলের সম্ভ্রমহানি হচ্ছিল। নিদান দেওয়া হল, মেয়েরা টিফিনের পর মুখে জল নিয়ে ঢুকবে। টিচার ক্লাসে ঢুকলে তবে সেই জল তারা গিলবে।

টিফিন শেষে হুটোপুটি পড়ে গেল। ঘণ্টা বাজল কি, জলের ট্যাঙ্কে লাইন। এক ঢোঁক জল মুখে নিয়ে দে-ছুট ক্লাসের দিকে।

মাঝে মাঝেই টিচার ক্লাসে ঢুকে মুখ হাঁ করিয়ে দেখে নিতেন, জল আছে কি নেই। না থাকলেই স্ট্রেট ঘড়ির তলা। ওই জল-পর্বে গুলতানি কমল বটে, কিন্তু শরীরগুলো এর-তার মুখের জলে প্রায়ই ভিজে কাক হয়ে যেত। ক্লাস, ক্লাসের সামনে জল থই থই। এই জলকেলিতে যে যত সূক্ষ্ম পথে নিয়ম ভাঙত, সে তত হিরো, মানে হিরোইন। শেষে টিচাররাই রণে ভঙ্গে দিলেন। তখন আমাদেরও অবাক জলপানের ইতি।

আরেক বার। সে বারও ওই হট্টগোলের জেরে বিধান হল, তিন তলা থেকে সার বেঁধে সব মেয়ে এক তলায় নামবে মুখে আঙুল দিয়ে, আবার উঠবে, আবার নামবে। কোনও শব্দ করা চলবে না। এমনকী কাঠের সিঁড়িতেও আওয়াজ হলে চলবে না। আমরা নির্দেশ পালন করে চলেছি নিঃশব্দে। অবশ্যই শিক্ষিকার সামনে। আড়াল হলেই ফিসফাস, হাহাহিহি। হঠাৎ উপর থেকে এক শিক্ষিকার গলা, ‘ঠিক এই রকম থাকবে। টুঁ শব্দটা যেন না শুনি।’ ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে জোরালো ‘টুঁ-উ-উ-উ’ শব্দে মিশনারি স্কুলের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

‘কে করল? কে করল?’ আর কে! কেউ মুখ খোলে না। টিচারদের গায়ে ভাল হয়ে লেপ্টে থাকা মেয়েরাও চুপ। কিছুই বলে না। ফল? তিন দিন পুরো সাসপেন্ড।

নষ্টামির আর একটি অঙ্গ টিচারের নামকরণ। বিচিত্র সব নামসিংহীমামি, শ্যাডো পিসি, কুঁজি বুড়ি, সুজি বুড়ি, কাকতাড়ুয়া।

ভূগোল স্যারের যে নাম হয়েছিল, সেটা আজও মনে আছে। আসল নামটা ভুলে গেছি। দুটোই অবশ্য উহ্য রাখছি, তাঁর সম্মানার্থে। বিশেষ বকাবকি করতেন না। পরতেন ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। একবার তাঁর চেয়ারে ফাউন্টেন পেনের কালি ঢেলে রেখেছিল কেউ। বসামাত্র তা লেপটে গেল সাদা কাপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বলে তিনি ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা তাঁর ওই অহিংস অসহযোগে ভয় তো পেলামই না, উল্টে আরও উল্লাসে গল্প শুরু হয়ে গেল।

হঠাৎ হাজির হলেন বড়দি। অনেকক্ষণ বকাবকি চলল তাঁর। শেষে বললেন, ‘সবাই একে একে গিয়ে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করো।’

সবাই নির্দেশ পালন করা শুরু করে দিল। স্যার খুব ভারী মুখ করে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ‘উফফ্’ বলে ছিটকে উঠলেন তিনি। কোন এক রত্ন ভিড়ের মধ্যে পায়ে ক্ষুদ্র একটা চিমটি দিয়ে সরে পড়েছে।

স্কুলে বকুনি খাওয়ার সময় চোখ থাকবে নীচে। কিন্তু মাধবী ছিল অন্যরকম। পড়ার চেয়ে খেলার দিকেই ওর নজর বেশি। দুর্দান্ত গানের গলা। ঘটনা হল, গান-কবিতা-নাটক-ইন্টার স্কুল কম্পিটিশনে যারা টেক্কা দিত, তাদের বেশির ভাগই ছিল বেচালের পাণ্ডা।

মাধবী একবার টিফিনের সময় দুদ্দাড়িয়ে দৌড়তে গিয়ে হলঘরের জানলার কাচ ভেঙে ফেলল।

দারোয়ান সোজা মাধবীকে টেনে নিয়ে হাজির করল বড়দির সামনে। গোটা স্কুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছে কী শাস্তি হবে মাধবীর! আমরা দেখছি, বড়দি ওকে শান্ত হতে, লক্ষ্মী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন আর মাধবী প্যাট প্যাট করে সোজা তাকিয়ে বড়দির দিকে। বুঝিয়ে কোনও কাজ হচ্ছে না দেখে বড়দি হাল ছেড়ে দিয়ে শেষে বললেন, ‘জানো, তোমায় এর জন্য অনেক টাকা ফাইন দিতে হবে?’

মাধবী তার খুচরো পয়সায় বোঝাই স্কার্টের পকেটের উপর হাত চাপড়ে চাপড়ে ঝন ঝন আওয়াজ তুলে বলল, ‘কত দিতে হবে?’ এর পর স্বাভাবিক ভাবেই ওর শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

তাতেও মাধবীর ভ্রুক্ষেপ ছিল কি? একেবারেই না। মাধবীরা যে চিরকাল এমনই হয়!

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy