মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ? সাদা কালো ‘কলকাতা ৭১’ আমার এক নকশাল বন্ধু আমাকে জোর করে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। মেট্রো সিনেমা-তে। আমি তখন সদ্য দার্জিলিঙের সাহেবি ইস্কুল থেকে ৭০-এর দশকে কলকাতার গরম আর রাগের মধ্যে এসে হাবুডুবু খাচ্ছি। গাঁজা আর ‘রক অ্যান্ড রোল’ আমার জগৎ। হিংসার রাজনীতি কেন, কোনও রাজনীতিতেই বিশ্বাস করি না। দুটো সত্যজিৎ রায় দেখেছি। ঋত্বিক ঘটককে জানি না। মৃণাল সেনের ছবিটা আমার ১৭ বছরের মনটাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। এর আগে এত স্টাইলিস্ট বাংলা ছবি আমি কখনও দেখিনি।
দ্বিতীয় বার। মৃণাল সেন দক্ষিণ কলকাতার কোনও এক থিয়েটার হল-এ অন্ধকারে বসেছিলেন। আমি মঞ্চের উপর আমার প্রথম বাংলা নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে বার বার সংলাপ ভুলে যাচ্ছিলাম।
তৃতীয় বার ‘অ্যালিয়ঁস ফ্রঁসেইজ্’-এর ডিরেক্টরের ঘরের এক কোণে গাঁজা খেয়ে হাঁদার মতো বসেছিলাম। মৃণাল সেন আর ডিরেক্টর সাহেব ‘একদিন প্রতিদিন’-এর সাবটাইটেল নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
বেশ কয়েক বছর পর আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে বললেন, ‘মৃণাল সেন অ্যালিয়ঁস ফ্রঁসেইজ্-এর ঘরের সেই রোগা ছেলেটার খোঁজ করছেন।’ আমি তখন সাংবাদিকতা ছেড়ে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে পিটার ওয়াইস-এর ‘মারাট/সাড’ করতে ব্যস্ত। মহড়ার পরে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “সিনেমায় নামবে?”
মৃণাল সেন আমার লম্বা চুল কেটে দিয়ে, তাতে তেল মাখিয়ে, আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে কথা বলবে না, আর কিছু দিনের জন্য ইংরিজি একদম বন্ধ।’
আমি কলকাতার রাস্তায় দৌড়ে, চলন্ত ট্রামে বাসে উঠে বেড়ালাম। পেছনে কে কে মহাজনের হাতে অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা। কুড়ি দিনের মধ্যে সব শেষ। আমি হুশ করে পৌঁছে গেলাম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল! রবার্ট ডি নেরো আর রবার্ট দুভাল-এর সঙ্গে একই বারে বসে মদ খেলাম। আমার অসম্ভব প্রিয় দানিয়েল অলবরচুস্কির (পোলিশ ফিল্ম স্টার) সঙ্গে আড্ডা মারলাম।
অনেকটা হুইস্কি খেয়ে লিডো বিচে শুয়ে রাতের আকাশ দেখলাম। ফেস্টিভ্যালের শেষে একটা পুরস্কারও পেয়ে গেলাম...। মৃণাল সেন তার আগের বছরই বার্লিনে ‘সিলভার বিয়ার’ পেয়েছিলেন। তাই প্রযোজক একটা বড় প্রাইজের আশা করে। তা না পেয়ে, গম্ভীর হয়ে গেল। আমি তাকে খুন করার একটা প্ল্যান করেছিলাম। মৃণাল সেন আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার সব রাগ ভুলিয়ে দিলেন। সেই থেকে মৃণাল সেন আমার মৃণালদা হয়ে গেলেন। আর আমার সামনে গোটা দুনিয়ার সিনেমার দরজাটা খুলে গেল।
আমি: কলকাতা শহরটাকে আজ কেমন লাগে?
৯২ বছরের মৃণালদা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
মৃণালদা: ওই মাতলামিটা কি আর আছে?
আমি: কীসের মাতলামি?
মৃণালদা: তর্ক, ঝগড়া, আর্গুমেন্ট, আবার বন্ধুত্ব, আড্ডা... তোমাদের মধ্যে হয় এ সব?
আমি: আমি চেষ্টা করি... সব সময় পারি না, অন্যরা দুঃখ পাবে, ভুল বুঝবে তাই।
মৃণালদা: অনেক দল হয়ে গেছে। নাটকের দল... অমুক দল... আমাদের তো কোনও দল ছিল না। তাই যা প্রাণ চায় করেছি। সিনেমা করাটা শহরের বাদবাকির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল।
মৃণালদার স্ত্রীকে গীতাদি বলে থাকি।
গীতাদি: তখন আমাদের প্রচণ্ড অভাব। তোমার মৃণালদা, ঋত্বিকবাবু, তাপস সেন, খালেদ চৌধুরী, বংশী চন্দ্র গুপ্ত। আমরা কোন একটা বিদেশি সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছি। হেঁটে ফিরছি কারণ পয়সা নেই। ঋত্বিকবাবু বললেন, ‘গীতা তোমাকে একটা গল্প বলি, হাঁটতে হাঁটতে শুনতে মন্দ লাগবে না।’ জোয়ান অব আর্ক-এর গল্পটা বললেন ঋত্বিকবাবু। শুনতে শুনতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম জানি না।
আমি: আবার আমার যখন প্রচণ্ড অভাব চলছে, মৃণালদা লুকিয়ে আমার পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিতেন। জানতেন আপনি গীতাদি?
মৃণালদা: সিগারেটও। এখনও খাচ্ছো?
আমি: ছাড়তে পারছি না। আপনি কী করে ছাড়লেন বলুন তো?
মৃণালদা: আমি তো ধোঁয়াটা গিলতাম না কোনও দিন। স্রেফ ফুঁক ফুঁক করে বার করে দিতাম। বরং গীতা সিগারেট না ধরিয়েও বেশি ধোঁয়া খেত।
মৃণালদা লিন্ডসে অ্যান্ডারসনকে ‘লিন্ডসে’ আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকোয়েজকে ‘গ্যাব্রিয়েল’ বলে ডাকতেন। তাঁর পুত্র কুনাল মৃণালদাকে বাবা নয়, ‘বন্ধু’ বলেই ডাকে। আমরা যারা যারাই মৃণালদার সংস্পর্শে এসেছি, উনি আমাদের ভেতরের আগুনটাকে উসকে দিয়েছেন, সর্বক্ষণ। মৃণালদা আজ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে র্যাডিকাল মানুষ, যিনি নিজে কম্যুনিস্ট হয়েও কোনও দিন পার্টিতে নাম লেখাননি, বরং পার্টি থেকে বিতাড়িত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমার মতো একজন ‘নন কম্যুনিস্ট’-কে নিজের ছেলের মতো আপন করে নিয়েছেন খুব সহজে। কখনও মনে হয়নি আমি শুধু ওঁর অভিনেতা।
মার্কিন সমালোচক স্ট্যানলি কফনান যখন ‘খারিজ’ দেখে আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন, মৃণালদা বললেন, “তোমার মধ্যে বড্ড ম্যানারিজম। বেলমন্ডোকে দেখো, কী স্বাভাবিক, অথচ কী রোম্যান্টিক!” অনেক দিন পর ‘অন্তরীন’-এর ‘রাশ’ দেখে উনি লাল চোখে আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, “হচ্ছে, এ বার হচ্ছে।”
১৯৮৯, সারা বিশ্বে সমাজবাদ, বার্লিনের দেওয়ালের মতো মুড় মুড় করে ভেঙে পড়ল। আমার একটা নাটকের খোলনলচে বদলে দিয়ে উনি বানালেন ‘মহাপৃথিবী’। শরীর খারাপের জন্য ওঁর বদলে আমিই গেলাম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সদ্য মুক্তি পাওয়া পূর্ব জার্মানির সাম্যবাদী বিরোধী মানুষ আমাকে সেমিনারে চূড়ান্তভাবে আক্রমণ করল। আমি কোথা থেকে যেন শক্তি পেয়ে আমাদের পশ্চিমবাংলার অজস্র নকশালপন্থী, যারা আন্দোলনের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তাদের হয়ে প্রচণ্ড লড়াই করলাম। সাফ জানিয়ে দিলাম, তোমরা যাই ভাবো, যা কিছুই বলো, তাদের কথা আমি বা আমার নির্দেশক ভুলতে রাজি নই। তাদের কথা ফের মনে করিয়ে দেবার জন্য এই সময়ে এই ছবি। সে অধিকার আমার আছে। কিছু জার্মান দর্শক আমার হয়ে প্রচণ্ড তর্ক শুরু করে দিল। সেমিনার ঘুরে গেল। সেদিন রাতে অনেকটা মদ্যপান করে কুরফুরস্টারডামের রাস্তায় বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি চিনতে পেরেছিলাম মৃণালদাকে নতুন করে। বুঝেছিলাম কতটা ব্যতিক্রমী তিনি।
গীতাদি: আচ্ছা অঞ্জন, মনে আছে ডাক্তার যখন তোমার মৃণালদাকে বলেছিল রোজ একটু করে ব্র্যান্ডি খেতে, তুমি রোজ সন্ধেবেলা আসতে...
মৃণালদা: বোতলের অর্ধেকটা তুমিই সাবাড় করতে। আমি এক চামচ...
আমি: এখনকার প্রজন্মের ডিরেক্টরদের কাজটাজ দেখেন?
মৃণালদা: এখন তো আর বেরুতে পারি না।
আমি: শেষ কার কাজ ভাল লেগেছে?
মৃণালদা: কৌশিক... গাঙ্গুলি...শব্দ...বেশ সাহসী...
আমি: আর?
মৃণালদা: আমি ভুলে যাই। সব ঠিক মনে পড়ে না।
আমি: সম্প্রতি সৌমিত্রদাকে নিয়ে একটা ছবি করলাম। আপনার কথা রোজ হত।
মৃণালদা: কী কথা?
আমি: রোজ শু্যটিং-এর পর, সেই আপনার গাড়িতে উঠে পড়ে বেলতলার বাড়িতে রোজ আড্ডা!
মৃণালদা: মানিকবাবু আমাকে বলেছিলেন, একটা গোটা স্ক্রিপ্ট ছাড়া কী করে ছবি বানান আপনি? আমি বলেছিলাম, ‘হয়ে যায়।’ ঘর, দোর, অভিনেতা, অভিনেত্রী, আলো, ক্যামেরা, সব একত্র হলে একটা এনার্জির জন্ম নেয়। শ্রীলা, গীতা ... নিজেদের মতো করে সিন-এর সংলাপ বলত... আমি শুনতাম... দেখতাম... টুকরো টুকরো করে শু্যট করে নিতাম। এ ভাবেই হয়। সিনেমা আমাদের ভেতরেই আছে। রোজকার জীবনের মতো সিনেমা নিয়ে আমরা ঘুরেছি, বেঁচেছি। তুমি এ ভাবে বানাও না এখন?
আমি: না। প্রডিউসারকে গোটাটা আগেই শোনাতে হয়।
মৃণালদা: টাকা তুলে দিতে পারো?
আমি: সব সময় নয়।
মৃণালদা: আমরাও পারিনি। কিন্তু একটা হইচই হত। তর্ক, ঝগড়া... লেখালেখি... এ দেশে না হলে বিদেশে। কান...বার্লিন... ভেনিস...
আমার ‘বো ব্যারাকস্ ফর এভার’ দেখে মৃণালদা দারুণ খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। ছবিটা ভাল বলে নয়। মাত্র চল্লিশ লাখ টাকায় করতে পেরেছি বলে।
মৃণালদা: এখন কত টাকা খরচ করছ?
আমি: আমি তো ৯০ লাখের নীচে নামতে পারছি না।
মৃণালদা: খেয়েছে...!
মৃণালদাকে যত বার প্রশ্ন করেছি ‘আমার সিনেমা কেমন?’ মৃণালদা বলে এসেছেন, “ভাল খারাপ বড় নয়। একটা চঞ্চল ব্যাপার আছে। ভুলেও কখনও পরিপাটি সিন্থেটিক সিনেমা বানিও না। আর কম খরচে। ভাল সিনেমা বেশি টাকা দিয়ে হয় না। এক্সপেরিমেন্ট করার স্বাধীনতা চলে যায়।”
গীতাদি: এক বার হেমন্তবাবুর দৌলতে তোমার মৃণালদাকে বম্বে যেতে হল। ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটার জন্য তোমার মৃণালদাকে বাছা হয়েছিল। তাপস সেনের কাছ থেকে দুটো পাজামা আর অনুপকুমারের পাঞ্জাবি ধার করে তোমার মৃণালদা বম্বে চলে গেল। ওখান থেকে ফোন করে বলল, “গীতা, মনে হয় এ বার কিছু টাকা পাব। ধারদেনা মিটবে। গপ্পোটা তেমন কিছু নয়। প্যাচপ্যাচে... তবে কিছু একটা দাঁড় করানো যাবে।”
মৃণালদা: দাঁড়িয়ে যায়। ওই ভাবে ভাঙাচোরা করতে করতে, প্রথা ভাঙতে ভাঙতে দাঁড়িয়ে যায়। বিশ্বাস আর ভেতরের উন্মাদনা। মনে পড়ে...খারিজ? সন্তানহারা বাপ যখন শ্মশান থেকে ফিরে আসে? তুমি সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছ। বাপ তোমার দিকে এগিয়ে যায়। তোমাকে বলতে হয়নি। তুমি এক পা পিছিয়ে গেলে। তুমি বাড়ির মালিক। বাচ্চাটা মারা গেছে তোমার অবহেলার জন্য। বাপ এগিয়ে আসে... তারপর হাত জোড় করে তোমাকে বলে, ‘চলি বাবু।’ চলে যায়। মনে আছে?
আমি: হ্যাঁ, মনে আছে। আপনি কান-এ পুরস্কার নিতে যাওয়ার সময় আপনার সঙ্গী হতে পারিনি। আমি তখন বার্লিনে থিয়েটার করছি।
মৃণালদা: আরে আমার কিছু রাগী, অনুরাগী আমায় বলেছিল, খারিজ-এ ছেলেটার বাবা একটা থাপ্পড় মারল না কেন বাড়ির মালিককে? আমি বলেছিলাম, থাপ্পড়টা আপনার গালে মারতে চেয়েছি... হয়ে যায়। ভেতরের দুঃখবোধ, রাগ, অসহায়তা নিয়েই চলেছে। এ ভাবেই হয়।
আপনারা হয়তো জানেন এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকায় বানানো মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ গোটা ভারতকে চমকে দিয়ে ছিল। হয়তো জানেন না যে, মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্কোরসিসি তাঁর ‘খণ্ডহর’ ছবিটা আর্কাইভ করে রাখছেন বিশ্বের বাছাই করা কিছু সিনেমার মধ্যে। আজ মৃণালদা সে সব কথা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হয় না। বরং তাঁর ফেলে আসা যুবক বয়সের কলকাতা নিয়ে বেশি কথা বলতে চান।
মৃণালদা: তোমার কেমন লাগে কলকাতাকে?
আমি: উত্তর কলকাতা এখনও বেশ মজার। মাঝে মাঝে যাই। বাগবাজার, নিমতলা, হাতিবাগান, হরি ঘোষ স্ট্রিটের সরু সরু অলিগলি। এখনও অনেকে রাস্তায় আড্ডা মারে, নেড়ি কুকুর, অভাব অনটনের মধ্যে দারুণ পুরনো সব বাড়ি...
মৃণালদা: আমাদের সিনেমাটা এই শহরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সব কিছুর মধ্যে মিলে মিশে।
আমি: যদি আবার কোনও ম্যাজিক করে ৬০ বছর পিছিয়ে যেতে পারতেন? সেই ঋত্বিকবাবু, সলিলবাবু, তাপসদা, বংশীচন্দ্র গুপ্ত, খালেদদা, সেই অভাব, লড়াই... পাগলামি... আইপিটিএ...কী করবেন? সিনেমা?
মৃণালদা: জানি না...
আমার মৃণাল সেনের এখন আর অনেক কথা সহজে মনে পড়ে না। তবুও আমার মৃণালদা’র চোখমুখ সাদা কালো ‘কলকাতা ৭১’-এর মতোই চঞ্চল।
আমার মাস্টারমশাই এবং বন্ধুকে তাঁর ৯২ বছরের জন্মদিনে আমার অজস্র ভালবাসা আর সেলাম।
ছবি: কৌশিক সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy