Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ২...

গরম ভাট অথবা নিছক বুথের গল্প

চ্যানেলে-চ্যানেলে টক্কর। গরমে-নরমে বিনোদন সাড়ে চৌষট্টি ভাজা। ভোটের রেজাল্ট যে! গেরস্থের পঞ্চবার্ষিকী মেগা ইভেন্টে উঁকি দিলেন শ্রীজাত।চ্যানেলে-চ্যানেলে টক্কর। গরমে-নরমে বিনোদন সাড়ে চৌষট্টি ভাজা। ভোটের রেজাল্ট যে! গেরস্থের পঞ্চবার্ষিকী মেগা ইভেন্টে উঁকি দিলেন শ্রীজাত।

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ১৩:৫৮
Share: Save:

মনার মা আজ সকাল থেকেই গজ গজ করছে। এমনি দিনে বড়জোর চারটে আইটেম রাঁধতে হয়, আজ দেদার ফরমাশ। ভাত, শুক্তো, ডাল, বেগুন ভাজা, পোস্তর বড়া, পাবদার ঝাল, কচি পাঁঠার ঝোল আর শেষ পাতে কাঁচা আমের চাটনি।

শুধু আইটেম বেশি তাই নয়, কোয়ান্টিটিও দ্বিগুণ। বাড়ির চারজন তো আছেই, আবার কোন্নগর থেকে বৌদির বোনেরা তিনজন আসবেন। বিকেলেও রক্ষে নেই, বাগবাজার থেকে দাদাবাবুর বড়দা বড় বৌদি আসবেন, সন্ধেয় এসে লুচি ভাজতে হবে। একা হাতে এত পারা যায়?

এ দিকে কাকভোর থেকে বাড়িতে সাজ-সাজ রব। মহালয়ায় ইদানীং ভোরবেলা ওঠা হয় না, কিন্তু আজকের দিনে নো মিস।

আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়েছেন রায়বাবু, মিঠে ধাক্কায় ডেকে তুলেছেন রায়গিন্নিকেও। আজ দুজনেই অফিস থেকে ডুব। সিএল পাওনা আছে, পুষিয়ে যাবে।

ছেলে আর মেয়েও বাড়ি থেকে বেরবে না, বলে দিয়েছে। মেয়ের স্কুল ছুটি, ছেলে কলেজ কাটিং। অতএব পুরো ফ্যামিলি হলিডে। আজ যাবতীয় কেজো ব্যাপারকে তুড়িতে ফৌত করে মৌজের মামাবাড়ি যাকে বলে! কারণ আজ বাঙালির জাতীয় এন্টারটেনমেন্ট ডে। আজ ভোটের কাউন্টিং।

কেদার-বদ্রী-পুরী-ব্যাংককের মতোই চারটে নিউজ চ্যানেল পরপর তীর্থধামের প্যাকেজের মতো সাজানো আছে, জাস্ট বুড়ো আঙুলের খেলায় এ পাশ ও পাশ করেই কেটে যাবে সারাটা দিন।

তর্জনীর কাজ তো ভোটের দিনই সারা... সেই কলঙ্করেখা আজও জ্বলজ্বলায়মান। সেই দিনটাও জমিয়ে কেটেছে রায়বাড়ির। ছেলের এ বার নাম উঠেছে লিস্টে। সেই কোন ছোটবেলায় হাত ধরে সার্কাস আর চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভোটটাই যা বাকি ছিল। এ বার সেটাও দেখা হল। ধুম রোদে চাঁদি ফাটিয়ে লাইন দিয়ে নিজের মতো জাহির করে আসা। ওই মতটুকুই যা আছে, হিম্মত জাহির করতে গেলেই কেস ছেলেকে আগেই এটা বুঝিয়ে রেখেছিলেন রায়বাবু। তার অবশ্যি ভোটফোটে কোনও ইন্টারেস্ট নেই, একটা পড়ে পাওয়া ছুটির দিন বন্ধুদের সঙ্গে জ্যাম করে কাটাতে পারলেই ভাল হত, কিন্তু চারপাশে কেমন যেন একটা কারফিউ ফ্লেভার।

বুথ ফেরত রায়বাবু জমে গিয়েছিলেন পঞ্চার চায়ের দোকানে আর রায়গিন্নি সোজা বাড়ি। কিন্তু আজ ইউনাইটেড উই এনজয় বাণী নিয়ে সকাল থেকে বিছানা বালিশ দখল করার পালা। এমন মেগা ইভেন্ট তো প্রতি বছর আসে না। এমনকী বিশ্বকাপওলাদেরও মায়া-মমতা আছে। চার বছরের বেশি ওয়েট করায় না। লোকসভার গুমোর দেখো! তাদেরও দিব্যি মায়া-মমতা আছে, কিন্তু পাঁচ বছর পর পর এপিসোড হলে টানটানপনা থাকে?

আটটা বাজতে না বাজতেই চ্যানেলগুলো ‘গরম ভাট অথবা নিছক বুথের গল্প’ শুরু করে দিয়েছে। অনেক মান্যিগন্যি লজিস্টরা আজ দফায় দফায় চ্যানেল সফরে থাকবেন বলে ফেব্রুয়ারি নাগাদ কোট কিনে রেখেছিলেন, আজ এই ৪২ ডিগ্রিতে সেটা হাসিমুখে পরার দিন এসেছে। বাকিরা যার যার দলীয় কালার পরে হাজির।

দরজা খুললেই তরজা শুরু। ব্রেকফাস্ট আজ বিছানাতেই, রায়বাবু উত্তেজনায় একটা মামলেট বেশি খেলেন। ছেলে আর মেয়ে নিজেদের ঘরে টিভি চালিয়ে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে যে চ্যানেল ঘুরিয়ে হলিউডে উঁকি মারছে না তা নয়, তবে মূলত ফ্যামিলি ঐক্যের দিকটাই মাথায় রেখেছে।

প্রথম কাপ চা-টা মনার মা-ই বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বাংলায় যাকে বলে জঘন্য। কিন্তু সেটাই আজ তৃপ্তি সুড়ুৎ সহকারে পান করলেন রায় দম্পতি, কারণ ততক্ষণে টিভির পর্দায় চাপানউতোর চালু।

এ দিকে খবরের কাগজগুলো দিন তিনেক আগে থেকেই বলতে শুরু করেছে, সাধারণ দর্শক কাউন্টিঙের দিন কী কী করবেন, আর করবেন না। যেমন লো প্রেশার থাকলে টানা সাত ঘণ্টা দেখবেন, জীবনের মতো সেরে যাবে। বা শশা টোমেটোর স্যালাড খাবেন, শরীর ঠান্ডা থাকবে ইত্যাদি। রায়বাড়িতে অবশ্য ফুল জমিদারি মেজাজ। কেবল সন্ধের দিকে ঝাড়বাতি জ্বেলে বাই নাচটাই যা হবে না। নয়তো মুখ দেখলে মনে হচ্ছে খোদ রায়বাবু সামনেই পিএম হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন।

ও দিকে ব্রেকফাস্ট শেষ হতে না হতেই চ্যানেল গরমাগরম। ‘জমাট বাংলা’ চ্যানেলে ভোট বিশেষজ্ঞ দুলি দাস বলছেন, রিগিং আসলে রিলেটিভিটি থিওরির আন্ডারে পড়ে, আবার ‘বং বার্তা’ চ্যানেলে নির্দল প্রার্থী মণিমালা আশিকী বলছেন, সেই যিশুর আমল থেকে শাসক দল ভোট নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, এর প্রতিকার চাই। ও দিকে ‘যেন তেন’ চ্যানেলে সকাল থেকে বসে আছেন মনোবিদ বাবুয়া বলাকা। সাড়ে আট মিনিট অন্তর মানুষের নানা প্রবৃত্তির নিহিতার্থ তুলে ধরছেন সহজ ভাষায়, যাতে সকলে কাউন্টিংটা বুঝতে পারে।

এরই মধ্যে আরেকটি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর উত্তেজিত হয়ে বলছেন, “আমরা পেয়ে গেছি অমুক দলের সেলেব ক্যান্ডিডেট দুনয়ন শর্মাকে। আপনি তো ৫১ ভোটে এগিয়ে আছেন, কী মনে হচ্ছে?” দেড় মিনিট অনুধাবনের পর দুনয়ন বললেন, “খুবই ভাল।” এই আনেক্সপেকটেড কথোপকথনের পরই ছোট্ট বিরতি এবং অবধারিত আমেরিকান আইসক্রিম ও জাপানি তেলের বিজ্ঞাপন।

আজ চান খাওয়ায় হেবি লেট। চূড়ান্ত জেট ‘ল্যাদ’-এর ফাঁকে ফাঁকে এক কাপ করে চা হয়ে যাচ্ছে। আজকের জন্য স্পেশাল দার্জিলিং, রায়গিন্নি তরিবত করে বানাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কোল্ড ড্রিঙ্কের ‘পেট’ বটল না থাকলে কাউন্টিং দেখবে না। অতএব সেটাও ঢালাও।

বেলা বাড়তেই কোন্নগর থেকে একরাশ হাসি আর ঘাম নিয়ে রায়গিন্নির বোন মুনিয়া আর তার বর বিরূপাক্ষ এসে হাজির। হাতে নিভৃত বোঁদের প্যাকেট। অতিথি বলে কথা, বিছানার ব্যালকনি ছেড়ে দেওয়া হল তাদের।

ছোট্ট মেয়ে তুলতুলি দেড় সেকেন্ডের মধ্যে চিপস্-এর ঠোঙায় মুখ ডুবিয়ে বসে পড়ল। টিভিতে তখন উত্তেজনা চরমে। নতুন জামার হাতা গুটিয়ে সিটে বসেই এ ওকে তেড়ে যাচ্ছে। শর্টহ্যান্ডে কথা বলছে বলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেন যে এরা সাবটাইটেলের ব্যবস্থা করে না! একে অপরকে দেওয়া গালাগালগুলো ভাগ্যিস নীচে স্ক্রোল করে চালাচ্ছে! নইলে এন্টারটেনমেন্ট হয়েছিল আর কী!

এরই মধ্যে কোন একটা চ্যানেলে আবার গায়কদের ডেকে আনা হয়েছে। হাতে গিটার নিয়ে বসে তাঁরা মাঝামধ্যেই হিট গান শোনাচ্ছেন, তার পরেই কাউন্টিং-এর বুথ-ঝলক। ফিরে এসেই এক গায়ককে প্রশ্ন, ‘তুমি তো ওঁকে অনেক দিন ধরে চেনো। তোমার কী মনে হয়, অমুক কেন্দ্রে পাপিয়া বৈরাগী জিতবেন?’ বলাই বাহুল্য, পাপিয়াও এক্স গায়িকা। উত্তরে তরুণ গায়ক বলছেন, ‘জিতবে না মানে? উফ্, ১৯৬৭-র পুজোর সেই গান, মামণির মন ভেঙেছে। ভাবা যায়? সেই মানুষ জিতবে না তো কে জিতবে?’

উল্টো দিক থেকে আরেক গায়কের পাল্টা যুক্তি, ‘সে ভাবে দেখতে গেলে তো ব্যাকুলদা’রও জেতার কথা। এই সেদিনও হিট দিয়েছেন মন মাঝি তোর বোন রাজি।’

এ গেল গায়ক স্টেটমেন্ট, ওদিকে লেখক চিত্রকর পরিচালকরাও অন্য চ্যানেলে ফটাফট মতামত দিচ্ছেন। কীসে দেশের ও দশের হেল্প ভাল হবে, তা যদি তাঁদের মতো কেউ জানত, তবে দেশটা অ্যাদ্দিনে আমেরিকার মতো ফর্সা হয়ে যেতে পারত।

তবে এত সবের মধ্যে একটাই যা আরামের কথা, সরকার পাল্টানোর আগেই মুনিয়া আর বিরূপাক্ষ পোশাক পাল্টে নিয়েছে। মিহি ম্যাক্সি আর নিহিত পাজামায় এখন তারা সাঁতার কেটে একের পর এক বেঙ্গলি চ্যানেল পার হচ্ছে।

দুপুরে বেডরুমে তেড়ে এসি চালিয়ে পাবদা আর পাঁঠার জবাই হয়েছে, কাউন্টিং রাখা যায়নি। চাটনি সহকারে যখন ‘মৃদু বাংলা’ চ্যানেলের স্পেশাল সেগমেন্ট ‘বুথগুলো সব গেল কোথায়’ দেখছেন, তখনই রায়বাবু জানেন, এর পর ভারতবর্ষের যাই হোক, তাঁর একটা কোলবালিশ চাই।

হলও তাই, দুপুরে সকলেই একটু ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নিল। বিকেলে বাগবাজারের বড়দা, বড়বৌদি হাজির, দ্বিগুণ গজগজানি নিয়ে হাজির মনার মা-ও।

সূর্য ডুবছে, পারদ চড়ছে। যদি হয় স্বজন, এক বিছানায় ছ’জন নিউটনের এই থিওরি মেনেই রায়বাড়ির বেডরুম এখন জমে উঠেছে।

গণনা প্রায় শেষের দিকে, এখন আল্টিমেট ঘোষণাটাই যা বাকি। উত্তেজনা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এমন সময়ে বাগবাজারের বড়বৌদি বলে বসলেন, ‘হ্যাঁগো, আজ মানুর মিনতি দেখবে না?’ পৃথিবী বদলে দেওয়া মেগা সিরিয়ালগুলো একটি। না দেখলে রাতে বমি পায়, পর দিন পেট পরিষ্কার হয় না।

বাগবাজারের বড়দা আড়চোখে এপাশ ওপাশ তাকালেন। রায়গিন্নির ছোট বোন মুনিয়া আর তার ছোট বর বিরুপাক্ষর মুখেও তুমুল নীরব সম্মতি। এমনকী আধুনিকা রায়গিন্নিও উসখুশ করছেন, কারণ আজকের এপিসোডেই মানুর প্রথম পক্ষের বাবার বড় তরফের ছোট মাসিমা আগের জন্মে মেজ জা-এর সঙ্গে মানুর বড় ভাশুরের এনআরআই সৎ মা’র অ্যাডপ্টেড ননদের পাতানো শ্বশুরমশাইয়ের একটা মুখোমুখি এনকাউন্টার হবে। সে জিনিস ছাড়া যায় না। ভোট তো পাঁচ বছর পরেই ফিরবে।

রায়বাবু অগত্যা গুটিগুটি ছেলেমেয়েদের ঘরের দিকে এগোলেন, লোকসভা কার দখলে গেল, সেটা ওদের ঘরে বসেই দেখতে হবে। কিন্তু সেখানে আরও বড় সিরিয়াল। মেগা নয়, মেগালোম্যানিয়্যাক। আইপিএল। কে এক নতুন ছোকরা বলে বলে ছক্কা হাঁকাচ্ছে, সেই নিয়ে ভাইবোনে মাতোয়ারা।

এও এক গণনা, স্কোরবোর্ডে যা প্রতি মিনিটে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, লোকসভার লাস্ট ওভার মিস। তাতেও কি খুব আক্ষেপ হচ্ছে রায়বাবুর? নিজেই ভেবে অবাক হলেন, খুব একটা হচ্ছে না। বরং সারা দিনের চড়াই উৎরাই দেখতে দেখতে নিজেকে একটু ক্লান্তই লাগছে তাঁর। কাউকে কিছু না বলে একটা ছোট পেগ বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন।

বাড়িতে বাড়িতে টিভি চলছে। কোনটা ভোট, কোনটা ক্রিকেট আর কোনটা সিরিয়াল, বোঝার উপায় নেই। এই তিনটে কি আসলে আলাদা কিছু? সেটাও এখন, এই সন্ধের আবছা পাড়ায় আর ঠাহর হচ্ছে না। কেবল দিল্লির রায় জানতে অধুনা অনিচ্ছুক কলকাতার রায়বাবু দেখতে পেলেন, তাঁর গ্লাসে চুপচাপ ভাসছে কয়েকটা বরফের টুকরো। একটু পরে ওগুলো গলে গিয়ে নেশায় মিশে যাবে, যেমন এত দিন ধরে সিরিয়ালের, ক্রিকেটের, গণতন্ত্রের নেশায় গলে মিশে গিয়েছে এই দেশের জনসংখ্যা। এই আবছা তরল অন্ধকারে যাদের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই আর...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE