Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মুখোমুখি...

দুই বোন ৬টা৩২

সন্ধে সাড়ে ছ’টার ঠিক দু’মিনিট বাদে ছোট বাক্সয় হাজির হতেন ওঁরা। চৈতালি দাশগুপ্ত ও শাশ্বতী গুহ ঠাকুরতা। দূরদর্শনের চল্লিশ বছরে রাগ, অভিমান, ভাললাগা নিয়ে অকপট। সামনে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়পত্রিকা: এখনও ফোন করে দেখা করতে চায়? চৈতালি: যাক্ বাবাহ! আজ আমাদের শাড়ির রং মেলেনি। শাশ্বতী: আসলে তুই তো জানিস চট করে লাল পরি না আমি। চৈতালি: আমি তো সেই কবে থেকে কনট্রাস্ট ছাপা ব্লাউজ আর মাথায় ফুল। তুই এক্কেবারে ম্যাচিং ব্লাউজে ক্লাসিক লুক।

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পত্রিকা: এখনও ফোন করে দেখা করতে চায়?

চৈতালি: যাক্ বাবাহ! আজ আমাদের শাড়ির রং মেলেনি।

শাশ্বতী: আসলে তুই তো জানিস চট করে লাল পরি না আমি।

চৈতালি: আমি তো সেই কবে থেকে কনট্রাস্ট ছাপা ব্লাউজ আর মাথায় ফুল। তুই এক্কেবারে ম্যাচিং ব্লাউজে ক্লাসিক লুক।

পত্রিকা: আচ্ছা, চৈতালি আর শাশ্বতী কি সত্যি সত্যি দুই বোন? অনেকেরই কিন্তু তেমনই ধারণা...

শাশ্বতী; (প্রচণ্ড হেসে) সত্যি আমরা দুই বোন নই। কিন্তু আজও আমাদের দুই বোন ভেবে বাজি ফেলে লোকে।

চৈতালি: আরও শুনবেন, এটা জানতে চেয়ে দর্শকের দরবার-এ রোজ অন্তত খান দশেক চিঠি থাকত। আর তখন বিভাস চক্রবর্তী ছিলেন প্রোগ্রামটার কো-অর্ডিনেটার। উনি বলতেন, এই রহস্য ধরা থাক সাদা-কালো বাক্সের নস্ট্যালজিক দুনিয়ায়।

শাশ্বতী: আমার মা’কে এক মহিলা বলেছিলেন, ‘জানেন তো শাশ্বতী-চৈতালিরা পাঁচ বোন আর পাঁচ বোনই দূরদর্শনের ঘোষিকা’। মা আর কথা বাড়াননি। আজও রাস্তায় আমায় দেখে লোকে বলে, ‘চৈতালিদি আপনি তো আমাদের পরিবারেরই একজন’। এ কথায় আমার মনে হত, আরে, সবাই চৈতালিকেই মনে রাখে? আমি কি একেবারে...! একদিন চৈতালিকে বললাম এই আশঙ্কার কথা।

চৈতালি: ওর কথা শুনে আমি হেসেই খুন, বললাম, আরে আমাকেও তো অনেকেই বলে, “এই যে শাশ্বতীদি।” আসলে বাংলার ঘরে ঘরে তখন শাশ্বতী-চৈতালি মিলে একটা নাম হয়ে গিয়েছিল। সবিতাব্রত দত্ত তখন স্টুডিয়োতে আসতেন। উনি বলতেন, “আমাদের বাড়িতে জানিস তো, শাশ্বতী হল বড় খুকি আর চৈতালি হল মেজ খুকি।”

পত্রিকা: চৈতালি-শাশ্বতী দুজনে দুজনকে প্রথম কোথায় দেখেছিল?

শাশ্বতী: আমি ওকে প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুচকা খেতে দেখেছিলাম।

চৈতালি: যাদবপুরেই ইউনিভার্সিটিতেই একটা কাঠের সাঁকো ছিল। আমি দেখলাম, এক সুন্দরী তন্বী হারমোনিয়াম হাতে করে সাঁকোটা পেরোচ্ছেন। ভীষ্ম গুহঠাকুরতাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ও-ই আমাকে রানির (শাশ্বতী) সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়।

পত্রিকা: দু’জনেই তো তখন বেশ সুন্দরী। বয়সও অল্প। এ রকম কেউ আছেন যিনি চৈতালি-শাশ্বতী দু’জনেরই প্রেমে পড়েছিলেন?

চৈতালি: (হাসি) নাহ্ তেমন কাউকে মনে পড়ে না।

শাশ্বতী: তবে আজও আমি আর চৈতালি অনেক পুরুষের ফোন পাই যাঁরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান।

সাত দিনের ব্যবধানে দু’জনেই নার্সিংহোমে

শাশ্বতী: মনে পড়ে তোর কেয়া (চৈতালি)? ১৯৮৩-র শেষের দিকে, একদিন মেকআপ রুমে দু’জনে পাশাপাশি বসে মেকআপ করছি, ‘সাপ্তাহিকী’ করব বলে। ঘরে আর কেউ ছিল না। আমি তখন দ্বিতীয়বার কনসিভ করেছি। সুখবরটা তোকে না দিয়ে পারিনি। তখনও কেউ জানে না। বলেছিলাম, “কেয়া সুখবর আছে, আমি আবার মা হতে চলেছি।”

চৈতালি: আর আমি চমকে উঠে বলেছিলাম, “বলছ কী! আমিও তোমায় তো সেই একই খবর দেব বলে ভেবেছি! আমিও তো তাই।” পরের জুলাই-এ সাত দিনের ব্যবধানে দু’জনেই আমরা উডল্যান্ডস্-এ। এই ঘটনা বলে নয়, আমাদের দু’জনের জীবনটা যেন কোথাও কোথাও এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে!

পত্রিকা: আচ্ছা, সত্তর দশকে আপনারা যখন চাকরি করতেন, তখনও তো মেয়েদের চাকরি করাটা অত বেশি শুরু হয়নি। তার ওপর দু’জনেই বিয়ে করে ফেলেছিলেন, সমস্যা হয়নি?

শাশ্বতী: আমার শ্বশুরমশাই চাইতেন না আমি চাকরি করি। বাড়ির বৌ বলে নয়, বাড়ির ছেলেরাও চাকরি করুক এটা উনি পছন্দ করতেন না। আর সেই সময় উনি ছিলেন বাড়ির সর্বময় কর্তা। ওঁর বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারত না। আমার শাশুড়ি যদিও আমাকে প্রচুর সাপোর্ট করতেন আর আমার বড় ভাশুরেরও আমার কাজ নিয়ে সমর্থন ছিল। তার পরে একটা সময় তো আমি নিজের মতো করে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। আমার বয়স তখন অল্প, দুটো বাচ্চাকে নিয়েই একলা থাকতে শুরু করি। তখন সত্যি অনেক ঝড় এসেছে, বহু ঝক্কি সামলাতে হয়েছে। মনের জোরে সে সব পেরিয়েও গেছি।

চৈতালি: আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল ব্যাচেলার্স ডেন। শ্বশুরবাড়িতে আমার কাজ নিয়ে সমস্যা একেবারেই ছিল না। আমিই বরং বিয়ে করে পায়ের ওপর পা তুলে দিন কাটাব ভেবেছিলাম। তবে একটা সময় জীবনের সাত বছর আমিও একা কাটিয়েছি। কখনও চাইনি আমার আর আমার স্বামী রাজার (দাশগুপ্ত) মধ্যের কোনও তিক্ততা আমার ছেলেদের মধ্যে এসে পড়ুক। নিজে কাজ করতাম তাই একা থাকতেও পেরেছিলাম। একটা সময়ের পরে অবশ্য ওরা সকলেই আমার কাছে আবার ফিরে আসে।

পত্রিকা: দূরদর্শনে আপনাদের ঢোকাটা কী ভাবে?

শাশ্বতী: আমি দূরদর্শনে ইউনিভার্সিটিরই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পঙ্কজদা (সাহা) তখন দূরদর্শনের প্রডিউসার। আমাকে দেখে বললেন, একটু থেকে যাও। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনিই আবার আমায় ডেকে বলেন, শাঁওলী মিত্রর একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল। সেই শুরু...

চৈতালি: পঙ্কজদা আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। জানতেন, আমি শঙ্খ ঘোষের ছাত্রী। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমার একটা যোগ আছে। পঙ্কজদাই আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেনের বর্ষার গানের অনুষ্ঠানে সংযোজনার দায়িত্ব দেন। এটা কিন্তু রেকর্ডেড প্রোগ্রাম। ১৫ অগস্ট প্রথম আমি ‘লাইভ’ করি। মণিপুরী নাচের ওপর একটা অনুষ্ঠানে।

ছেলেটি বলল, তুমি কি মানুষ

পত্রিকা: দূরদর্শনের প্রথম মহিলা স্টার আপনারা, রাস্তায় লোকে তখন ঘিরে ধরত না?

শাশ্বতী: আসলে নিজেদের কোনও দিন স্টার ভাবিনি আমরা। দূরের আকাশের তারকা নয়, বরং একেবারে ঘরের মেয়ে ছিলাম আমরা। লোকে অবশ্য ঘিরে ধরত। যেমন একবার বইমেলায় গেছি। একদল ছেলে আমায় সমানে দেখছে আর বলছে, আজ তাহলে দূরদর্শনের ছুটি। আজ বইমেলাতেই ‘দর্শকের দরবার’। এ রকম শুনলে অবশ্য বেশ মজা লাগত।

চৈতালি: স্টার নয়, আমরা আসলে মানুষের ড্রয়িংরুম বক্সের দুই সখী। একবার মিনিবাসে একটি বাচ্চা ছেলে আমায় ছুঁয়ে বলেছিল, ‘তুমি মানুষ? তাহলে আমাদের বাড়ির বাক্সটায় হাজির হও কেমন করে?’

পত্রিকা:অস্বস্তিকর কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কখনও?

শাশ্বতী: শিলং বেড়াতে গিয়েছি। ধুতি পাঞ্জাবি পরা বেশ প্রবীণ একজন আমার দিকে গদগদ হয়ে এগিয়ে আসছেন। একেবারেই অপরিচিত। খুব অস্বস্তি লাগছিল। আমি কিন্তু তখন প্রবীণা নই। কাছে এসে বললেন, ‘আপনি আমায় চেনেন না, কিন্তু আমি সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আপনাকে দেখে আসছি’।

তিরিশ নয়, চল্লিশও না, বত্রিশ

পত্রিকা: একটা কথা বলবেন, দূরদর্শনের অনুষ্ঠান তখন ঠিক ছটা বত্রিশে আরম্ভ হত। তিরিশ নয়, চল্লিশ নয়। বত্রিশ। কেন বলুন তো?

চৈতালি: নাহ্ আসলে সাড়ে ছটায় সিগনেচার ইমেজটা যেত। ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’। তাতে ওই দু’মিনিট সময় লাগত। তার পরে লাইভ শুরু হত।

শাশ্বতী: লাইভ অনুষ্ঠানের মজাটাই ছিল আলাদা। মনে পড়ে তোর কল্যাণ ঘোষের (প্রোগ্রাম অ্যাসিসটেন্ট, পরে প্রোডিউসার হন) পরিচালনায় দূরদর্শনের জন্মদিনের জন্য আমরা গেলাম রাধা স্টুডিয়োয় দূরদর্শনের পুরনো বাড়িতে?

চৈতালি: রাধা স্টুডিয়োয় বাইরের গেট থেকে ভেতরের গেট অবধি হাঁটতে হাঁটতে আমরা পুরনো দিনের গল্প বলতে আরম্ভ করলাম। তখন কিন্তু ক্যামেরা চলছে। কাঠচাঁপা গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুল তুলে আমি চুলে লাগিয়ে নিয়েছিলাম। সেটাও ক্যামেরায় ধরা ছিল।

পত্রিকা: লাইভ প্রোগ্রাম করতে গিয়ে কোনও মজার ঘটনা মনে পড়ছে?

শাশ্বতী: ও বাব্বা! একবার ঋতা ভিমানি নিউজ পড়বেন। তারপর আমি প্রোগ্রাম অ্যানাউন্স করব। ঋতাদির হাত ভেঙেছে। সেটা দেখে আমি জিভ-টিব বার করে বলে বসলাম, এ কী গো! কী কাণ্ড! কী করে হল? তার পরেই মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, খুব চেনা একজন মহিলা জিভ কাটছেন। কে এটা? ভাবতে ভাবতে মুহূর্তে রিয়ালাইজ করলাম, আরে এটা তো আমি। ঋতাদির জায়গায় আমার দিকের ক্যামেরা অন হয়ে গিয়েছিল।

ওরা তো কেবল সেজেগুজে মুখ দেখায়

পত্রিকা: আপনারা যেমন সিনিয়রদের সাহায্য-টাহায্য পেতেন, আপনারাও কি আপনাদের পরের ব্যাচকে তেমনই সাহায্য করতেন?

চৈতালি: মীরাদি (মীরা মজুমদার, দূরদর্শনের প্রথম ডিরেক্টর) আমাদের খুব স্নেহ করতেন। পঙ্কজদা (সাহা) আর শর্মিষ্ঠাদির (শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, প্রোগ্রাম অ্যাসিসটেন্ট) সঙ্গে তো প্রচুর কাজ করেছি।

শাশ্বতী: প্রথম দিকে দূরদর্শনের পরিবেশটা ছিল একটা ইউনিভার্সিটির মতো। সকলেই সকলের কাজ নিয়ে ভাবতেন, সাহায্য করতেন।

পত্রিকা: শুধু প্রথম দিকে কেন বলেছেন? পরে সেটা কি ছিল না?

শাশ্বতী: দূরদর্শনের যখন লোক বাড়ল, বন্ধুরাই কেমন ঈর্ষায় শত্রু হয়ে উঠল। অনেকেই বলতে আরম্ভ করল, ওরা তো কেবল সেজেগুজে মুখ দেখায়, ওদের আর কীই বা কাজ? পরিস্থিতি এমন হল দর্শকের দরবার-এ, সাপ্তাহিকী বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এমনকী দূরদর্শনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সিনেমা আর্টিস্ট নেওয়ার কথা উঠল।

চৈতালি: অনুষ্ঠানে মালা গাঁথার দায়িত্ব যাঁর, তাঁর কথা, উপস্থাপনা এসবের চেয়ে চেহারার জৌলুসকে গুরুত্ব দেওয়া হল। অনুষ্ঠানের মান পড়তে লাগল।

পত্রিকা: আজ তো ঘোষিকার সংলাপ অন্য কেউ লিখে দেন বা বলে দেন। মনে হয় না আপনারা যে ধারার জন্ম দিয়েছিলেন সেটা আজ কোথাও ধরে রাখা গেল না?

চৈতালি: চল্লিশ বছর ধরে লোকে আমাদের দেখছে। তাও যদি ফুলকে fool বলে আর পোগ্রাম বলে কী বা করতে পারি আমরা?

শাশ্বতী: বাংলা উচ্চারণের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন সংযোজনার কাজ যাঁরা করেন তারা বাংলা ভাষা পাঠের চেয়ে নিজেদের পর্দায় কতটা অ্যাট্রাকটিভ করে তোলা যায় তার দিকে মন দেন। নয়ত আমার ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথের কেবল চারটে লাইন লিখতে বললে তৃতীয় আর চতুর্থ লাইন আসে ‘হও ধরমেতে বীর’ আর ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’! ধান্য নয়, ধান্যে! ভাবুন একবার। অনেকে এমনও বলেছেন, ‘আচ্ছা সত্যি কি গীতবিতানের সব কটা গানই রবীন্দ্রনাথের লেখা?’

আমার সঙ্গে ঝগড়া হলে ও লুকিয়ে কাঁদে

পত্রিকা: এত বন্ধুত্ব আপনাদের, কোনও দিন একে অপরকে ঈর্ষা করেননি?

চৈতালি: বিশ্বাস করুন, একেবারেই না। রানি যেদিন প্রথম কৌশিক সেনের পরিচালনায় ‘কলকাতা ইলেকট্রা’য় অভিনয় করল, সেদিন আমার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন ফোনে ‘আবহমান’-এর জন্য রানিকে কাস্ট করছেন, তখন আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। সেটা জানতে পেরে ঋতু রানিকে বলেছিল, কী! কেয়াদিকে ছবিতে রাখছি না বলে কি গাল ফোলাচ্ছে? কিন্তু গাল তো ফোলেইনি। মনটা ভরে গিয়েছিল।

পত্রিকা: কিন্তু দূরদর্শনের কারণে ঝগড়া বা মনখারাপ হয়নি কখনও?

শাশ্বতী: সে তো হবেই। কিন্তু তখন তো রবীন্দ্রনাথ আছেন। আমার একলা চলার সঙ্গী। তবে দূরদর্শন মন খারাপের চেয়ে মন ভরিয়েছে অনেক বেশি। অমরাবতী দাশ বলে একজনের কথা বলি। সাধারণ দর্শক। অশীতিপর বিধবা। আমাকে নিজের মেয়ে ভাবতেন। খুব অসুস্থ অবস্থায় আমাকে মানি অর্ডার করে সতেরশো টাকা পাঠিয়েছিলেন। ওটাই ছিল তাঁর শেষ সম্বল। এই পাওয়ার পর মনে হয় না আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে।

চৈতালি: কত গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ জমেছে দূরদর্শনের হাত দিয়ে। মেকআপ রুম বা মেকআপ করিডরটা ছিল চাঁদের হাট। একদিন তৃপ্তি মিত্রর সঙ্গে দেখা। ‘সরীসৃপ’ নাটক করতে এসেছেন। কাছে যেতেই মাতৃস্নেহ ঝরে পড়ল। ‘ডাকঘর’ করতে বহুরূপী এসেছিল। মেকআপ রুমের আয়নায় দেখি শম্ভু মিত্র! প্রণাম করলাম। চিরদিনের সেই আশীর্বাদ রয়ে গেল। গেরুয়া লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে গাইছেন ‘খুশি থাকো, তুমি খুশি থাকো’। বুকের মধ্যে তোলপাড়। দেবব্রত বিশ্বাস! রবীন্দ্রনাথের গানকে যিনি আমার মধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। নাম বলে শেষ করা যাবে না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও কাছ থেকে দেখেছি বহুবার। উত্তমকুমারকে দেখার জন্য তো দূরদর্শনের কাছে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জানতাম, স্টুডিয়ো যাবার পথে উনি এখানটা দিয়েই পাস করেন। গাড়ির কাচের আড়ালে দেখা যেত, উনি বসে আছেন। মুখ রুমালে ঢাকা দিয়ে। বলতে পারি আমার মনের গৈরিক বসন পরিয়েছে এই দূরদর্শনই। অভিনয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে মনে।

পত্রিকা: অভিনয়ের খিদে মেটাতেই কি একই মেগা সিরিয়ালে এখন শাশ্বতী-চৈতালিকে দেখা যাচ্ছে?

চৈতালি: টেলিভিশন সিরিয়ালের জন্মলগ্নের সাক্ষী ছিলাম আমি। দিব্যেন্দু পালিতের ‘মুখগুলি’ গল্প অবলম্বনে রাজার (দাশগুপ্ত) দূরদর্শনের জন্য টেলিফিল্মের সংলাপ আমি লিখেছি। তখন কেয়া সেন নামে লিখতাম।

শাশ্বতী: আমি ১৯৯৬-এ সিরিয়াল করতে আরম্ভ করি। বেশ ভয়ে ভয়ে। তখনই তো দূরদর্শনে চাকরি করি। কৌশিক গাঙ্গুলির ‘অমানিশা’-তে। দারুণ লেগেছিল। আমার কাছে স্কুল, কলেজ, দূরদর্শন সব একই গোত্রের। সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, শিক্ষা নিয়ে তা এক প্রসারিত ক্ষেত্র। আর সিরিয়ালের জগৎ এক কথায় বিনোদন। তবে কী মনে হয় জানে? যাঁরা এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন তাঁদের দিনটা বাহাত্তর ঘণ্টা হলে ভাল হত।

চৈতালি: যাই বল যারা মেগা সিরিয়াল করে তাদের আর কিছু না বাড়ুক ধৈর্য বাড়ে। ধরাচূড়া পরে এই যে বসে থাকা ... রাগ ধরে যায়....

শাশ্বতী; তুই হট করে রেগে যাস। রাগলেই মাথা গরম এক্কেবারে।

চৈতালি: আর তুমি যে গোমড়া মুখে বাড়ি গিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া হলে লুকিয়ে কাঁদো? তার বেলা?

শাশ্বতী: আমাকে তো তোর রাগ থামানোর জন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে খাওয়াতেও হয়। সবাইকেই বলি ভাল খাবার খাওয়ালে ঝপ করে কেয়ার রাগ পড়ে যায়।

পত্রিকা: এই ঝগড়া-খুনসুটি কি দিনের পর দিন চালিয়ে যাবেন?

চৈতালি: জীবনে যা-ই আসুক, রানিকে অবশ্যই চাই আমার। বিশেষ করে মনখারাপের দিনে।

শাশ্বতী: আমারও ঠিক তাই। আর কোনও অপশনের মধ্যে যেতে চাই না আমি। বিশ্বরূপের খেলাঘরে ওর সঙ্গ ও স্পর্শে প্রতি জন্মে আমি আমার অপরূপকে দেখতে চাই।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE