Advertisement
E-Paper

কুবের উবাচ

আজ মণিপুষ্পকের প্রোফাইল বাছা ওই চোখ দেখার কারণেই। এমনিতে এই প্রোফাইলে সে ভাবে কোনও চোখ-ধাঁধানো বৈশিষ্ট্য নেই। আয় আকাশছোঁয়া নয়। তেমনই সর্বগ্রাসী নয় দারিদ্র। এখনও বিয়ে হয়নি।

শৈবাল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২১

মণিপুষ্পক (২৯) • মা (৫৬)

চাকরি করেন • বিয়ে করেননি এখনও • থাকেন ভাড়া বাড়িতে, মায়ের সঙ্গে
• একমাত্র লক্ষ্য, দু’বছরের মধ্যে নিজের বাড়ির চাবি

গল্পটা আমাদের বহু বার শোনা। সে অর্থে কিছুটা ক্লিশেও। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, আজ থেকে কয়েকশো বছর পরেও আমাদের সকলের জীবনে ওই গল্প একই রকম প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। একই রকম জীবন্ত থাকবে অজুর্নের লক্ষ্যভেদের আখ্যান।

কেন আর কেউ পারল না? কেন শুধু অর্জুনের তীরই বিদ্ধ করল গাছে বসিয়ে রাখা কাঠের পাখির চোখকে? কারণ, একমাত্র সে-ই শুধু পাখির চোখ দেখেছিল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইদের নয়। গাছ নয়। এমনকী পুরো পাখিও নয়। শুধু তার চোখ।

কেন বাছাই?

আজ মণিপুষ্পকের প্রোফাইল বাছা ওই চোখ দেখার কারণেই। এমনিতে এই প্রোফাইলে সে ভাবে কোনও চোখ-ধাঁধানো বৈশিষ্ট্য নেই। আয় আকাশছোঁয়া নয়। তেমনই সর্বগ্রাসী নয় দারিদ্র। এখনও বিয়ে হয়নি। তাই সামনে একগুচ্ছ লক্ষ্যের ভিড়ও নেই। শুনলে একটু অবাক লাগবে। কিন্তু এত প্রোফাইলের ভিড়ে এটিকে বেছে নেওয়া তার ওই এক লক্ষ্যমুখী মননের জন্যই। আমি মনে করি, এটি থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের।

লক্ষ্য চিনুন

কাজের সূত্রে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন আয়ের, বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা হয় আমার। কিছু ব্যতিক্রম পাশে সরিয়ে রাখলে অন্তত একটি বিষয় এক সারিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রায় সকলকে। তা হল, সকলেই যেন ছুটছেন একগাদা লক্ষ্যের পিছনে।

বাড়ি, গাড়ি, নিত্যনতুন মোবাইল, গ্যাজেট, বছরে নিদেনপক্ষে এক বার বেড়াতে যাওয়া, মাঝেমধ্যে বিদেশ ভ্রমণ— সব চাই। চাওয়া দোষের নয়। কিন্তু সব কিছু একসঙ্গে চাইলে বিপত্তি। কারণ, তা না-পেলে, মনের কষ্ট। আর পেলে, মাছি তাড়ায় সঞ্চয়ের খাতা।

মণিপুষ্পকের কাছে এই বিষয়টি ভীষণ ভাবে শেখার। আর পাঁচটা শখ-আহ্লাদ নিশ্চয় তাঁরও আছে। বিশেষত বয়স যেখানে কম এবং বিয়ে এখনও হয়নি। কিন্তু ৩০ ছোঁয়ার আগেই বেশ পাকা মাথার পরিচয় দিয়েছে মণিপুষ্পক। জানিয়েছে, আপাতত আগামী দু’বছর তাঁর লক্ষ্য একটিই। মাথার উপরে ছাদ। ওই সময়ের মধ্যে হাতে নিজের বাড়ির চাবি চান তিনি। ওটিই তাঁর পাখির চোখ।

আগে কোনটি?

সকলকে বলব, এই একটি জিনিস চিনতে শিখলে, জীবনে জটিলতা এক ঝটকায় কমে যায় অনেকখানি। তা হল, অগ্রাধিকার বা প্রায়োরিটি। আমরা সকলেই অনেক কিছু চাই। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু নিজের কাছে স্পষ্ট থাকা দরকার যে, তার মধ্যে কোনটি সবচেয়ে আগে চাই। আর সেই চাওয়া যদি বাড়ি হয়, তা হলে বেশিরভাগ সময়েই তা সঠিক সিদ্ধান্ত।

মণিপুষ্পকের ক্ষেত্রে তো বটেই। সে ভাড়া বাড়িতে থাকে। মাসে-মাসে ভাড়া গুনতে হয়। সঙ্গে বারবার তা পাল্টানোর হ্যাপা। এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি চায় মণিপুষ্পক। আসুন দেখি, কী ভাবে তা সম্ভব।

একটু বিশদে

চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঝুঁকছেন এখন অনেকেই। তাই তার জন্য টাকা জোগাড়ের উপায় যেমন তাঁরা জানতে চান, তেমনই জিজ্ঞাসা করেন তা কেনার আগে কী কী দেখে নেওয়া উচিত, সে কথাও। তাই আজ একটু অন্য পথে হাঁটব আমি। জীবনবিমা, স্বাস্থ্য বিমা, মিউচুয়াল ফান্ড, এসআইপি— এ সব নিয়ে আলোচনায় না-ঢুকে মনোনিবেশ করব শুধু বাড়ির বিষয়েই। যাতে এই লক্ষ্যে পা ফেলা সকলের কিছুটা হলেও সুবিধা হয়।

বাড়ি পছন্দ

ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার সময়ে সুইমিং পুল থেকে শুরু করে জিম— কত কিছুরই না খোঁজ করি আমরা। কিন্তু কিছু আপাত সাধারণ কিন্তু জরুরি বিষয় নজর এড়িয়ে যায়। নতুন বছরে সেগুলি একবার মনে করে নিলে মন্দ হয় না। খেয়াল রাখবেন—

কাছাকাছি ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান থাকা ভীষণ জরুরি। বিশেষত বাড়িতে যদি বয়স্ক মানুষ থাকেন। যেমন, মণিপুষ্পকেরই মা রয়েছেন বাড়িতে।

যোগাযোগ ভাল? বাস-অটো কেমন চলে? মেট্রো রেল কি কাছে?

কাজের জায়গা থেকে অনেক দূরে বাড়ি না-কেনাই ভাল। সে ক্ষেত্রে যেতে-আসতেই অর্ধেক শক্তি শেষ। অপচয় সময়েরও। মুম্বইয়ের মতো শহর হলে অবশ্য এ কথা মানা শক্ত।

বর্ষায় জল জমে কি না। আশেপাশের পরিবেশ কেমন।

একেবারে নীচে তলার ফ্ল্যাটে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন অনেকে। তেমন হলে, দোতলা, তিন তলা বেশ ভাল। তবে বেশি উঁচুতে কিনলে, লিফ্‌ট না-থাকলে বিপত্তি।

দেখে নিন লিফ্‌ট আছে কি না। গ্যারাজ, জেনারেটর, নিরাপত্তারক্ষী, ইত্যাদি থাকাও আজকাল জরুরি বলে মনে করছেন অনেকে। তবে মনে রাখবেন, এগুলির জন্য খরচও বাড়বে। ফলে আগেই হিসেব করুন, তা বইতে আপনি তৈরি কি না।

প্রতিবেশীরা কেমন? এমন নয় যে, সব সময় সবাই খুব মনের মতো হবেন। কিন্তু কথায়-কথায় কার্গিলের লড়াই না-বাঁধাই ভাল।

ফ্ল্যাট বা বাড়িটি তৈরিতে ঠিক কী ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করেছেন প্রোমোটার বা বিল্ডার। তা ভাল না-হলে, কিন্তু ক্রমাগত সারাই করতে-করতে জীবন যাবে আপনার।

খুব সাবধান

বাড়ি কেনা মানে তা সারা জীবনের লগ্নি। এ ক্ষেত্রেও অনেকগুলি বিষয় মনে রাখা জরুরি। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেখা যাক—

দেখুন জমি এবং বাড়ির টাইটেল ডিড আছে কি না। শুধু নো অবজেকশন সার্টিফিকেট যথেষ্ট নয়। যাচাই করুন প্রোমোটারের অতীত রেকর্ড এবং সুনামও।

বাড়তি সাবধানতা জরুরি পুরনো বাড়ি কিনলে। অনেক সময়ে দেখা যায়, তা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে। দেখে নিন, ব্যাঙ্ক সেই ধার শেষ হওয়ার (রিলিজ) শংসাপত্র দিয়েছে কি না। চেয়ে নিন মেটানো করের যাবতীয় রসিদও।

কোর্ট সার্চ করাতে ভুলবেন না। জমি নিয়ে কোনও আইনি জটিলতা রয়েছে কি না, তা দেখে নেওয়া জরুরি।

পুরসভার অনুমোদিত নকশা বিল্ডারের আছে তো?

বড় প্রকল্পে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বুক করার পরিকল্পনা করলে, আগে খোঁজ নিন তাতে ঋণ দিচ্ছে কোন-কোন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, ধার দেওয়ার আগে জমি-সহ যাবতীয় কিছুর কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে তারা। ফলে নামী সংস্থা ধার দিলে, সে দিক থেকে কিছুটা নিশ্চিন্ত।

শুধু বাড়ির দামই তো সব নয়। হিসাব করুন, তার সঙ্গে কর, রেজিস্ট্রেশন খরচ, মিউটেশন ইত্যাদি মিলিয়ে মোট কত পড়বে। তা ছাড়া, রং করা, রান্নাঘর সাজানো, গ্রিল লাগানো ইত্যাদি খরচ তো রয়েইছে।

থাকার জন্য বাড়ি কিনলে, তা বিক্রির দাম নিয়ে কম ভাবলেও চলে। কিন্তু লগ্নির জন্য কিনে থাকলে, আগে দেখে নেওয়া জরুরি যে, সেখানে দাম বাড়ার সম্ভাবনা কতটা।

গোড়াতেই ঠিক করুন, কী ভাবে বাড়ির দাম মেটানো সব থেকে সুবিধাজনক। কতখানি ডাউনপেমেন্ট করতে পারবেন? ঋণই বা কতখানি?

প্রোমোটার সুপার বিল্ট এরিয়া যতটা সম্ভব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলবেন আপনাকে। মেপে নিন, সত্যিকারের কার্পেট এরিয়া কত পাচ্ছেন। তারপরে হিসেব করুন প্রতি বর্গ ফুটের দর।

বাড়ি বা ফ্ল্যাট তৈরির সময়ে পারলে বারবার সেখানে ঢুঁ মারুন। শুধু অন্যের কথায় বিশ্বাস করে অগ্রিম টাকা দিয়ে তা বুক করে বসবেন না।

বাড়ি কেনার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেজিস্ট্রেশন সেরে নিন। তা খালি ফেলে রাখাও ভাল নয়।

টাকার জোগান

মণিপুষ্পকের লক্ষ্য দু’বছরের মধ্যে বাড়ি। যে-ধরনের ফ্ল্যাট বা বাড়ি আপাতত চাইছেন, তাতে তখন দাম পড়়বে কমপক্ষে ১৮ লক্ষ টাকা। ফলে ডাউনপেমেন্ট জোগাড় করতে হবে অন্তত তার ২০%। ৩.৬ লক্ষ টাকা।

এই মুহূর্তে সঞ্চয় বলতে রেকারিং ডিপোজিট। ফলে ওই টাকাকেই ডাউনপেমেন্ট জোগাড়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে তাঁকে। তা ছাড়া মাসের শেষে হাতে যেটুকু টাকা বাড়তি থাকে, তা দিয়ে ফান্ডে লগ্নি করুন এসআইপি-র মাধ্যমে। তাতেও কম পড়লে, আর ছ’মাস-এক বছর অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এ ছাড়া, সমবায়ে ঋণ মেটানো শেষ হয়ে গেলে, সেই কিস্তির টাকাও সঞ্চয় করার সুযোগ আসবে। তাকে তখন কাজে লাগাতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে।

শেষ পাত

মণিপুষ্পক শুধু বাড়ি কেনার বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছিলেন বলে, তাতেই নজর নিবদ্ধ করেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাড়ির পিছনেই সব চেঁচেপুঁছে উজাড় করে দেবেন। বয়স কম। তাই অবসরের সঞ্চয়ের সুযোগ পরেও পাবেন। কিন্তু উটকো বিপদ সামাল দিতে হাতে নগদ টাকা রাখতে ভুলবেন না।

গৃহপ্রবেশে নেমন্তন্নের অপেক্ষায় থাকলাম!

অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত মতামত ব্যক্তিগত

(ছবি: প্রতীকী)

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy