যে-কোনও বিষয়ে মান্নাদার জ্ঞান এবং আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তবে গানের পরেই নিশ্চিত ভাবে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল স্পোর্টস—খেলাধুলো। একানব্বই বছর বয়স পর্যন্ত মান্নাদা সারা পৃথিবী দাপিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। আজ আমেরিকা তো কয়েক দিন বাদে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য। কোনও যুবকও হার মানবে তাঁর কাছে। আসলে সংযমী জীবন-যাপন এবং ছোটবেলায় আখড়ায় নিয়মিত কুস্তিচর্চার প্রভাব ছিল আজীবন। সুঠাম, ঋজু দেহ। গীতিকার শ্যামল গুপ্ত একবার সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন। মান্না দে তাঁর থেকে তিন বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু শ্যামলবাবুকে অবাক করত, যখন তিনি বয়সের ভারে গৃহবন্দি, মান্নাদা তখন পৃথিবীর নানা দেশে অনুষ্ঠান করছেন, গানের রেকর্ডিংও সমান ভাবে চলছে।
২০০৩। পার্কস্ট্রিটে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টুডিওতে মান্নাদার ‘আমার প্রিয় মনীষী’ অ্যালবামের রেকর্ডিং চলছে। মান্নাদার শরীর খুব খারাপ। হার্টের একটা সমস্যা হচ্ছে। মুড একদম খারাপ। মান্নাদা সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই রেকর্ডিং করতে চলে এসেছেন—মিউজিসিয়ানদের একটা কাজের দিন নষ্ট হবে তাঁর জন্য, এটা মানতে পারছেন না। এ দিকে বেসমেন্টে ওয়াশরুমও নেই। হাতলহীন সিঁড়ি বেয়ে ওই শরীরে উপরেও উঠতে হচ্ছে। সবাই জানেন, মান্নাদার রেকর্ডিংয়ে প্রয়োজনীয় লোকজন ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। তখন তবলার প্যাটার্ন নিয়ে জোরদার রিহার্স্যাল চলছে। এমন সময় ঢুকলেন ফুটবলার (তখন কোচ) সুব্রত ভট্টাচার্য। প্রমাদ গুনলাম। খেয়েছে রে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, যা ভেবেছিলান একেবারে তার উল্টো ব্যাপার। সুব্রতবাবুকে দেখে মান্নাদার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আনন্দে ভরে গেল। মান্নাদা খুশি হলে বাঙাল কথা বলতেন—‘আরে সুব্রত যে, আইসো, আইসো, কী খবর বলো।’ তখনও অবাক হওয়ার বাকি ছিল। দেখলাম কলকাতার ফুটবলের সব খবরই তাঁর নখদর্পণে। মোহনবাগানের ব্যারেটোর খেলার ধরনের সঙ্গে তার আগের পায়াসের খেলার মিল কোথায় সে আলোচনা চলল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মান্নাদার মুডও ভাল হয়ে গেল। মিউজিসিয়ানদের রেডি হতে বলে মান্নাদা ফিরে গেলেন রেকর্ডিংয়ে। ডুবে গেলেন গানের সমুদ্রে। তখন তিনি অন্য মানুষ।