দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে মাদার। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
মাঝে মাঝে এক-এক জন কিম্ভূত লোক এসে হাজির হন, যাঁদের কাজই হল আমাদের নানা ভাবে অপ্রস্তুত করা, লজ্জা দেওয়া, অনুতাপ বা আত্মগ্লানিতে দগ্ধে মারা। এই সব লোক এসে আমাদের খুব গন্ডগোলে ফেলে দেন। আমরা ছেলেমেয়েদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। পাঁচ জনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সংকোচ হয়, এমনকী পাছে নিজের মুখ দেখতে হয় সেই ভয়ে আয়না ছাড়াই আমরা চুল আঁচড়ে নিই।
আরও খবর- মানবতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন মাদার
বেশ তো ছিলাম আমরা বউ-বাচ্চা গৃহকোণটি নিয়ে। খুব ছোটখাটো সুখ-দুঃখ আমাদের, খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জয়-পরাজয়। সামান্য আয় ব্যয় সঞ্চয়। বড় পৃথিবীটাকে ধরতে পারি না বলে আমরা আমাদের মতো জগৎটা ছোট করে নিই। আমাদের গুটিকয় প্রিয়জন মাত্র। আর তাদের দিতেই আমাদের সব ভালবাসা উজাড় হয়ে যায়। কাঙাল ভিখারিদের জন্য আমাদের টাকাটা সিকেটা বরাদ্দ থাকে। আহা গরিবদেরও তো একটু দেখতে হবে!
আরও খবর- মাদার টেরিজা ঈশ্বরের এক প্রিয় মানুষ
ম্যাসিডোনিয়ার এক জন রাঙা যুবককে বিয়ে করে তিনিও তো দিব্যি রাঙা রাঙা ছেলেপুলেদের মা হয়ে সংসারের নিজস্ব স্বর্গ রচনা করতে পারতেন। কে জানে কেন কুমারী কন্যাটির কাঁধে চাপল কোন ভূত। ঘুরে ঘুরে ধুলোটে এই পোড়া কলকাতাতেই এসে জুটতে হল তাঁকে! এলেন আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিলাম আমরা, তিনি ভুলতে দিলেন কই! এঁরা কিছুতেই আমাকে বা আমাদের ভুলতে দেন না যে আমার একটা লড়াই ছিল, যেটা আমি লড়িনি। আমার ঠাকুর যখন আমাদের বলেন, ‘‘তুমি ঠিক ঠিক জেনো যে তুমি তোমার, তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী’’, তখন ছ্যাঁকা খেয়ে চমকে উঠি। আবার নিজেকে বোঝাই, আহা, গরিবদের দুঃখমোচন, সে তো সরকারের কাজ! অনাথ আঁতুর রুগি গৃহহীনদের জন্য তো মিশনটিশন রয়েছে। আছে এনজিও, একশো দিনের কাজ, বিপিএল কার্ড। আর আমিই বা কোন বড়লোক, আমার সাধ্য কতটুকু? কিন্তু ভবী ভুলতে চায় না, যখন দেখি মা টেরিজা ফুটপাথে কুষ্ঠরোগীর ক্ষতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রলেপ দিচ্ছেন। যার কেউ নেই এমন লক্ষ্মীছাড়া পথশিশুকে তুলে নিয়ে গিয়ে যাচ্ছেন তাঁর অপ্রতুল আশ্রয়ে। বিমানযাত্রায় যেতে যেতে তাঁর অনাথ শিশুদের জন্য সহযাত্রীদের কাছে ভিক্ষা করে নিচ্ছেন তাঁদের ভুক্তাবশেষ। আমার লড়াই লড়ছেন তিনি। আর তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যেই যেন নিহিত রয়েছে সেই পুরনো প্ররোচনা, যা আমাকে বলছে, ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং তক্ত্যোত্তিষ্ঠ পরন্তেপঃ।
আরও খবর- আস্তাকুঁড় থেকে ককপিটে মাদারের শিশু
কে যেন এক বার জিজ্ঞেস করেছিল তাঁকে, মা, যখন কুষ্ঠরোগীর ক্ষত পরিচর্যা করেন তখন কি আপনার একটুও ঘেন্না হয় না! মা টেরিজা মাথা নেড়ে বলেছিলেন, হয় না, আমি যে ওর মুখে আমার খ্রিস্টের আদল দেখতে পাই!
শোনো কথা!
বিশ্বভারতীতে উদয় শঙ্করের সঙ্গে মাদার টেরিজা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
আমরা কি চোখে কিছু কম দেখি? পাখি, রমণী, প্রজাপতি, টাইগার হিলের সূর্যোদয়, আরব সাগরে সূর্যাস্ত, মাধুরী দীক্ষিতের প্রখর মুখচ্ছবি, তাজমহল, আইফেল টাওয়ার, সবই তো এই পোড়া চোখে দেখতে পাই! কিন্তু দরিদ্র, অকিঞ্চন, বুড়ো, অশক্ত, অনাথ, আতুর, রুগি বা প্রান্তিকদের মুখে খ্রিস্টের আদল দেখতে পাই না তো!
আরও খবর- ‘মেমোরিজ অব মাদার টেরিজা’
ঠিক কথা, তিনি আসলে ছিলেন এক প্রচারক। তাঁর সেবাধর্মের আবডালে তিনি বলতে চেয়েছিলেন এক ছুতোরের ছেলের কথা। ছুতোরের সেই লক্ষ্মীছাড়া ছেলে তাঁর সংসারের খেলনাপাতি ছেড়ে এক দিন শুধু ভালবাসার টানে ঘর থেকে বাহির হয়ে পড়েছিলেন। ফলস্বরূপ নিজের ক্রুশ নিজেকেই বহন করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ক্রুশে বিদ্ধ করে তাঁকে যারা মারল, তারা কত বড় ভুল যে করেছিল তা তারা নিজেরা জানলই না। যিশুকে হত্যা করতে গিয়ে তারাই তাঁকে ভয়ঙ্কর ভাবে জ্যান্ত করে দিয়েছিল, হত্যাকারীরা মরে গেছে কবেই, যিশু দু’হাজার বছর পার করেও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন যে! হাতের রক্তাক্ত ক্ষতস্থান দেখিয়ে তিনিই তো মিষ্টি হেসে বলতে পারেন, দিজ আর দি উন্ডস অব লাভ!
আরও খবর- কলকাতায় মাদারের এক্সক্লুসিভ ছবি
মা টেরিজা সেই প্রেমের ঠাকুরের কথাই তো বলতে চেয়েছেন তাঁর কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে। পোকামাকড়, পিঁপড়ে বা কীটপতঙ্গের অধম হয়ে যে সব মানুষ পড়ে আছে মাঠেঘাটে ফুটপাথে, তাদের ধর্মই বা কী, তাদের আইডেন্টিটি বা কী, নাগরিকত্বই বা কোথাকার! পাসপোর্ট নেই। আধার কার্ড নেই। অনেকের বিপিএল কার্ডও তো নেই! জন্মানোর নথি নেই, মৃত্যুরও খতিয়ান খুঁজে পাওয়া যায় না। মা তাঁদের মাথায় তাঁর হাতখানি রাখতে চেয়েছিলেন বলে কতই না অপরাধ হয়ে গেল তাঁর।
আরও খবর- ও আলোর পথযাত্রী...
সন্ত কাকে বলে আমি তা বাস্তবিকই জানি না। শুধু এইটুকু জানি কাউকে কাউকে মানুষ ঈশ্বরপুত্র বা ঈশ্বরকন্যা বলে পুজোটুজো করে। আর পুজো করার পিছনে কাজ করে তার পাটোয়ারি বুদ্ধি। যে বলে, উনি অত সব ত্যাগট্যাগ করেছিলেন, অত সব গরিবগুর্বোর সেবাটেবা করেছিলেন, ভিক্ষে করে করে এত বড় আশ্রম করেছিলেন, ও তো আর আমাদের মতো এলেবেলে লোকের কাজ নয়! এ সব ওই ভগবানের দূতেরাই পারেন। ঠিক কথা, কিন্তু সেই সঙ্গে যদি পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসে, কেন তুমি কি ঈশ্বরপুত্র নও? তুমিও কি নও ঈশ্বরকন্যা? তখন আমাদের মূক হওয়ার পালা!
আরও খবর- শান্ত, সমাহিত মাদার হাউস মগ্ন দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে
কত দিন ঘুম নেই! দীর্ঘ সাতাশি বছরের ত্রুটিহীন সেবার কাজ। ক্লান্ত মা টেরিজা সাতাশি বছর ধরে ছিলেন ‘অবসর নাই তার, নাই তার শান্তির সময়।’ ১৯৯৭ সালের পাঁচ সেপ্টেম্বর মা টেরিজা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তাঁর কাছে কখনও যাইনি। ‘মা’ বলে ডাকিওনি। আজকাল মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাঁর সমাধির কাছে গিয়ে বসি। সমাধিফলকে হাত রেখে বলি, মা, জাগো! জেগে ওঠো! বড় ইচ্ছে করে তোমার খর্বকায় শরীরের স্নিগ্ধ ছায়ায়, তোমারই পিছু পিছু কলকাতার ধুলোটে পথে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়াই খ্রিস্টের মুখ। বড় ইচ্ছে করে।
আরও খবর- তিলোত্তমার মাদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy