Iran removing four zeros from national currency Rial amid record inflation, know its impact dgtl
Iran Currency Devaluation
১০ হাজারের মূল্য রাতারাতি হয়ে গেল এক রিয়াল! মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে মুদ্রা থেকে চারটে শূন্য ছেঁটে ফেলল ইরানের শিয়া সরকার
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির জেরে ইরানি অর্থনীতির বেহাল দশা। এই পরিস্থিতিতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে রিয়াল থেকে চারটে শূন্য সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তেহরান।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো মাথায় উপর চেপে আছে নিষেধাজ্ঞার বিরাট বোঝা। এ-হেন জোড়া ফলায় ক্ষত-বিক্ষত ইরানের অর্থনীতি। বিপদ থেকে বাঁচতে তাই ভয়ঙ্কর ভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করল তেহরান। রিয়াল থেকে একসঙ্গে চারটে শূন্য ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছে সাবেক পারস্য দেশ। ফলে রাতারাতি ১০ হাজার ইরানি মুদ্রার মূল্য এক ঝটকায় কমে নেমে এসেছে এক রিয়ালে! বিষয়টিতে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০২১৮
সম্প্রতি মুদ্রার অবমূল্যায়ন সংক্রান্ত বিল পাশ করে ইরানি পার্লামেন্ট। গত কয়েক বছর ধরেই এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল তেহরান। শেষ পর্যন্ত এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল সাবেক পারস্য দেশ। গত ৫ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন পার্লামেন্টের আর্থিক কমিশনের প্রধান শামসোলদিন হুসেন। রিয়ালের অবমূল্যায়ন সংক্রান্ত পরিবর্তন যে রাতারাতি হবে না, তা অবশ্য সেখানে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
০৩১৮
ঘরোয়া অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে কয়েক বছর আগেই মুদ্রার মূল্য হ্রাস সংক্রান্ত প্রস্তাব ইরানি পার্লামেন্টের আর্থিক কমিশনের কাছে জমা পড়েছিল। কিন্তু, ওই সময় সেটা ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। চলতি বছরের জুলাইয়ে ফের এই ইস্যুতে জোরালো সওয়াল করেন তেহরানের আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এর দু’মাসের মাথায় রিয়ালের অবমূল্যায়ন সংক্রান্ত বিল পাশ হওয়ায় সাবেক পারস্য দেশটির সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
০৪১৮
১০ হাজার ইরানি মুদ্রাকে এককথায় বলে ‘টোমান’। সেই হিসাবে এক ‘টোমান’ হল ১০ হাজার রিয়াল। নতুন নিয়মে এক ‘টোমান’কে এক রিয়ালে বদলে ফেলে মুদ্রাস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে তেহরানের সরকার। এই সংক্রান্ত বিল পাশ হওয়ার পর পার্লামেন্টের আর্থিক কমিশনের প্রধান শামসোলদিন হুসেন জানিয়েছেন, মুদ্রার অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দু’বছর লাগবে। এর পর আরও তিন বছর এক ‘টোমান’কে এক রিয়ালে বদলে ফেলার সুযোগ পাবে আমজনতা। অর্থাৎ মোট পাঁচ বছর সময় হাতে পাচ্ছে উপসাগরীয় শিয়া মুলুকটির সাধারণ মানুষ।
০৫১৮
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে শামসোলদিন বলেছেন, ‘‘যাবতীয় পরিবর্তনের কাজ শেষ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দু’বছর সময় লাগবে। এর পরের তিন বছর টোমান ও রিয়াল দু’টি মূল্যের মুদ্রাই ব্যবহার করতে পারবে আমজনতা।’’ সাধারণ ইরানবাসীর সুবিধার কথা মাথায় রেখে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
০৬১৮
সম্প্রতি এক ডলারের মুল্য ইরানি মুদ্রায় দাঁড়ায় ১১ লক্ষ ৫০ হাজার রিয়াল। ফলে রকেটগতিতে ঊর্ধ্বমুখী হয় মুদ্রাস্ফীতির হার। বর্তমানে সেই সূচক ৪৩ শতাংশে ঘোরাফেরা করছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে নাজেহাল হয়ে পড়েছে আমজনতা। মামুলি কিছু সামগ্রী কিনতেই কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে তাঁদের। নতুন আইনে সেই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে বলে আশাবাদী প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েশকিয়ানের সরকার।
০৭১৮
মুদ্রার অবমূল্যায়নে ইরানি জনতার কী ভাবে সুবিধা হতে পারে, একটি উদাহরণের সাহায্যে তা বুঝে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাবেক পারস্য দেশে এক রিয়াল দামের কোনও জিনিস বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার রিয়ালে। নতুন আইনে ১০ হাজার রিয়াল আবার এক রিয়ালে নেমে আসায় ঘরোয়া বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আমজনতা এবং সমাজের উপর এর মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাবও রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৮১৮
বিশেষজ্ঞদের কথায়, নতুন নিয়মে ১০ হাজারের বদলে এক রিয়াল দিয়ে কোনও সামগ্রী কিনলে বাস্তবে খরচ কম হল বলে মনে করবে আমজনতা। তা ছাড়া এর জেরে লেনদেন এবং গণনার ক্ষেত্রে রিয়াল ব্যবহারে অনেক সুবিধা হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটিতে ব্যাঙ্ক নোটের উপযোগিতা হ্রাস পাচ্ছিল। সেখান থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পারবে তেহরান।
০৯১৮
ইরানের এ-হেন আর্থিক দুরবস্থার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। ১৯৭৯ সালে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর পর সাবেক পারস্য দেশটির কুর্সিতে বসেন কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খামেনেই। ক্ষমতায় এসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একরকম শত্রু হিসাবে দেখতে শুরু করেন তিনি। ফলে প্রমাদ গোনে আমেরিকাও। কালবিলম্ব না করে তেহরানের উপরে বিপুল আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ওয়াশিংটন।
১০১৮
বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার নিরিখে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইরান। সাবেক পারস্য দেশটির উপর রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার নিষেধাজ্ঞা। ফলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারছে না তেহরান। শুধু তা-ই নয়, আমদানির ক্ষেত্রেও নানা রকমের বাধা রয়েছে তাদের। ফলে দ্রুত নিম্নমুখী হচ্ছে সেখানকার অর্থনীতির গ্রাফ।
১১১৮
১৯৭৯ সালের ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হতে না হতেই প্রতিবেশী দেশ ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইরান। সেই সংঘর্ষ চলেছিল পরবর্তী আট বছর। সাবেক পারস্য দেশটির রাতারাতি শিয়া মুলুকে পরিণত হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তৎকালীন ইরাকি প্রেসি়ডেন্ট সাদ্দাম হুসেন। বিপ্লবের আঁচ বাগদাদের উপরে পড়তে পারে বলে মনে করেছিলেন তিনি। সংঘাতের জেরে অবশ্য তেহরানকে কোনও জমি হারাতে হয়নি। কিন্তু, যুদ্ধের খরচ বহন করতে গিয়ে যথেষ্টই কাহিল হয়ে পড়ে ইরানি অর্থনীতি।
১২১৮
২১ শতকের গোড়ার দিকে এই অবস্থা থেকে অবশ্য কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় ইরান। ওই সময় সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার এবং বাহরাইনের মতো পশ্চিম এশিয়ার উপসাগরীয় দেশগুলির চেয়ে ভাল জায়গায় ছিল তেহরানের অর্থনীতি। কিন্তু এর পরেই পরমাণু হাতিয়ার তৈরির লক্ষ্যে ইউরেনিয়ামের সমৃদ্ধিকরণ শুরু করে সাবেক পারস্য দেশ। এই বিষয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার। ফলে পরবর্তী দশকগুলিকে নিষেধাজ্ঞার রাশ কঠিন করে যুক্তরাষ্ট্র।
১৩১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার জেরে গত কয়েক বছর ধরে অপরিশোধিত খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের রফতানি প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। বর্তমানে চিন ছাড়া আর কেউই তাদের থেকে ‘তরল সোনা’ বা প্রাকৃতিক গ্যাস কিনছে না। ফলে তেহরানের কোষাগারে আসছে না ডলার বা অন্য কোনও আন্তর্জাতিক মুদ্রা। ফলে শিল্প থেকে কৃষি বা প্রযুক্তি ক্ষেত্র— কোনও কিছুর জন্যেই বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করতে পারছে না উপসাগরীয় শিয়া মুলুক।
১৪১৮
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ লেনদেন হয় ডলারে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো, ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড, জাপানি মুদ্রা ইয়েন এবং চিনা মুদ্রা রেনমিনবি বা ইউয়ানের বিশ্ব বাজারে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রথম চারটি মুদ্রাই ব্যবহার করতে পারছে না তেহরান। তাদের একমাত্র ভরসা হল ইউয়ান। ফলে দেশ চালাতে সাবেক দেশটির কোষাগার প্রায় খালি হয়ে এসেছে বলা যেতে পারে।
১৫১৮
নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধ থাকায় ইরানকে গ্রাস করেছে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে খুচরো বাজারে অগ্নিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, দৈনন্দিন ব্যবহারের বহু সামগ্রী ঠিকমতো পাওয়াই যায় না সেখানকার বাজারে। বৈদেশিক বাণিজ্যে তালা পড়ে যাওয়ায় শিল্প স্থাপনের গরজ দেখাচ্ছেন না কোনও উদ্যোগপতি। আসছে না কোনও বিদেশি বিনিয়োগও।
১৬১৮
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তাঁদের আক্রমণে মৃত্যু হয় ১,২০০ নিরীহ মানুষের। এ ছাড়া ২৫০ জনের বেশিকে পণবন্দি করে গাজ়ায় নিয়ে যায় তারা। ওই ঘটনার নেপথ্যে তেহরানের হাত থাকার অভিযোগ তোলে ইহুদিরা। ফলে দু’দফায় ছোট আকারে তেল আভিভের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সাবেক পারস্য দেশ।
১৭১৮
চলতি বছরের জুনে ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর তিন মাসের মাথায় তেহরানের চাবাহার বন্দরের উপর নিষেধাজ্ঞার মুঠো আরও শক্ত করে ওয়াশিংটন। ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করছিল সাবেক পারস্য দেশ। আমেরিকার ওই পদক্ষেপের জেরে সেখান দিয়ে পণ্য নিয়ে যেতে জরিমানা দিতে হবে নয়াদিল্লিকে। ফলে আগামী দিনে বন্দরটির ব্যবহার কমবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
১৮১৮
বর্তমানে ইরানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) মাত্র ৩৪১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারতের অর্থনীতি এর ১৫ গুণ বড়। মুদ্রাস্ফীতির হারের নিরিখে প্রথম তিনের মধ্যে রয়েছে তেহরান। মুদ্রার অবমূল্যায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে বাঁচানোর চেষ্টা কিন্তু সাবেক পারস্য দেশটি প্রথম করছে এমনটা নয়। এর আগে ভেনেজ়ুয়েলা এবং তুরস্ককে এই রাস্তা অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছে। আঙ্কারা তো তাদের মুদ্রা লিরা থেকে একবার ছ’টি শূন্য সরিয়ে দিয়েছিল।