অনলাইনে বই কেনার ইতিহাসও রয়েছে যৌন অপরাধীর এপস্টিনের। এর মধ্যে তাঁর সর্বাধিক অর্ডার করা বই ছিল তাঁর উপরেই লেখা। বইটির নাম, ‘ফিলথি রিচ: দ্য জেফ্রি এপস্টিন স্টোরি’। চলচ্চিত্র নির্মাতা উডি অ্যালেনের একাধিক জীবনীও কিনেছিলেন তিনি। এ ছাড়া বেশি কিছু বই কিনেছিলেন সুইস ব্যাঙ্ক, অমরত্ব, অ্যাডলফ হিটলারকে নিয়ে।
মার্কিন ধনকুবের জেফ্রি এডওয়ার্ড এপস্টিনের জন্ম হয় আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে। সালটা ছিল ১৯৫৩। মার্কিন পুলিশের দাবি, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যৌন কেলেঙ্কারিতে ফাঁসিয়ে তাঁদের ব্ল্যাকমেল করতেন এপস্টিন। এ ব্যাপারে অবশ্য তিনি নিজেও একই দোষে দোষী ছিলেন। ২০০৮ সালের মধ্যে অন্তত ৪০ জন মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। তদন্তে জানা যায়, বেশ অল্প বয়সেই তাঁরা ধনকুবেরের ইন্দ্রিয়াসক্তির শিকার হন। ১৮ বছরে পা দেওয়ার আগেই সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের।
২০০৫-’০৮ সালের মধ্যে এপস্টিনের বিরুদ্ধে স্কুলপড়ুয়াদের ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে যৌন লালসার শিকার বানানোর অভিযোগ জমা পড়ে মার্কিন পুলিশের কাছে। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই এপস্টিনের হাতে পরে হাতকড়া। পুলিশ তাঁকে জেলে নিয়ে গিয়েছিল। যদিও বেশি দিন তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। অভিযোগ, প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় খুব দ্রুত গারদের বাইরে চলে আসেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এর পর আরও বেপরোয়া ভাবে যৌন কেলেঙ্কারির ব্যবসা ফেঁদে বসেন তিনি।
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, কখনও টাকার জোরে, কখনও আবার নাবালিকাদের অপরিণতমনস্কতার সুযোগ নিতেন এপস্টিন। ভয় দেখিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে সহবাস করতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া মেয়েদের হেভিওয়েটদের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন এপস্টিন। সেই তালিকায় নাম আছে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও ল্যারি পেজ়, পপ-গায়ক মাইকেল জ্যাকসন, ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং হলিউড তারকা লিয়োনার্দো ডি ক্যাপ্রিও-সহ আরও অনেকের।
এপস্টিনের এই কেলেঙ্কারি বেশি দিন চলেনি। ফের তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় মার্কিন পুলিশ। সেখানে ২০১৯ সালে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। জেল কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারীরা জানান, আত্মহত্যা করেছেন এপস্টিন। যদিও তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছিল। এপস্টিনের মৃত্যুর সময় জেলের যাবতীয় সিসিটিভি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলি ফের কাজ করা শুরু করেছিল। পুলিশ অবশ্য একে কাকতালীয় বললেও ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
এপস্টিনের সঙ্গেই গ্রেফতার হন তাঁর প্রেমিকা গিজ়লাইন ম্যাক্সওয়েল। বর্তমানে আমেরিকার জেলে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে রয়েছেন তিনি। তদন্তকারীদের দাবি, কমবয়সি তরুণীদের ফাঁসানোর কাজটা প্রথমে করতেন ম্যাক্সওয়েলই। ‘ক্লাইম্যাক্স’ পর্বে আবির্ভাব হত এপস্টিনের। এ বছর প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প দ্বিতীয় বার শপথ নিতেই বিচার বিভাগে পড়ে থাকা এপস্টিন ফাইল প্রকাশ করার দাবি জোরালো হতে থাকে। ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) প্রথমে বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলেও পরে সংশ্লিষ্ট ফাইল জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে আপত্তি করেননি, খবর সূত্রের।
চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইলগুলির আরও কিছু অংশ প্রকাশ্যে আনে আমেরিকার বিচার বিভাগ বা ডিওজে (ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস)। সেখানে থাকা ছবিগুলি জনসমক্ষে চলে আসতেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে হইচই পড়ে যায়। দেখা যায়, তরুণী লাস্যময়ীদের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ধনকুবের শিল্পপতি-সহ একাধিক হেভিওয়েটরা। অপ্রাপ্তবয়স্করাও যে তাঁদের লালসার শিকার হয়েছে, এপস্টাইন ফাইল প্রকাশে তা-ও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে।
এ-হেন পরিস্থিতিতে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালেন বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হাউস ওভারসাইট কমিটির সদস্যেরা। ২০ ডিসেম্বর এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি বিস্ফোরক পোস্ট করেন তাঁরা। সেখানে বলা হয়, ‘‘এপস্টিন ফাইলের ৪৬৮ নম্বর নথিকে বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, ওটা থাকলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যেত।’’ তাঁদের ওই পোস্টের পর ফুঁসে ওঠে নেটাগরিকদের একাংশ। সমাজমাধ্যমে ওঠে সমালোচনার ঝড়।
২০ তারিখ এই ইস্যুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই গণমাধ্যমটির দাবি, হঠাৎ করে ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে যাওয়া অন্তত ১৬টি ফাইলের মধ্যে ট্রাম্পের ছবি ছিল। এর পরই সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেন নেটাগরিকদের একাংশ। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘কোন বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চাইছে প্রশাসন? আমেরিকার উন্নতির জন্য স্বচ্ছতার প্রয়োজন।’’ অন্য দিকে, এ ব্যাপারে নতুন করে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে তাঁর প্রশাসনও।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এপস্টিন ফাইলে ট্রাম্পের নাম জড়ানোর নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। অতীতে বহু বার প্রকাশ্যেই এপস্টিনকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও সেই ‘বন্ধু’র জন্যই যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলারা যৌন লালসার শিকার হয়েছে, তা তিনি জানতেন না বলে স্পষ্ট করেছেন ট্রাম্প। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ওই বিবৃতির পরেও কড়া প্রশ্নবাণে তাঁকে বিদ্ধ করতে ছাড়ছেন না বিরোধী ডেমোক্র্যাটেরা। এতে ট্রাম্পের অস্বস্তি যে বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
যদিও এক্স হ্যান্ডলে করা পোস্টে ডিওজে বলেছে, ‘‘আইন মেনে সংশ্লিষ্ট নথি জনসমক্ষে আনা হয়েছে। কোনও রাজনীতিকের নাম বদল করা হয়নি। কারও নাম সংশোধনও করা হয়নি। যেহেতু এঁরা পরিস্থিতির শিকার, না কি ভুক্তভোগী, না কি অপরাধী সেটা প্রমাণ হয়নি, তাই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।’’ কিন্তু, তার পরেও ডেমোক্র্যাটেরা ট্রাম্পের ছবি সেখান থেকে সরানোর অভিযোগ করায় চড়তে শুরু করেছে রাজনীতির পারদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy