এখনও পর্যন্ত রেকর্ড করা বৃহত্তম আর্থিক ট্রেডিং কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি হল সোসিয়েট জেনারেল ব্যাঙ্কের তছরুপ মামলা। খ্যাতনামী এই ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গরিব মানুষটি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ০৯:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৭
হতদরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র বললে কম বলা হয়। দরিদ্র বললে যে চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে মেলাতে গেলে খানিকটা হোঁচটই খেতে পারে সেই ধারণা। প্যারিসের রাস্তায় হেঁটে যাওয়া আর পাঁচজন সাধারণ নাগরিকের মতোই সাদামাঠা চেহারা। মাথার উপর ছাদ ও দু’বেলা অন্নসংস্থান হওয়ার মতো সঙ্গতি রয়েছে তাঁর। তবুও তাঁর কপালে জুটেছে বিশ্বের ‘সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ’-এর খেতাব।
০২১৭
জ়েরম কেয়ারভিল। ফরাসি নাগরিক জ়েরমের ঘাড়ে ঝুলছে বিপুল আর্থিক বোঝা। সেই ঋণের অঙ্কটি পৃথিবীর বহু ধনকুবেরের উপার্জিত মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। আর্থিক তছরুপের দায়ে জ়েরমের ঘাড়ে প্রায় ৪.৯৫ লক্ষ কোটি টাকার দেনার খাঁড়া ঝুলছে। তাঁর এই আর্থিক কেলেঙ্কারি আংশিক প্রভাব ফেলেছিল বিশ্ব অর্থনীতিতেও।
০৩১৭
ইউরোপের বাণিজ্যিক মহলে শোরগোল ফেলা বিপুল পরিমাণ আর্থিক নয়ছয়ের মূল চক্রী জ়েরমের মাসমাইনে নেহাত কম ছিল না। প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা। সেই টাকায় বিলাসবহুল জীবন যাপন করছিলেন তিনি। ফ্রান্সের খ্যাতনামী ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গরিব মানুষটি।
০৪১৭
এখনও পর্যন্ত রেকর্ড করা বৃহত্তম আর্থিক ট্রেডিং কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি হল জ়েরমের এই কীর্তিটি। ১৯৭৭ সালে ফ্রান্সের ব্রিটানির একটি ছোট শহরে জন্মান জ়েরম। তাঁর পরিবার ছিল খুবই সাধারণ। মা ছিলেন কেশসজ্জা শিল্পী এবং বাবা কামার।
০৫১৭
ছোট থেকেই লেখাপড়ায় তুখোড় ছিলেন জ়েরম। লিয়ঁর লুম্যিয়ের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর হন। পড়াশোনার পর্ব শেষ করার পর ফ্রান্সের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্ক সোসিয়েট জেনারেল ব্যাঙ্কের জুনিয়র ট্রেডার হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। সালটা ছিল ২০০০।
০৬১৭
অল্প দিনের মধ্যেই জ়েরমের দক্ষতা নজরে আসে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের। ২০০৫ সালে তাঁকে ডেল্টা ওয়ানে নিযুক্ত করা হয়। এটি ছিল ব্যাঙ্কেরই অত্যাধুনিক ট্রেডিং ইউনিট। এই দফতরটি শেয়ার ট্রেডিং, অ্যালগরিদম এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। ৫৪ লক্ষ ৪৯ হাজার টাকা বেতন পেতেন তিনি।
০৭১৭
প্রযুক্তি ও ট্রেডিংয়ে চমৎকার দক্ষতা দেখে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জুনিয়র ট্রেডার হওয়া সত্ত্বেও জ়েরমকে লক্ষ লক্ষ ডলার লেনদেনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেই জ্ঞান এবং দক্ষতার অপব্যবহার করেছিলেন এই ব্যাঙ্কার। ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলিকে খুঁজে নিয়ে নিজের ব্যবসায়িক লাভের অঙ্ক কষতে শুরু করেছিলেন তিনি।
০৮১৭
সংস্থার বুকের উপর বসে তারই দাড়ি উপড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেন জুনিয়র কর্মী। ব্যাঙ্কের মূলধন ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা ফেঁদে বসেন তিনি। ব্যাঙ্কের সিস্টেমের সহায়তায় অফসেটিং লেনদেন শুরু করেন। অফসেট লেনদেন হল একটি কৌশল যেখানে কোনও ভাল শেয়ার বা ট্রেডিংয়ের বিপরীতমুখী লেনদেন করা হয়, যাতে এর প্রভাব নিরপেক্ষ হয়।
০৯১৭
ধরা যাক কেউ কোনও সংস্থার ১০০টি শেয়ার কিনলেন। তিনি সেই ১০০টি শেয়ার বিক্রি করে অফসেট করতে পারেন।
১০১৭
এক পর্যায়ে জ়েরম বাজারে পাঁচ হাজার কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছিলেন। সেই অঙ্কটা ছিল সোসিয়েট জেনারেলের বাজার মূলধনের চেয়েও বেশি। তিনি তলে তলে এক বছরেই আনুমানিক ৭ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে ফেলেছিলেন বলে পরে জানা গিয়েছিল।
১১১৭
প্রাথমিক ভাবে, তাঁর ব্যবসা লাভজনক ছিল। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের থেকে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন জ়েরম। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কট দেখা দেওয়ার পরই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। সোসিয়েট জেনারেলকে যে ফোঁপরা করে দিয়েছেন ব্যাঙ্কেরই ‘বিশ্বস্ত’ ও প্রিয়পাত্র জ়েরম তা ধরা পড়ে যায়।
১২১৭
দীর্ঘ দিন ধরে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় বসে জ়েরম যে এই অনিয়ম করে আসছেন তা ব্যাঙ্কের অজানা ছিল না। জ়েরম প্রতিটি অনিয়ম গোপন করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন তা-ও জানত ব্যাঙ্ক। লাভের ঘাটতি ছিল না বলে ব্যাঙ্ক বিশেষ মাথা ঘামায়নি।
১৩১৭
আর্থিক কেলেঙ্কারিটি প্রকাশ্যে আসে ২০০৮ সালে, অভ্যন্তরীণ তদন্ত করতে বাধ্য হয় ব্যাঙ্ক। তখনই ফাঁস হয় কেলেঙ্কারি। ৪.৯৫ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে জ়েরমের বিরুদ্ধে। মাথায় হাত পড়ে কর্তৃপক্ষের। ব্যাঙ্কের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে এই ঘটনায়।
১৪১৭
বিশ্বাসের অপব্যবহার, জালিয়াতি এবং কম্পিউটার সিস্টেমের অননুমোদিত ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। জ়েরম দাবি করেছিলেন, ব্যাঙ্ক তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন ছিল। অন্তত মুনাফা আসার সময় সেগুলি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্যাঙ্কের কর্মকর্তারা।
১৫১৭
২০১০ সালে ফরাসি আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। পরে সেই সাজা কমিয়ে তিন বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁকে তছরুপের সমান পরিমাণ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে তাঁকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ঋণী মানুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
১৬১৭
মাত্র পাঁচ মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর ২০১৪ সালে ইলেকট্রনিক নজরদারির শর্তে মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। অর্থাৎ, তাঁর ফোন ও ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের উপর নজরদারি চালানো হবে। ২০১৬ সালে একটি শ্রম আদালত রায় দিয়ে জানায়, তাঁকে বাস্তব এবং গুরুতর কারণ ছাড়াই বরখাস্ত করা হয়েছে। ফ্রান্সের শীর্ষ আদালত পরে ৪.৯ লক্ষ কোটি টাকা পরিশোধ করার রায়টি বাতিল করে। আদালত উল্লেখ করে যে সোসিয়েট জেনারেলও এই জালিয়াতির অংশীদার। তাদের নজরদারিতে ফাঁক থেকে গিয়েছিল।
১৭১৭
সমাজে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে এবং কর্পোরেট লোভ ও আর্থিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি নিয়েছিলেন এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। রোম থেকে প্যারিস পর্যন্ত ১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক পদযাত্রা করেন জ়েরম। সাজা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে আইটি পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি’।