চিনা মাফিয়াদের সাইবার অপরাধের গড়ে হঠাৎ হানা দিয়ে খবরের শিরোনামে মায়ানমারের জুন্টা সরকারের ফৌজ। তাঁদের ‘অপারেশন’ চলাকালীন পার্শ্ববর্তী খরস্রোতা নদীতে কয়েক ডজন ভারতীয় ঝাঁপ দেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৫৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে সাবেক ব্রহ্মদেশ। সেই অরাজকতার সুযোগে চিনা মাফিয়াদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে আরাকানভূমি। পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে বসে ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে পাচার হয়ে আসা ব্যক্তিদের দিয়ে সাইবার অপরাধের বিরাট এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে তারা। বিষয়টি নজরে আসতেই টনক নড়ে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের। ফলস্বরূপ শুরু হয়েছে সেনা অভিযান এবং ব্যাপক ধরপাকড়। এর জেরে ভারত থেকে পাচার হওয়া নাগরিকদের দেশে ফেরার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হল বলেই মনে করা হচ্ছে।
০২১৮
চলতি বছরের ২২ অক্টোবর গভীর রাতে মায়ানমারের কুখ্যাত মায়াওয়াডি এলাকার কে কে পার্কে আচমকাই সেনা অভিযান চালায় জুন্টা সরকার। চিনা মাফিয়া পরিচালিত একটি চত্বরে ঢুকে পড়ে তারা। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সময়ে সেখান ছিলেন পাচার হয়ে আসা প্রায় ৭০০ বিদেশি নাগরিক। জুন্টার সৈনিকেরা ‘অপারেশন’ শুরু করতেই সেখান থেকে চম্পট দেন তাঁরা। পলাতক বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়ের সংখ্যা কয়েক ডজন বলে জানিয়েছে বর্মা মুলুকের একাধিক সংবাদমাধ্যম।
০৩১৮
অন্য দিকে প্রতিবেশী তাইল্যান্ডের বেতার স্টেশন ‘তাই পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ আবার জানিয়েছে, বর্মী ফৌজের অভিযানের সময়ে প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পার্শ্ববর্তী মোই নদীতে ঝাঁপ দেন বিদেশি নাগরিকদের একাংশ। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতরে তাইল্যান্ডে আসতে পেরেছেন। বাকিদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে নদীর খরস্রোত। যদিও পাচার হওয়া বিদেশিদের মোট ক’জন নদীতে ডুবে মারা গিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। মৃতদের দেহ উদ্ধার হয়েছে কি না, তা-ও জানা যায়নি।
০৪১৮
এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে ব্যাঙ্ককের সরকার এবং ফৌজ। সেখানে বলা হয়েছে, মায়ানমারের কে কে পার্ক থেকে পালিয়ে মোট ৬৭৭ জন তাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের তাক প্রদেশে ঢুকে পড়েন। এঁদের মধ্যে ৬১৮ জন পুরুষ এবং ৫৯ জন মহিলা। সকলকে আটক করেছে সেনা ও স্থানীয় প্রশাসন। ধৃতদের বয়ান থেকে জানা গিয়েছে, জুন্টা বাহিনীর অভিযানের সময়ে গা ঢাকা দিতে মায়ানমারের মায়াওয়াডির আশপাশের এলাকাকে বেছে নিয়েছেন তাঁরা।
০৫১৮
জুন্টা বাহিনীর এই ‘অপারেশন’ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাবেক ব্রহ্মদেশের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইরাবতী’। তাদের দাবি, অভিযানের সময় চিনা মাফিয়াদের কবল থেকে চম্পট দেয় হাজার হাজার শ্রমিক। সেখান থেকে উদ্ধার হয় ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতি ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্সের ৩০টি স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট রিসিভার এবং অন্যান্য ইন্টারনেট ডিভাইস। এগুলি সাইবার অপরাধের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে একরকম নিশ্চিত মায়ানমারের সরকারি বাহিনী।
০৬১৮
সংশ্লিষ্ট অভিযানের পরেই মায়ানমারের ২,৫০০ কেন্দ্রে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স। এই ইস্যুতে স্টারলিঙ্কের এক শীর্ষ পদাধিকারী সংবাদসংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ বা জালিয়াতি হবে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে সেটা শুরু হয়েছে।’’ এর প্রভাব যে স্টারলিঙ্কের ব্যবসার উপর পড়বে, তা বকলমে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।
০৭১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জুন্টা সরকারের এই অভিযান নিয়ে ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন। সমালোচকদের দাবি, কে কে পার্ক এলাকাটি পরিচালনার দায়িত্বভার রয়েছে মায়ানমারের ‘বর্ডার গার্ড ফোর্স’ বা বিজিএফের উপর। তাদের নজর এড়িয়ে সেখানে দিব্যি চিনা মাফিয়ারা ঘাঁটি গেড়ে ছিল, এ কথা মেনে নেওয়া অসম্ভব। গৃহযুদ্ধের ফলে আরাকানভূমির সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ। আর তাই নজর ঘোরাতে গোটা অপারেশনের পরিকল্পনা করেন জুন্টার ফৌজি কর্তারা।
০৮১৮
এই নিয়ে ‘দ্য ইরাবতী’কে এক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট অভিযানটিকে একটি জনসংযোগমূলক স্টান্ট ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এর মাধ্যমে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারের তরফে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কে কে পার্ক এলাকায় প্রায় ২০০-র বেশি বাড়ি রয়েছে। ৯৮ জন নিরাপত্তারক্ষীকে ধরে সেখানকার বাসিন্দাদের সংখ্যা ২,২০০। এঁদের বড় অংশই চৈনিক মাফিয়া এবং হ্যাকিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। অথচ কেউ গ্রেফতার হলেন না!’’
০৯১৮
কে কে পার্কের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য ইরাবতী’ জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট অভিযানের পর সেখানকার সাইবার অপরাধচক্র গুঁড়িয়ে গিয়েছে, এমনটা নয়। উল্টে দিব্যি নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে চিনা মাফিয়ারা। অন্য দিকে সেখান থেকে পালিয়ে আসা আর্জেন্টিনা, মালয়েশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বাসিন্দাদের দেশে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে প্রতিবেশী ব্যাঙ্ককের সরকার। অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সীমান্তে অপেক্ষা করতে বলেছে তারা।
১০১৮
সূত্রের খবর, তাইল্যান্ড সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময়ে পথ হারিয়ে ফেলা আট ভারতীয়কে উদ্ধার করেছে স্থানীয় মায়ানমার প্রশাসন। তাঁদের একটি আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এঁদের দেশে ফেরাতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক যে উদ্যোগী হবে, তা বলাই বাহুল্য। স্থানীয় শরণার্থী সহায়তা গোষ্ঠীগুলি ওই আশ্রয় শিবিরে খাবার এবং ত্রাণ পাঠিয়েছে বলে লিখেছে ‘দ্য ইরাবতী’।
১১১৮
তাইল্যান্ড সীমান্ত সংলগ্ন মায়ানমারের কুখ্যাত মায়াওয়াডি এলাকার পরিচয় ‘বিশ্ব প্রতারণা রাজধানী’ হিসাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিপ্টো মুদ্রার সাম্রাজ্যে সাইবার হামলা করাই সেখানকার চিনা মাফিয়াদের মূল উদ্দেশ্য। এই হ্যাকিংয়ের জন্য ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা ব্যক্তিদের ভয় দেখিয়ে জোর করে কাজে লাগাচ্ছে তারা। পর্দার আড়ালে থেকে সংশ্লিষ্ট চক্রে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক বর্মা মুলুকের সামরিক জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধেও।
১২১৮
কী ভাবে মায়ানমারের চিনা মাফিয়াদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন ভারতীয়রা? গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মূলত মোটা টাকা চাকরির টোপ দিয়ে তাঁদের ওই এলাকায় টেনে আনছে অপরাধীদের চাঁইরা। এক বার সেখানে ঢুকে পড়লে বেরোনোর পথ পুরোপুরি বন্ধ। এর পর কেউ হ্যাকিং করতে না চাইলে বা পালানোর চেষ্টা করলে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তাঁকে। এমনকি খুন করে মৃতদেহ গায়েব করার অভিযোগও রয়েছে এই মাফিয়াচক্রের বিরুদ্ধে।
১৩১৮
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মায়ানমারের কুখ্যাত মায়াওয়াডি এলাকা থেকে চার জনকে উদ্ধার করে ঘরে ফেরায় বিদেশ মন্ত্রক। এর আগে মার্চে ৫০০ জনকে সেখান থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল নয়াদিল্লি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এঁদের প্রত্যেককেই ভুয়ো চাকরির টোপ দিয়েছিল চিনা মাফিয়ারা। সেই ফাঁদে পা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ব্রহ্মদেশে পাড়ি দেন তাঁরা।
১৪১৮
সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরেই কে কে পার্কের চিনা অপরাধীচক্রকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার। সেই কারণে ওই এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব বিজিএফের পাশাপাশি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে রেখেছে তারা। আর তাই ২৪ ঘণ্টা হাতিয়ার নিয়ে সেখানে কাউকে না কাউকে টহল দিতে দেখা যায়। কারণ, মানবপাচার ও সাইবার অপরাধের অর্থ ঘুরপথে হাতে পাচ্ছেন জুন্টার কর্তা-ব্যক্তিরা। লম্বা সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ সামাল দেওয়ার জন্য যে অর্থ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।
১৫১৮
সম্প্রতি এই ইস্যুতে ব্রহ্মদেশের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয় ‘জাস্টিস ফর মায়ানমার’ বা জেএফএম নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন। তাদের অভিযোগ, মানবপাচার এবং সাইবার অপরাধকে মদত দিতে কে কে পার্কের মতো এলাকায় নাম ভাঁড়িয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে জুন্টা প্রশাসন। চিনা মাফিয়াদের সেখানে ঘর ভাড়া দিয়ে চাঁদা এবং কর বাবদ বিপুল টাকা তুলছে তারা। মাদকপাচারের জন্যেও ওই এলাকার কিছু বাড়ি ব্যবহার হচ্ছে বলে দাবি করেছে তারা।
১৬১৮
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মায়ানমারের ক্ষমতায় আসে জুন্টা। ওই সময়ে কোভিড অতিমারির প্রকোপে বিশ্ব জুড়ে চলছিল মৃত্যুমিছিল। এ-হেন অস্থিরতার সদ্ব্যবহারে দেরি করেনি চিনা মাফিয়াচক্র। সাবেক বর্মা মুলুকের তাইল্যান্ড, লাওস এবং কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে ঘাঁটি গাড়ে তারা। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধচক্রের সঙ্গে জুন্টা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে কে কে পার্কের মতো অন্তত ৩০টি জালিয়াতি কেন্দ্র রয়েছে।
১৭১৮
ঘন জঙ্গল এবং পাহাড় ঘেরা মায়ানমারের সীমান্তবর্তী ওই এলাকাগুলি অত্যন্ত দুর্গম। ফলে আইনরক্ষকদের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা বেশ কঠিন। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলায় বর্তমানে চিনা মাফিয়াদের আটকানোর কেউ নেই। আর তাই কে কে পার্কের মতো এলাকা বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধীদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়ে গিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৮১৮
রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমান, বর্তমানে মায়ানমারের এক লক্ষের বেশি মানুষ সংশ্লিষ্ট জালিয়াতি কেন্দ্রগুলিতে আটকে রয়েছেন। কঠিন ভূ-প্রকৃতি, দেশের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং গৃহযুদ্ধের কারণে তাঁদের কত শতাংশকে উদ্ধার করা যাবে, তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে।