Nepal claims Lipulekh Pass, Limpiyadhura and Kalapani of his own territory but India rejects, know border dispute dgtl
India Nepal Border Dispute
ব্রিটিশ আমলের ২০৯ বছরের পুরনো সন্ধিতেই হিসাব ‘গুবলেট’! কোন যুক্তিতে লিপুলেখ গিরিখাতের স্বত্ব চাইছে নেপাল?
উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং পূর্ব কালাপানি এলাকার উপরে দীর্ঘ দিন ধরেই অধিকার দাবি করে আসছে নেপাল। স্বাধীনতার পর অবশ্য এই নিয়ে ছিল না কোনও বিবাদ। কোন যুক্তিতে ওই এলাকার দখল চাইছে হিমালয়ের কোলের দেশ?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৫ ১১:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
দুই পাহাড়ের মধ্যে সরু একফালি রাস্তা, হিমালয়ের বুক চিরে যা চলে গিয়েছে সোজা চিনে। সেই পথ ধরে বেজিঙের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। কিন্তু, বাদ সেধেছে মাঝের গোর্খাভূমি। তাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট এলাকার আসল ‘মালিক’ তারা। ফলে মাউন্ট এভারেস্টের কোলের দেশটির সঙ্গে বাড়ছে ভারতের সংঘাত। বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এ দেশের দুঁদে কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
০২২০
‘দেবভূমি’ উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ গিরিপথ। সম্প্রতি ওই এলাকাকে নিজেদের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করে বসে নেপাল। এ ছাড়া কালী নদীর পূর্ব দিকের লিম্পিয়াধুরা এবং পূর্ব কালাপানির দখলও নিতে চেয়েছে কাঠমান্ডু। চলতি বছরের ২০ অগস্ট একটি মানচিত্র প্রকাশ করে হিমালয়ের কোলের স্থলবেষ্টিত ওই গোর্খাভূমি। সেখানে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিকে নেপালের এলাকা বলে দেখানো হয়েছে।
০৩২০
কাঠমান্ডু ওই মানচিত্র প্রকাশ করতেই তুঙ্গে ওঠে বিতর্ক। নেপালের দাবি যে মানা হবে না, তা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতি দেয় বিদেশ মন্ত্রক। দুই প্রতিবেশীর এই সীমান্ত বিবাদ কিন্তু আজকের নয়। এর সূত্রপাত হয় কোম্পানির আমলে। সমস্যা মেটাতে একটা সময় যুদ্ধে জড়িয়েছিল দু’পক্ষ। তার পর লম্বা সময় চুপ করে থাকলেও মাঝেমধ্যেই যে ছাইচাপা আগুনে হাওয়া লেগেছে, তা বলাই বাহুল্য।
০৪২০
১৭৫৭ সালের পলাশি এবং ১৯৬৪ সালের বক্সার যুদ্ধের পর এ দেশে দ্রুত গতিতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নেপালে তখন গোর্খা রাজাদের শাসন চলছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাঠমান্ডু। উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চলের উপর বরাবরই লোভ ছিল নেপালি রাজাদের। এ বার সেটা দখলে উঠেপড়ে লাগেন তাঁরা।
০৫২০
ওই সময়ে অবধকে (বর্তমান অযোধ্যা) বাফার রাজ্য হিসাবে ব্যবহার করছিল কোম্পানি। উনিশ শতকে সেখানকার নবাবের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে ইংরেজরা। এর মাধ্যমে দেশীয় রাজ্যটির নিরাপত্তার দায়িত্ব পায় তারা। ফলে উত্তরপ্রদেশের তরাই এলাকায় নেপালের গোর্খা রাজারা আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতেই প্রমাদ গোনে কোম্পানি। এর পরেই হিমালয়ের কোলের দেশটি দখলের নীলনকশা ছকতে শুরু করেন ব্রিটিশ ফৌজি জেনারেলরা।
০৬২০
কাঠমান্ডু অবশ্য তত দিনে দাপট দেখাতে শুরু করেছে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই পূর্বে মেচি পেরিয়ে তিস্তা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে ফেলেন নেপালরাজ। পশ্চিমে কুমায়ুঁ এবং গঢ়বাল পেরিয়ে সীমান্তকে পঞ্জাবের শতদ্রু নদীর তীরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। গোর্খাদের এ-হেন শক্তি প্রদর্শনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বেশ কিছু ভারতীয় রাজা। নেপালের ‘ডানা ছাঁটতে’ ক্রমাগত কোম্পানিকে যুদ্ধের জন্য উস্কানি দিতে থাকেন তাঁরা।
০৭২০
১৮১৪ সালে নেপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কোম্পানি। সেই লড়াইয়ে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন কুশলী সেনা অফিসার ডেভিড অক্টারলোনি। গঢ়বাল, পটিয়ালা এবং সিকিমের রাজাদের অবশ্য পাশে পেয়েছিলেন তিনি। টানা দু’বছর সংঘর্ষের পর হার মানে গোর্খা সেনা। আলমোড়ার কাছে চূড়ান্ত যু্দ্ধে হেরে গিয়ে পিছু হটে তারা। ফলে হিমালয়ের কোলের দেশটির একাধিক এলাকা দখল করে ব্রিটিশ ফৌজ।
০৮২০
১৮১৬ সালে বিহারের সুগৌলিতে কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করেন নেপালরাজ। সেই চুক্তি অনুযায়ী হিমালয়ের কোলের দেশটির নতুন করে সীমান্ত নির্ধারণ করেন ব্রিটিশ সেনা অফিসারেরা। ঠিক হয়, পশ্চিমে শতদ্রু থেকে পূর্বে তিস্তা নদী পর্যন্ত এলাকা থাকবে না কাঠমান্ডুর আওতায়। তবে পশ্চিমে মহাকালী নদী থেকে পূর্বে মেচি পর্যন্ত এলাকা গোর্খাদের শাসন করতে দিয়েছিল কোম্পানি।
০৯২০
স্বাধীনতার পর লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং পূর্ব কালাপানির এলাকার নিয়ন্ত্রণ পায় ভারত। ওই সময় কোনও রকমের বিরোধিতা করেনি নেপাল। ১৯৫০ সালে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ তিব্বত আক্রমণ করলে ওই এলাকায় ১৮ থেকে ১৯টা সামরিক এবং পুলিশ চৌকি বসিয়ে দেয় নয়াদিল্লি। কাঠমান্ডুর অনুমতি নিয়ে অবশ্য সেটা করা হয়েছিল। এ দেশের শীর্ষ সেনা অফিসারদের একাংশের মনে হয়েছিল, ওই রাস্তায় হামলা চালাতে পারে বেজিং।
১০২০
১৯৬৯ সালে সংশ্লিষ্ট চৌকিগুলিকে লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং কালাপানি থেকে সরাতে বলে নেপাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এই নিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন নেপালি প্রধানমন্ত্রী কীর্তি নিধি বিশ্ত। কাঠমান্ডুর দাবি মেনে ওই সময়ে সেনা চৌকি সরিয়ে নেয় নয়াদিল্লি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কালাপানির চৌকি নিয়ে আপত্তির কথা জানাননি বিশ্ত। ফলে সেখানকার কাঠামো বদলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি ইন্দিরা সরকার।
১১২০
পরবর্তী দশকগুলিতেও কালাপানি, লিপুলেখ বা লিম্পিয়াধুরা নিয়ে কোনও দাবি তোলেনি নেপাল। ফলে সেখানে অবাধে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ চালিয়ে গিয়েছে ভারত। কিন্তু, ২০১৫ সাল থেকেই এ ব্যাপারে সুর বদলাতে থাকে কাঠমান্ডু। ২০২০ সালে ধরচুলা থেকে লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরির কাজ শেষ করে নয়াদিল্লি। তার পর থেকে দু’তরফে আরও তীব্র হয় বিবাদ।
১২২০
বিশ্লেষকদের দাবি, ভারত-নেপাল সীমান্ত বিবাদের উৎস লুকিয়ে আছে সুগৌলির সন্ধিতে। চুক্তি অনুযায়ী, মহাকালী নদীর পূর্ব পারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার কথা কাঠমান্ডুর। কিন্তু, বিশেষ একটি প্রস্রবণের জল সংশ্লিষ্ট নদীটিতে প্রবাহিত হচ্ছে, এমনটা নয়। সেখানে এসে মিশেছে আরও দু’টি ধারা। তারই একটি হল কালাপানি নদী, যার উৎপত্তি লিপুলেখ গিরিপথের কাছে। অপর ধারাটির নাম কুঠি নদী। এর উৎস আবার উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুঁ এলাকায়, লিম্পিয়াধুরা গিরিপথের ঠিক নীচে।
১৩২০
নেপালের দাবি, কুঠি ও কালাপানি নদী হল মহাকালী নদীর আসল উৎস। সেই হিসাবে জায়গাটি তাদের সীমান্তের মধ্যেই পড়ছে বলে জানিয়েছে কাঠমান্ডু। অন্য দিকে, নয়াদিল্লির পাল্টা যুক্তি, মহাকালী বা কালী নদীর উৎপত্তিস্থল কালাপানি গ্রামের একটি প্রস্রবণ। সেটা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পিথোরাগড় জেলায় অবস্থিত।
১৪২০
লিপুলেখ গিরিপথের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। তিন দেশের সংযোগস্থলে রয়েছে ওই পাহাড়ি রাস্তা। এর এক দিকে ভারত, অপর দিকে চিন এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে নেপাল। ১৯৫৪ সালে সংশ্লিষ্ট গিরিপথটি ধরে বেজিঙের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য শুরু করে নয়াদিল্লি। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারি আসার আগে পর্যন্ত এটি অব্যাহত ছিল। করোনা আসার পর দু’তরফে বন্ধ হয় লিপুলেখ, গত পাঁচ বছরে নানা কারণে যা আর চালু হয়নি।
১৫২০
লিপুলেখ গিরিপথের দ্বিতীয় সুবিধা হল, এই রাস্তায় কৈলাস-মানস সরোবরে পৌঁছোতে পারবেন তীর্থযাত্রীরা। চিন অধিকৃত তিব্বতে রয়েছে হিন্দুদের ওই পবিত্র ধর্মস্থল। এর জন্য ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট গিরিখাতটি বরাবর ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার কাজ শেষ করে ভারত। তখনও তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আপত্তি জানিয়েছিল নেপাল। যদিও তা কানে তোলেনি নয়াদিল্লি।
১৬২০
চলতি বছরের ১৮ অগস্ট দু’দিনের ভারত সফরে আসেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। এ দেশের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানেই দু’তরফে ফের সীমান্তবাণিজ্য শুরু করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় নয়াদিল্লি ও বেজিং। কোন রাস্তায় পণ্য আনা-নেওয়া চলবে, তা-ও ঠিক করা হয়েছে। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই আপত্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে নেপাল।
১৭২০
গত ২০ অগস্ট কাঠমান্ডুর তরফে জারি করা বিবৃতিতে ভারত সরকারকে লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং পূর্ব কালাপানিতে রাস্তা নির্মাণ, সম্প্রসারণ এবং সীমান্তবাণিজ্য না করার আর্জি জানানো হয়েছে। এলাকাটিকে ‘বিতর্কিত’ বলে উল্লেখ করেছে তারা। পাশাপাশি, বিষয়টি চিনকেও জানানো হয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে নেপাল।
১৮২০
কাঠমান্ডুর ‘অযৌক্তিক’ দাবির পর ওই দিনই গভীর রাতে পাল্টা বিবৃতি দেয় বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে গোটা ঘটনাকে ‘অসমর্থনযোগ্য’ এবং ‘অনৈতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেছে নয়াদিল্লি। তবে সীমান্ত বিবাদ মেটাতে আলোচনার রাস্তা খোলা রাখছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। তবে সেখানে গঠনমূলক কথা বলার মনোভাব নিয়ে আসতে হবে নেপালকে, জানিয়ে দিয়েছে সাউথ ব্লক।
১৯২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ, নেপালের এ-হেন মনোভাবের নেপথ্যে বেজিঙের হাতযশ দেখছেন। কারণ, লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে মানস সরোবর পৌঁছোনো অনেক সহজ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই রাস্তা ধরে চিন সীমান্তের দুর্গম এলাকায় দ্রুত চলে যেতে পারবে ভারতীয় সেনা। আর তাই বিষয়টিকে প্রথম থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে আসছে ড্রাগন।
২০২০
এ দেশের দাপুটে কূটনীতিকেরা অবশ্য মনে করেন, মাত্র ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জন্য নেপাল সরকার যে আচরণ করছে তা ‘অনভিপ্রেত’। কাঠমান্ডুর কেপি ওলি সরকারের সঙ্গে বেজিঙের যথেষ্ট দহরম মহরম রয়েছে। অন্য দিকে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে উত্তাল হয়েছে হিমালয়ের কোলের ওই দেশ। আর তাই এ ব্যাপারে কেন্দ্রকে সাবধানে পা ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।