মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করতে ডাকসাইটে সুন্দরী মহিলা এজেন্টদের কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া এবং চিন। আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে ধ্বংস করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এই মর্মে ওয়াশিংটনকে এ বার সতর্ক করলেন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
সোনালি চুল, নীল চোখ আর লাস্যময়ী চেহারা। চলনে-বলনে বুদ্ধির ছাপ। এ-হেন ডাকসাইটে সুন্দরী মহিলা গুপ্তচরদের মাঠে নামিয়েছে রাশিয়া ও চিন। টেক বিশেষজ্ঞদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের সিলিকন ভ্যালিকে ধ্বংস করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে এ বার আমেরিকার প্রশাসনকে সতর্ক করলেন সেখানকার দুঁদে গোয়েন্দারা। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ওয়াশিংটনের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে বড় বিপদের মুখে পড়তে হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
০২২০
চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর রুশ ও চিনা প্রমীলা গুপ্তচরদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’। ওই রিপোর্টেই প্রকাশ্যে আসে তাদের ‘গেম প্ল্যান’। মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে সেখানকার পদস্থ আধিকারিক এবং কর্মীদের নিশানা করছে মস্কো ও বেজিঙের প্রমীলা এজেন্টদের বাহিনী। এর পর রূপের জাদুতে তাঁদের মন জয় করতে পারলেই কেল্লাফতে।
০৩২০
যুক্তরাষ্ট্রের দুঁদে গোয়েন্দারা রুশ ও চিনের মহিলা গুপ্তচরদের এ-হেন অভিযানকে ‘যৌন-যুদ্ধ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের কথায়, মোহময়ী রূপে ভুলিয়ে টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির পদস্থ কর্তা ও কর্মীদের বিয়েও করছেন এই সমস্ত প্রমীলা এজেন্টরা। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর সুখে-শান্তিতে সংসার করতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের। এমনকি কর্তৃব্যপরায়ণ মায়েদের মতো সন্তানকে বড় করছেন তাঁরা। তারই ফাঁকে চলছে স্বামীর থেকে সংগ্রহ করা তথ্য নিজের দেশের গুপ্তচর সংস্থাকে পাচার।
০৪২০
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন আমেরিকার বেসরকারি তদন্তকারী সংস্থা ‘পামির কনসাল্টিং’-এর প্রধান জেমস মুলভেনন। ‘দ্য টাইম্স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি রুশ ও চৈনিক মহিলা গুপ্তচরে ভরে গিয়েছে। সেই বাস্তব চিত্রটা সরকার অস্বীকার করলে বিপদ বাড়বে। টেক জায়ান্ট কর্তা বা কর্মীদের শোয়ার ঘরেও পৌঁছে যাচ্ছে এই সমস্ত এজেন্ট। ফলে তথ্য চুরি আটকানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’’
০৫২০
জেমসের দাবি, যে সব মার্কিন সংস্থায় চিনা লগ্নি রয়েছে, সে সব জায়গায় বেজিঙের গুপ্তচরবৃত্তির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তিনি জানিয়েছেন, অনেক সময় আমেরিকার স্টার্টআপগুলিকেও নিশানা করছে তারা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার চাকরি খোঁজার নাম করে হ্যাকিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছে এই সমস্ত মহিলা এজেন্ট। এর জন্য লিঙ্কডইনে কাজের অনুরোধও পাঠাতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের। এই সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, জানিয়েছেন জেমস।
০৬২০
‘দ্য টাইম্স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ‘পামির কনসাল্টিং’-এর প্রধান গোয়েন্দাকর্তা। প্রায় তিন দশকের ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সি’র অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। অর্থাৎ, বিদেশি গুপ্তচর বা এজেন্টদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে জেমস যে বিশেষ পারদর্শী, তা বলা যেতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘ভার্জিনিয়ার টেক সংস্থাগুলিতে ক্রমাগত লগ্নি বাড়াচ্ছে চিন। এই বিনিয়োগের আড়ালে রয়েছে তথ্য চুরির চক্রান্ত।’’
০৭২০
এক প্রশ্নের উত্তরে মুলভেনন বলেন, ‘‘বিদেশি লগ্নি এলে তার পিছন পিছন সেখান থেকে কর্মীও আসতে পারেন। ভার্জিনিয়ায় সেটাই হয়েছিল। ওখানকার একটা টেক সংস্থায় চাকরির জন্য দুই সুন্দরীকে পাঠায় বেজিং। সন্দেহ হওয়ায় আমরা তাঁদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিইনি। পরে খোঁজখবর করে জানতে পারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির অনেক গোপন তথ্যই রয়েছে তাঁদের কাছে। এই ঘটনা অহরহ ঘটছে, আর সেটাই সবচেয়ে আতঙ্কের।’’
০৮২০
রুশ-চিনের প্রমীলা গুপ্তচরবাহিনীর দাপাদাপির নেপথ্যে মার্কিন আইনের ‘দুর্বলতা’কে দায়ী করেছেন গোয়েন্দা কর্তা জেমস। তিনি বলেন, ‘‘সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন আর গণতন্ত্রের কথা বলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা, ব্যবসা বা চাকরি করতে আসার ক্ষেত্রে কাউকে আটকাচ্ছি না। শত্রুরা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাঁদের নয়া হাতিয়ার যৌন-যোদ্ধা বাহিনী। এঁদের আটকানো বেশ কঠিন।’’
০৯২০
একই কথা রাশিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান চালিয়ে আসছে মস্কো। পূর্ব ইউরোপে ওই যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ক্রেমলিনের উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ সমস্ত পশ্চিমি দেশ। শুধু তা-ই নয়, গত সাড়ে তিন বছরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কিভকে হাতিয়ার সরবরাহ করেছে ওয়াশিংটন। আর তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই মার্কিন মুলুকে গুপ্তচরবৃত্তি বৃদ্ধি করেছে রাশিয়া, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১০২০
‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’-এ সেই ধরনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, সম্প্রতি মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের এক ইঞ্জিনিয়ারকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেন মস্কোর ডাকসাইটে সুন্দরী এজেন্ট। স্ত্রী হিসাবে তাঁকে আদর্শ বলা যেতে পারে। কিন্তু, গত দু’বছরে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ক্রেমলিনকে পাঠিয়েছেন তিনি। ওই এজেন্টকে গ্রেফতার করা গিয়েছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
১১২০
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, সামরিক এবং প্রশাসনিক তথ্য চুরির পাশাপাশি অভিনব ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা এবং গবেষণামূলক বিষয়বস্তুগুলিকেও নিশানা করছেন চিন এবং রুশ প্রমীলা গুপ্তচরেরা। সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে স্টার্টআপ প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে বেজিং। অন্য দিকে, স্টকে লগ্নিকারী থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ এবং ক্রিপ্টো বিশেষজ্ঞদের মধ্যে লাস্যময়ী মহিলা এজেন্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে মস্কো। সেই কারণেই তাঁদের শনাক্ত করতে পারছে না প্রশাসন।
১২২০
যুক্তরাষ্ট্রের উপর এ-হেন গুপ্তচরবৃত্তির একাধিক সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, ভারত-সহ বিশ্বের একাধিক দেশকে তথ্য সরবরাহ করে থাকে মার্কিন টেক জায়ান্ট ‘গুগ্ল’। কিন্তু চিন বা রাশিয়া কেউই এই সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে না। মস্কোর হাতে আছে গুগ্লের সমতুল্য ইয়ানডেক্স। বেজিঙের সার্চ ইঞ্জিনের নাম বাইডু। ফলে আমেরিকার টেক জায়ান্টটির যাবতীয় তথ্য বাইরে গেলে হুমকির মুখে পড়তে পারে নয়াদিল্লি-সহ পশ্চিম এশিয়ার একাধিক রাষ্ট্র।
১৩২০
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় সংস্থার ব্যবসায়িক মডেল চিন বা রাশিয়া হস্তগত করতে আগামী দিনে বাজার থেকে রাজস্ব আদায় করা তাদের পক্ষে বেশ কঠিন হবে। এ ব্যাপারে অবশ্য মস্কোর চেয়ে এগিয়ে আছে বেজিং। আর তাই মার্কিন স্টার্টআপগুলিতে ঢেলে লগ্নি করছে ড্রাগনের বিভিন্ন কোম্পানি। এ-হেন বৌদ্ধিক চুরিতে বছরে ৬০ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত লোকসান হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৪২০
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক জেফ স্টফ আবার বলেছেন, ‘‘আমাদের অনেক স্টার্টআপ সংস্থাই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার তথ্য বাইরে যাওয়ার অর্থ হল হাতিয়ার শিল্পে ঝুঁকি তৈরি হওয়া।’’ আর তাই এ ব্যাপারে মার্কিন যুদ্ধ দফতরকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ফলে আগামী দিনে সিলিকন ভ্যালিতে প্রশাসনিক নজরদারি বৃদ্ধির যে প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৫২০
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, যুক্তরাষ্ট্রের উপর নজরদারি চালাতে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি ইউনিট চালু করেছে চিনা গুপ্তচরবাহিনী। যেখানে স্থানীয় নেতা এবং রাজনীতিবিদদের টানার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এ ছাড়া এই ধরনের ইউনিট রয়েছে সান ফ্রান্সিসকো এবং ওকলাহামাতেও। আমেরিকায় পড়তে আসা চৈনিক পড়ুয়ারাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।
১৬২০
এই পরিস্থিতিতে গত ২৮ মে ভিসা নীতিতে বড় বদল আনে মার্কিন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো জানিয়ে দেন, ড্রাগনভূমির যে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসির সামান্যতম যোগাযোগও রয়েছে, তাঁদের কোনও ভাবেই ভিসা দেওয়া হবে না। পাশাপাশি, চিনা পড়ুয়ারা জটিল প্রযুক্তি গবেষণায় যুক্ত থাকতে পারবেন না বলে ঘোষণা করেন তিনি।
১৭২০
চিনা ছাত্র-ছাত্রীদের উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খড়্গহস্ত হওয়ার নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ রয়েছে। তাঁর প্রশাসনের নিরাপত্তা আধিকারিকদের বড় অংশই মনে করেন, উচ্চশিক্ষার নামে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন ড্রাগনভূমির পড়ুয়ারা। তাঁদের মূল আনুগত্য রয়েছে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসির প্রতি। ভিসা নীতিতে বদল আনার নেপথ্যে একে অন্যতম বড় যুক্তি হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
১৮২০
দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট ঘোষণাটির সময় মান্দারিনভাষী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির একগুচ্ছ অভিযোগ আনে মার্কিন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বিদেশে পড়তে যাওয়া চিনা পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলক ভাবে বেজিঙের বিশেষ একটি আইন মানতে হয়। তাতে বলা হয়েছে, যখনই সংশ্লিষ্ট দেশটির ব্যাপারে সিপিসি কোনও তথ্য জানাতে চাইবে, ওই ছাত্র বা ছাত্রী, তা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবেন। এর ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ প্রশাসন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে স্পষ্ট করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন।
১৯২০
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ইরাক থেকে একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান চুরি করে ইহুদিভূমিতে নিয়ে আসে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। তাঁদের সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ডায়মন্ড’। রুশ নির্মিত বাগদাদের লড়াকু জেটটিকে কব্জা করতে সেখানকার মুনির রেদফা নামের এক পাইলটকে নিশানা করে তারা। এই কাজে তাঁকে রাজি করাতে এক মহিলা এজেন্টকে কাজে লাগিয়েছিল মোসাদ।
২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অবশ্য এখনও পর্যন্ত সেই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। যদিও তার সম্ভাবনা রয়েছে ষোলো আনা। আর তাই ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা নীতি এবং সিলিকন ভ্যালির নিয়মে কড়াকড়ি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব ভারতের উপরেও পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।