Advertisement
E-Paper

কেচ্ছা

সুস্নাত চৌধুরীবিয়ের ছ’বছরের মাথায় হঠাত্‌ যদি কেউ পাড়াপড়শির মুখে শোনেন, তাঁর গোবেচারা প্রিয়তমা স্ত্রীটি নিয়মিত অন্য কারও সঙ্গে ভরপুর শুচ্ছেন-টুচ্ছেন, তা হলে প্রথম যা জন্মানো উচিত, তা হল ঘটনাটির প্রতি অবিশ্বাস। কিন্তু রসের নাগরটি এলাকায় ধম্মকম্ম করা কেউকেটাতমটি হলে এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ফোড়ন পড়শিদের বর্ণনায় পরিমাণ মতো ছেটানো থাকলে, তখনই জাগে প্রচণ্ড রাগ।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০

বিয়ের ছ’বছরের মাথায় হঠাত্‌ যদি কেউ পাড়াপড়শির মুখে শোনেন, তাঁর গোবেচারা প্রিয়তমা স্ত্রীটি নিয়মিত অন্য কারও সঙ্গে ভরপুর শুচ্ছেন-টুচ্ছেন, তা হলে প্রথম যা জন্মানো উচিত, তা হল ঘটনাটির প্রতি অবিশ্বাস। কিন্তু রসের নাগরটি এলাকায় ধম্মকম্ম করা কেউকেটাতমটি হলে এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ফোড়ন পড়শিদের বর্ণনায় পরিমাণ মতো ছেটানো থাকলে, তখনই জাগে প্রচণ্ড রাগ। এর পর যাবতীয় লজিকাল থিংকিং কি নারীবাদ-পুরুষবাদের সমীকরণ বাদ দিয়ে, সেই স্বামী মানুষটি যদি আঁষবঁটির এক কোপে বউয়ের ধড়-মুড়ো আলাদা করে দেন, তা হলে যা জন্ম নেয়, তা হল নিখাদ একটি কেচ্ছা। হ্যঁা, অদ্যাবধি এই বাংলার সবচেয়ে বড় কেচ্ছা।

স্থান: হুগলির তারকেশ্বর। কাল: উনিশ শতক। অর্থাত্‌ একশো চল্লিশ বছরেরও আগের কথা। পাত্র: কুলবধূ এলোকেশী, তাঁর স্বামী ‘ভাল ছেলে’ নবীন, এবং মেন কালপ্রিট তারকেশ্বর মন্দিরের সর্বেসর্বা দ্বাদশ মোহন্ত ‘লম্পটচূড়ামণি’ মাধবচন্দ্র গিরি। কাজের সূত্রে দূরে থাকতেন নবীন। নবীনের অনুপস্থিতিতে এলোকেশীকে বশ করেছিলেন মোহন্ত। বাধ্যত হোক, বা স্ব-ইচ্ছায়, এলোকেশীও মোহন্তের অঙ্কশায়িনী হয়েছিলেন। অকস্মাত্‌ সে সত্য জানতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে যান নবীন। এলোকেশীকে নিয়ে গাঁ ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও মোহন্তের কলকাঠিতে ব্যর্থ হন। অতঃপর ঘরের ধারালো বঁটিটিতেই ভরসা রাখেন! ১৮৭৩-এর ২৭ মে এলোকেশীর মৃত্যুর পর এই স্ক্যান্ডাল নিয়ে তামাম বাংলায় তোলপাড়ের শেষ ছিল না। হুগলি সেশন জজ কোর্টে যখন অভিযুক্ত নবীনের পক্ষে রায় দিচ্ছেন জুরি সদস্যরা, বলছেন, তিনি খুন করেছেন ঠিকই, কিন্তু অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়, নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দোষ শুনে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। আবার পর ক্ষণেই যখন বিচারপতি প্রিন্সেপ সাহেব জুরিদের সঙ্গে সহমত হতে না পেরে মামলা হাইকোর্টে পাঠাচ্ছেন, হতাশায় ভেঙে পড়ছে জনতা। শেষমেশ স্ত্রী-হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হচ্ছে নবীনের। কিন্তু কলকাতার মানুষের কাছে হিরো হয়েই থেকে যাচ্ছেন তিনি। যখন ব্যভিচারের দায়ে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দু’হাজার টাকা জরিমানা হচ্ছে মোহন্তের, বাঙালি দাঁত চিপে বলে উঠছে, বেশ হয়েছে!

মামলা দুটির রায় বেরোবার ঢের আগেই উনিশ শতকের সর্বাধিক চর্চিত টপিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই কেচ্ছা। বটতলায় ছাপা হচ্ছে একের পর এক নাটক-প্রহসন। ‘মোহন্তের যেমন কর্ম তেমনি ফল’, ‘উঃ! মোহন্তের এই কাজ!!’, ‘তারকেশ্বর নাটক’, আরও অনেক। হু হু করে ফুরোচ্ছে একের পর এক এডিশন। কোনও অজানা-অচেনা নাট্যকার লক্ষ্মীনারায়ণ দাসের ‘মোহন্তের এই কি কাজ!!’ মঞ্চস্থ হচ্ছে সাড়ম্বরে। মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ কী ‘কৃষ্ণকুমারী’ করেও মাছি-তাড়ানো বেঙ্গল থিয়েটারের কপাল ফেরাচ্ছে এই নাটক! শোয়ের পর শো হাউসফুল। আর ভেতরে কখনও ঘন ঘন হাততালি, কখনও কান্নার রোল দর্শকাসনে। লোকের মুখে মুখে ফিরছে জনপ্রিয় সব গান আর পাঁচালি ‘মোহন্তরে লয়ে কত নিউশ ছাপিল।/ মোহন্ত লইয়া কত থিয়েটার হলো।।/ মোহন্ত লইয়া কত বৈষ্ণবাদিগণ।/ সঙ্গীত গাইয়া অর্থ করে উপার্জন...।।’ আর আঁকা হচ্ছে অসাধারণ সব ছবি। কালীঘাটের পট। নবীন সেখানে ফুলবাবুটি। মোহন্ত দাড়িগোঁফ ঢাকা মুখে যেন সাধকের বেশে। আর রূপসী এলোকেশী ঢলোঢলো কোনও এক গাঁয়ের বধূ। কোনও ছবিতে এলোকেশীকে সুরাপানে বাধ্য করছে মোহন্ত, কোথাও মোহন্তের জন্য সোহাগ করে পান সেজে দিচ্ছে এলোকেশী, এলোকেশীকে বঁটির আঘাতে হত্যা করছে নবীন, আবার কোনও পটে জেলের ঘানি পিষছে দণ্ডিত মোহন্ত। ঠিক যেন সিনেমার এক-একটা ফ্রেম। আজ বিদেশের মিউজিয়ম থেকে ধার করে এনে এ সব ছবির প্রদর্শনী করতে হয় শহর কলকাতায়। কিন্তু সে দিন বাংলার ঘরে-ঘরেই নবীনের জন্য ছিল বিষাদ-মেশা কুর্নিশ, মোহন্তের জন্য তীব্র ঘৃণার ছিছিক্কার, আর এলোকেশীর জন্য খানিকটা সহানুভূতি।

এ হেন মোহন্ত-এলোকেশীর কিস্সার খুঁটিনাটি নথিবদ্ধ করে গিয়েছেন প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ। এক্সট্রা-ম্যারিটালের আধুনিকতায় পুলকিত আমাদের কাছে হয়তো আজ গালগল্পের মতোই শোনাবে সে সব কথা। আমরা বিস্মিতই হব, যদি শুনি শুধু বটতলার সাহিত্য আর কালীঘাটের ছবি নয়, এলোকেশী ডিজাইনের পানের বাটা বা মোহন্তের ছবি দেওয়া হুঁকোতেও সে দিন ছেয়ে গিয়েছিল আমাদের এই বাংলার বাজার।

susnatoc@gmail.com

rabibasariyo probondho kechchca susnata choudhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy