Advertisement
E-Paper

ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ে শহিদ এক বাঙালি

বছর একুশের তরুণ সোমেন চন্দ। ১৯৪২-এর ঢাকায় রেলওয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক, ছোটগল্প-উপন্যাসের লেখক। রেলশ্রমিকদের নিয়ে মিছিল করে যাওয়ার সময় তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। গত শুক্রবার পেরিয়ে গেল তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। বছর একুশের তরুণ সোমেন চন্দ। ১৯৪২-এর ঢাকায় রেলওয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক, ছোটগল্প-উপন্যাসের লেখক। রেলশ্রমিকদের নিয়ে মিছিল করে যাওয়ার সময় তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। গত শুক্রবার পেরিয়ে গেল তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। শুভাশিস চক্রবর্তী

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
সংগ্রামী: সোমেন চন্দ। ডান দিকে, ১৯৭৬ সালে সোমেন চন্দ স্মৃতিরক্ষা সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপি। স্বাক্ষর করেছিলেন বিশিষ্ট জনেরা

সংগ্রামী: সোমেন চন্দ। ডান দিকে, ১৯৭৬ সালে সোমেন চন্দ স্মৃতিরক্ষা সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপি। স্বাক্ষর করেছিলেন বিশিষ্ট জনেরা

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘিরে ধরা লোকগুলোর মধ্যে এক জন তাঁর পেটে ছুরিটা গেঁথে দিল। মুহূর্তের আক্রমণে হতচকিত, রক্তাক্ত সোমেন চন্দ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এ বারে মাথায় পড়ল লোহার রডের বাড়ি। ভোজালি ফালাফালা করে দিল পেট। রক্তের স্রোতের সঙ্গে বেড়িয়ে এল নাড়িভুঁড়ি। সোমেনের সঙ্গে যে রেল শ্রমিকদের মিছিলটা ছিল, সেটি তখন বিশৃঙ্খল। এরই মধ্যে শাবল দিয়ে দু’চোখ খুবলে নিল তাঁর, জিভটা টেনে বের করে কেটে ফেলল এক দল ফ্যাসিস্ট গুন্ডা।

তারিখটা ৮ মার্চ ১৯৪২। এর কিছু দিন আগে ঢাকায় একটা প্রদর্শনী হয়েছিল। সোভিয়েট রাশিয়ার নতুন সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি বাংলার মানুষকে দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে ‘সোভিয়েট সুহৃদ সমিতি’র ঢাকা শাখা। উদ্বোধন করলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, উদ্বোধনী বক্তৃতা দিলেন গোপাল হালদার। আয়োজনটিকে সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি জসীমুদ্দিন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত সোভিয়েট রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল এই সমিতি। ফ্যাসিবিরোধী সেই ‘সোভিয়েট মেলা’র অন্যতম উদ্যমী কর্মী ছিলেন সোমেন চন্দ। প্রদর্শনী নিয়ে তাঁর সে কী উৎসাহ! দর্শকদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন সব, তাঁদের কৌতূহল মিটিয়ে দিচ্ছেন বিনয়ী যত্নে।

বয়স তখন তাঁর মাত্র একুশ। এত অল্প বয়সেই ঢাকার রেলওয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক হয়েছেন। শ্রমিকদের নয়ণের মণি তিনি। আবার সাম্যবাদী রাজনীতিতে সর্বক্ষণ জড়িয়ে থাকার পরেও লিখে চলেছেন ‘ইঁদুর’, ‘দাঙ্গা’, ‘সংকেত’-এর মতো গল্প, ‘বন্যা’-র মতো উপন্যাস। ঢাকা রেডিয়ো স্টেশন থেকে ‘কথিকা’ পাঠেরও ডাক পেয়েছেন একাধিক বার। সোমেনের ভাই কল্যাণ চন্দ লিখেছেন, ‘তখন সবে ঢাকা রেডিও স্টেশন চালু হয়েছে। দাদা রচনা পাঠের সুযোগ পেলেন।… মনে আছে, একবার আমাদের সমস্ত পরিবার, বুড়ীগঙ্গার তীরে, করোনেশন পার্কে সরকারি রেডিওতে, দাদার ‘মৌমাছি’ নিয়ে কথিকা শুনতে যাই। পুলিশি রিপোর্টের জন্য দাদার রেডিওতে পাঠ বন্ধ হয়ে যায়।’ সোমেন আকারে বেঁটেখাটো, গায়ের রং বেশ ফর্সা, মাথাটা দেহের তুলনায় সামান্য বড়। বলিষ্ঠ গড়ন, স্বপ্নালু চোখ। চোয়ালটা একটু উঁচু, দাড়ি-গোঁফ তখনও ভাল করে ওঠেনি। ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছিলেন, অসুস্থতার কারণে সেই পাঠে ইতি টানতে হয়েছে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটিকে মোটেই পছন্দ না-করা সোমেন এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন, ‘লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে মেহনতি মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য। রাল্‌ফ ফকস-এর বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি।… এই না হলে কি মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায়?’

‘সোভিয়েট মেলা’র অভাবিত সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সমিতি ‘ঢাকা জিলা ফ্যাসিস্ট বিরোধী সম্মেলন’-এর আয়োজন করে। ঢাকার সুত্রাপুর বাজারের কাছে সেবাশ্রমের মাঠে সেই সম্মেলনে কলকাতা থেকে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু। সম্মেলনের দিনেই সোমেনের বড় মাসিমার বড় মেয়ে লিলির বিয়ে ছিল নারায়ণগঞ্জের কাছে ধামগড়ে। সভা ফেলে সোমেন বিয়েবাড়ি যাবেন না, বাড়ির অন্যেরা তাই চলে গেলেন।

সকাল এগারোটা নাগাদ সোমেন গেলেন একরামপুরের কলুটোলায়, প্রিয় বন্ধু অমৃত দত্তের বাড়ি। দলের সহকর্মী অমৃত বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তখন সভার মঞ্চ-তদারকিতে ব্যস্ত। বন্ধুকে না পেয়ে সোমেন ফিরে আসবেন, অমৃতর মা ভাত খাইয়ে দিলেন। অমৃত দত্ত পরে লিখেছেন, “মা ওকে জোর করেই খাইয়ে দেন। এর পর সম্মেলনে রেলওয়ে শ্রমিকদের শোভাযাত্রা নিয়ে আসতে হবে বলে আমার জন্য অপেক্ষা না করে ও রেলওয়ে কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে চলে যায়।”

কলকাতার নেতাদের নিয়ে বড় মিছিলটা সম্মেলনের মাঠে চলে গেলেও সোমেন অল্প কয়েক জন শ্রমিককে নিয়ে ইউনিয়ন অফিসে বসে ছিলেন। সেই সময় আর এক সোমেন— যার পদবী হোড়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকর্মী—সাইকেলে যাচ্ছিলেন। সোমেন চন্দকে একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “মিছিল চলে গেছে, তুমি এখানে বসে কেন? চলো যাই।” জবাবে সোমেন বলেন, “আরও একটু অপেক্ষা করব। সবাই এসে পৌঁছননি।”

বেলা আড়াইটার সময় দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে সোমেন চন্দ রেল শ্রমিকদের আর একটি মিছিল নিয়ে রেলওয়ে কলোনি থেকে রওনা দিলেন। তিনটে নাগাদ মিছিল নারিন্দা পুল পার হয়ে একরামপুর কলতাবাজারে ঢোকার মুখে ডান দিকের রাস্তা ধরল। সেখানকার মোড় পেরিয়ে হৃষীকেশ দাস রোড হয়ে লক্ষ্মীবাজারের কাছে বটগাছের কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্যাসিস্ট সশস্ত্র দুষ্কৃতীর দল। জায়গাটা এখন ৩৪ নং রেবতীমোহন দাস রোড। পেশায় শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস তাঁর বাড়ির জানালা দিয়ে এই হত্যার দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছেন, “আমার বাড়ির জানালা দিয়ে কী বর্বরের মতো তাঁকে হত্যা করা হয় তা আমি নিজের চক্ষে দেখেছি।… সে দৃশ্য ভোলার নয়। এমন মর্মান্তিক হত্যা সহ্যের অতীত। এক ফোঁটা জল তার মৃত্যুর সময় দিতে কেউ এগিয়ে যায়নি।”

ঢাকার উডফোর্ড হাসপাতালে পোস্টমর্টেম হয়েছিল সোমেনের। শবাগারের বারান্দায় রাখা ছিল তাঁর মৃতদেহ। সরলানন্দ সেন লিখেছেন, “সোমেনকে শেষ দেখিয়াছিলাম শব-পরীক্ষাগারে। পুরানো কোঠাটি রক্তে ভরিয়া গিয়াছে; রক্ত আসিয়া জমিয়াছে বাইরের সিঁড়ির উপর।” একুশ বছর নয় মাস পনেরো দিনের অতি সংক্ষিপ্ত জীবনের সোমেন চন্দকে পরের দিন লালবাগ শ্মশানে দাহ করা হয়। জ্যোতি বসুরা ছিলেন শ্মশানে। শবযাত্রীদের মধ্যে কোনও এক জন ছুরির ফলা দিয়ে দেয়ালে খোদাই করে দিয়েছিলেন নিজেদের ক্ষোভকে— ‘সোমেন চন্দ : আমাদের প্রিয় সংগ্রামী লেখক।’

ক্ষোভ আছড়ে পড়ল কলকাতাতেও। ১৯৪২-এর ২৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ইন্দিরা দেবী, আবু সৈয়দ আইয়ুব, প্রমথনাথ বিশী, সুবোধ ঘোষ, সমর সেন, অরুণ মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ লেখকেরা একযোগে বিবৃতি দিলেন: “পূর্ব হইতে চিন্তা করিয়া ও সম্পূর্ণ অকারণেই তাঁহাকে হত্যা করা হইয়াছে এবং সম্ভবত তাঁহার বিপক্ষ দলই এই কার্য করিয়াছে। বাংলার রাজনৈতিক জটিলতা আমাদের নিকট দুর্বোধ্য।… এই রক্তলিপ্সা এবং বিষকলুষ মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে একবাক্যে তীব্র ঘৃণা জ্ঞাপন করিতে আবেদন জানাইতেছি।” ২৮ মার্চ বিকেলে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি হলে ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখকদের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৯ মার্চ লেখা হল: “ঢাকার তরুণ লেখক ও শ্রমিক কর্মী সোমেন চন্দের শোচনীয় মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করিয়া একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।” আর এক অকালপ্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, তখন তাঁর বয়স ষোলো, এই নৃশংস হত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কবিতা লিখে: ‘বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদ্-বৃন্তে/ সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে।/ শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য/ গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য।” অ-কমিউনিস্ট বুদ্ধদেব বসুও তীব্র ক্রোধ উগরে দিলেন তাঁর কবিতায়: ‘ক্ষমা? এরও ক্ষমা আছে? এ উন্মত্ত হননবৃত্তিরে/ নীরবে সহিতে পারে এত বড়ো মানবমহিমা/ জানি না সম্ভব কিনা।’ এত কিছুর পরেও, বিস্ময় জাগায় এই তথ্য: ‘সোমেন চন্দের হত্যাকারী কারা, সেদিন ঢাকা শহরের সকলেরই জানা ছিল। কিন্তু পুলিশ এই হত্যা নিয়ে কোনো কেস ফাইল করেনি বা কাউকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি।’

সোমেন চন্দের মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে, তাঁর সত্তরতম জন্মবর্ষ উপলক্ষে যে গ্রন্থপ্রকাশ হয়েছিল সেখানে অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র ‘ক্ষতবিক্ষত সেই মৃতদেহ’ শিরোনামে লিখলেন: ‘তিনি গল্প লিখতেন বলে খুন হননি, মিছিল নিয়ে আসছিলেন বলেই খুন করা হয়েছিল তাঁকে।… যারা সোমেন চন্দকে হত্যা করেছিল, ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিকই করেছিল। ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করা চলবে না, খেটে-খাওয়া মানুষদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোট বেঁধে আন্দোলন করা চলবে না; যারা এসমস্ত ‘কুকর্মে’ এগিয়ে আসবে, তাঁদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে।’

আগামী ২৪ মে শতবর্ষ ছোঁবেন সোমেন চন্দ। আসন্ন সেই উদ্‌যাপন উৎসব কিছুটা ফিকে হয়ে গেল সোমেনের ছোট ভাই কল্যাণ চন্দের মৃত্যুতে। আগলে রেখেছিলেন দাদার স্মৃতি, সংরক্ষণ করেছেন মূল্যবান নথি। প্রয়াত হলেন মার্চ-শুরুর দিনে।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সোমেন চন্দকে খুন হতে হয়েছিল। অনেকের মতে এই মৃত্যুই ভারতে ফ্যাসিবাদের হাতে প্রথম বলি। সতীশ পাকড়াশি লিখেছেন, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীল বর্বর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল উন্নত গণতন্ত্রবাদের সংগ্রামে তরুণ বিপ্লবী সাহিত্যিক সোমেন চন্দই এদেশে প্রথম জীবন উৎসর্গ করল।’’ নেপাল মজুমদারের একটি প্রবন্ধের শিরোনামই ‘ফ্যাসি বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ সোমেন চন্দ’। সেই হত্যার বয়সও সাতাত্তর হতে চলল। তবু গৌরী লঙ্কেশদের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অশোক মিত্রের কথাগুলো পুরনো হল না এতটুকু।

কৃতজ্ঞতা: সন্দীপ দত্ত, গৌরাঙ্গ দাস, শ্রেষ্ঠা দাস

Somen Chanda Martyr Fascism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy