Advertisement
E-Paper

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

আমার এক বন্ধু প্রথম বলেছিল এই ভয়টা। বলেছিল হাসপাতালের আইসিইউ’তে সারা ক্ষণ নানা রকম যন্ত্রের যে পিঁকপিঁক আওয়াজ— সেটা ও সহ্য করতে পারে না। ওর মাথা ঝিমঝিম করে। ওর মনে হয়, আবার কোনও যন্ত্রণার স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। ওর মনে হয়, ফের হয়তো ভয়ের কিছু ঘটতে চলেছে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

আমার এক বন্ধু প্রথম বলেছিল এই ভয়টা। বলেছিল হাসপাতালের আইসিইউ’তে সারা ক্ষণ নানা রকম যন্ত্রের যে পিঁকপিঁক আওয়াজ— সেটা ও সহ্য করতে পারে না। ওর মাথা ঝিমঝিম করে। ওর মনে হয়, আবার কোনও যন্ত্রণার স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। ওর মনে হয়, ফের হয়তো ভয়ের কিছু ঘটতে চলেছে।

সে দিন আমি— নিজেকে যে বীরাঙ্গনা ভাবতে ভালবাসে— বলেছিলাম, এ সব জীবনের এক একটা সময়। ভুলতে শেখ, যদি না পারিস, ঘুম পাড়িয়ে রাখ। না হলে, তুই তো এগিয়ে যেতে পারবি না। সবার জীবনেই তো এ রকম কিছু না কিছু ঘটে। কেউ কেউ একটু এক্সট্রা দুর্ভাগা হয়, ভয় বা যন্ত্রণার স্থায়িত্ব তাদের জীবনে একটু বেশি। কিংবা হয়তো আমরাই টেনে ধরে রাখি সেটাকে, অন্যেরা নিজেদের মনের জোরে পেরিয়ে যেতে পারে।

এই বক্তৃতার কিছু দিন পরে, আমি ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে। আইসিইউ-এর দরজায়। এখুনি বেড নম্বর ধরে ডাকবে। আমায় এক মিনিটের জন্য দেখতে দেওয়া হবে, হয়তো বা কিছু প্রয়োজন, হয়তো ডাক্তার কথা বলবেন। আমি থরোথরো যাব। আমার সবটুকু শক্তি জুটিয়ে, পাক দিয়ে গুলিয়ে ওঠা পাকস্থলীর বেয়াড়াপনা পরোয়া না করে, ভেতরে গিয়ে অবস্থাটা দেখে আসব। সব আইসিইউ বেডের সঙ্গে লাগানো নানা রকম যন্ত্র থেকে চিৎকার করবে পিঁকপিঁক শব্দ, বিভিন্ন লয়ে, বিভিন্ন তালে, বিভিন্ন মাত্রায়। যারা নিয়ত নির্ধারণ করে চলেছে ধুকপুকের স্টেটাস।

দিনরাত টিউবলাইটের আলোয় চোবানো ভয়ংকর ঠান্ডা ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু কানে বাজতে থাকে অহরহ— পিঁকপিঁক, পিঁকপিঁক। বুকে দামামা পিটতে থাকে। আচ্ছা, অক্সিজেন স্যাচিয়রেশন ঠিক ছিল? কত যেন দেখলাম? হার্ট রেটটা কমে যায়নি? সমানে ইসিজি করে চলেছে? কেন? তার মানে কি খারাপ আছে? আচ্ছা আঙুল থেকে ওই মেশিনটা খুলে যায়নি তো? তা হলে তো মনিটরিং হবে না? তখন ডাক্তার-নার্স জানতে পারবে তো? আরও তো অনেকে রয়েছে ওখানে। সবার শব্দের মধ্যে ওটা হারিয়ে যাবে না তো?

নাকে আমার ফিনাইল আর স্যানিটাইজারের গন্ধ ভেসে আসে। আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা তোমরা পাচ্ছ এই গন্ধটা? তারা অবাক হয়ে বলে, কোন গন্ধ রে? সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, আমার মনের ভুল। কোনও সময় অপেক্ষার চেয়ারে অনন্ত বসে থাকতে থাকতে ঢুলে পড়ি, তক্ষুনি শুরু পিঁকপিঁকপিঁক— চটকা ভেঙে দেখি, আরে, বাইরেই তো আছি, তা হলে আমার কানে কীসের শব্দ বাজছে? তার পর নিজেকেই, ঠিক সেই বিজ্ঞ টোন-এ বোঝাই, এ সব নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিক। এবং আমায় তো এ সব পেরিয়ে যেতে হবে।

আইসিইউ পর্ব শেষ হয়। কিন্তু পিঁকপিঁক শেষ হয় না। রোগীকে ক্যাবিন-এ দেওয়া হয়, আর ক্যাবিনেও সেই মনিটরিং চলে। এই বার শুরু হয়— মনিটরের পিঁকপিঁক বনাম আমার প্যানিক। চোখের সামনে মেশিন। দৃষ্টি যেন সেখানে সেঁটে গেছে। আরে, এখুনি তো হার্টরেট ৭৪ ছিল, তা হলে হট করে ৮৮ হল কেন? এই রে, আবার কমে গেল! স্ক্রিনের দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকি। বিকেলে ক্যাবিনে ঢুকেই দেখি অক্সিজেন দিয়েও স্যাচিয়রেশন ৯৩ পার্সেন্ট! কী হবে! সাদা হয়ে যায় মুখ। ডাক্তার বলেন, এগুলো এই বয়সে নর্মাল।

বাইরে বেরিয়ে আসি। ওই তো এক ফালি রোদ্দুর এখনও আছে। হঠাৎ ক্যাবিন থেকে ধাওয়া-করা পিঁকপিঁক বন্ধ! এ কী হল! দশ পায়ের দূরত্ব ঠেলে যেন পৌঁছতে আমার যুগ লেগে যায়। ওহ্! আঙুলটা সরে গেছে, মেশিনটা বন্ধ। ফের, পিঁকপিঁকপিঁকপিঁক!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy