‘পেঙ্গুইন পেপারব্যাক’ সেই আইনের ফাঁকটাই ব্যবহার করল। ঔপন্যাসিক ডেভিড হার্বার্ট লরেন্সের স্বদেশ ব্রিটেনে তারা পুনঃপ্রকাশ করল তাঁর বিতর্কিত উপন্যাস ‘লেডি চ্যাটার্লি’জ় লাভার’। কারণ, তার ঠিক আগে আমেরিকা আইনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিয়েছে এই বইকে। অতলান্তিক মহাসাগরের ও পারে ‘লেডি চ্যাটার্লি’ আর নিষিদ্ধ নয়।
১৯৩০ সালে মারা যান ডি এইচ লরেন্স। তার দু’বছর আগে তিনি লেখেন এই উপন্যাস। উচ্চবংশীয় স্যর ক্লিফোর্ড চ্যাটার্লি সুদর্শন সুপুরুষ, কিন্তু যুদ্ধে আহত হয়ে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। তাঁর তরুণী, সুন্দরী স্ত্রী কনস্ট্যান্স রিড তথা লেডি চ্যাটার্লির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকও। নিঃসঙ্গ লেডি চ্যাটার্লি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তাঁদের বিরাট এস্টেটের এক কর্মী— উদ্যানরক্ষক ও ‘গেম কিপার’ (তখনকার ব্রিটিশ অভিজাত এস্টেটের হরিণ, ময়ূর ইত্যাদি পশুপাখির দেখাশোনা ও মাঝে-মাঝে শিকার করার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী) অলিভার মেলর্স-এর সঙ্গে। অভিজাত বিবাহিত মহিলার সঙ্গে তথাকথিত নিচু জাতের এক পুরুষের উদ্দাম, বাঁধনছাড়া প্রেমই লরেন্সের উপন্যাসের উপজীব্য। অনেকটা কাটছাঁট করে তা প্রকাশিত হয় প্রথমে ইটালিতে, পরে ফ্রান্সে। তখন লরেন্স যক্ষ্মায় ভুগছেন। যক্ষ্মা তাঁকে দিয়েছিল তিনটে জিনিস— খিটখিটে মেজাজ, পৌরুষহীনতা আর প্রচণ্ড শারীরিক উত্তেজনা। তাঁর স্ত্রী ফ্রিডা তখন এক ইটালিয়ান যুবকের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত, এবং সেই ব্যাপারটা যে ফ্রিডা বিশেষ গোপন রাখতেন সে রকম জনশ্রুতি নেই। যে লরেন্স সারা জীবন শরীরী প্রেমের উপাসক, তাঁর কাছে এই পরিস্থিতি যে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
বিচার শুরু হল। সরকারি উকিল মার্ভিন গ্রিফিথ জোন্স সওয়াল করলেন, “যদি কোনও রকম কড়া ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তা হলে এর পর অন্য কোনও বইয়ের বিরুদ্ধে কোনও রকম শাস্তির পদক্ষেপ করা অসম্ভব হয়ে যাবে। আপনি আপনার ছেলেমেয়েকে এই বই পড়ার অনুমতি দেবেন? মনে রাখবেন, ছেলেদের মতো মেয়েরাও কিন্তু পড়তে জানে, (বেশি দিন আগে নয়, মাত্র ১৯৬০ সালে লন্ডনে এই সওয়াল জবাব চলছে!) আপনার বাড়িতে রাখবেন এই বই? আপনার স্ত্রীকে পড়তে দেবেন? চাকরবাকরদের?”
উকিলবাবু তখনও জানতেন না, জজসাহেব তাঁর স্ত্রীকে বইটা দিয়েছিলেন। তবে এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই যে জজসাহেব খুব উদারচেতা, আধুনিক ভদ্রলোক। আসলে তাঁর সময়ের ভীষণ অভাব। তাই তিনি স্ত্রী লেডি ডরোথি বার্নকে পড়তে দিয়েছিলেন বইটা। ডরোথি বইটা পড়ে বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো দাগ দিয়ে দেন। কোথায় কোথায় প্রছন্ন বা প্রকট যৌনতা আছে, সেগুলো মার্জিনের পাশে নিজের নোটসমেত লাল-নীল কালিতে লিখেও রাখেন। জজসাহেব শুধু সেই বিশেষ নোটগুলো আর দাগ দেওয়া জায়গাগুলোই পড়বেন। পুরো বই পড়ার সময় কোথায় তাঁর?
একপেশে, অসম সেই কোর্টরুম যুদ্ধ। আমাদের সমরেশ বসুকে তার তুলনায় অনেক বেশি ঝক্কি পোয়াতে হয়েছিল। হাংরি জেনারেশনের লেখকদের তো কথাই নেই! ও দিকে ব্রিটেনে লরেন্সের পক্ষে বলতে এলেন ই এম ফর্স্টার, সেসিল ডে লুইস, রেবেকা ওয়েস্ট-এর মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিকরা। যত সংবাদমাধ্যম, সবাই লরেন্সের পক্ষে। ডেলি টেলিগ্রাফ বলল, পর্নোগ্রাফি না আটকে পুলিশ ফালতু সময় নষ্ট করছে লরেন্সকে নিয়ে।
পেঙ্গুইনের উকিল মাইকেল রুবিনস্টাইন অনেক খেটেখুটে কেস’ তৈরি করলেন। পঁয়ত্রিশ জন সাক্ষী জোগাড় হল, কয়েকজনের জায়গা হল রিজার্ভ বেঞ্চে— যদি কেউ না আসতে পারেন! কারা রিজার্ভ? দু’টো নামই যথেষ্ট— টি এস এলিয়ট আর অল্ডাস হাক্সলি। যার রিজার্ভ বেঞ্চই এত শক্তিশালী, তার প্রথম টিম কেমন হতে পারে, সহজেই অনুমেয়। আর অশ্লীলতা বা নীতিবোধ? উলউইচের বিশপ জন রবিনসন সাক্ষ্য দিতে এসে বললেন, “এতে যৌনতা কোথায় ধর্মাবতার? অশ্লীলতা কোথায়? এ তো আধ্যাত্মিক মিলনের গল্প। প্রভুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার বর্ণনা! এই বইটি প্রতিটি ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানের পড়া উচিত!” উল্টো দিকে সরকারি তরফে নামজাদা কাউকে পাওয়াই গেল না। আমেরিকা থেকে উড়িয়ে আনার কথা ছিল এক সাহিত্য সমালোচককে, তাঁর মনে হয়েছিল, লেখাটা অশ্লীল নয়, বরং বড্ড বোরিং, বাজে একটা কমেডি। তিনিও পরে এত দূর উজিয়ে আসতে অস্বীকার করলেন। সরকারি কৌঁসুলিই বইয়ের ‘অশ্লীল’ জায়গাগুলো পড়ে শোনালেন।
২ নভেম্বর জুরিরা রায় দিলেন— মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা আলোচনার পর। ‘লেডি চ্যাটার্লি’জ় লাভার’ মুক্তি পেল। বারো জন জুরি রায় দিলেন লরেন্সের পক্ষে, তাঁর মৃত্যুর ঠিক তিরিশ বছর পর। রায় বেরনোর পনেরো মিনিটের মধ্যেই লন্ডনের চেরিং ক্রসের বিখ্যাত পাঁচতলা বইয়ের দোকান ‘ফয়েলস’ থেকে বিক্রি হয়ে গেল উপন্যাসের তিনশো কপি! তখনও সব কপি ছাপানো হয়নি। গোপনে উপন্যাসের কিছু কপি বড় বড় দোকানগুলোয় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো বইয়ের দোকান ‘হ্যাচার্ড’ থেকে সব বই বিক্রি হয়ে গেল চল্লিশ মিনিটের মধ্যে।