Advertisement
E-Paper

ছিল ঘুঁটে, হল ঋতুবন্ধের অ্যাড

এখানকার বুদ্ধিজীবীরা সব চিটেগুড়ে বসা ভনভনে মাছির মতো, কামদুনি থেকে রানাঘাট অবধি কেউ ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটাও কথা বলেছে?

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৪
গুন্টার গ্রাস, এখন যেমন। সবে মারা গিয়েছেন তো, কোনও পরিবর্তন হয়নি।

গুন্টার গ্রাস, এখন যেমন। সবে মারা গিয়েছেন তো, কোনও পরিবর্তন হয়নি।

প্রতিবেদক: মারা গিয়ে কেমন লাগছে?

গুন্টার গ্রাস: অনেকটা ভাল। নেবুলাইজার লাগাতে হয় না, শ্বাসকষ্ট আর নেই। বেহলড্রফ নামে যে গ্রামটায় থাকতাম, সেটার সব ভাল, কিন্তু নর্থ সি-র কাছাকাছি। ফলে শীতকালে ভীষণ ঠান্ডা লাগত, জবুথবু হয়ে পড়তাম। এখন শীত-গ্রীষ্মের সেই বোধটা আর নেই, এখানে সারা ক্ষণ চমৎকার আবহাওয়া।

প্রতি: ‘এখানে’ মানে? আপনি এখন স্বর্গে না নরকে?

গ্রাস: দুটোর তফাত আছে, তোকে কে বলল? গোলা লোকের মতো ভেবেছিস, স্বর্গ আর নরক আলাদা জায়গা। দুটো আসলে এক জায়গা। তোর মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে, তুই স্বর্গে না নরকে!

প্রতি: উফ, আপনার গুলিয়ে দেওয়া কথাবার্তা এখনও বদলায়নি দেখছি।

গ্রাস: বদলাবে কেন? আমি বরাবর কমিটেড লেখক ছিলাম, এখনও তাই। কমিটেড বলতে আবার কমিউনিস্ট-ফিস্ট ভাবিস না। কমিটেড টু ম্যানকাইন্ড। এখানে আসার পর কয়েক জন ধুয়ো তুলল, ‘এ লোকটা ছেলেবেলায় নাৎসিদের কুখ্যাত ওয়াফ্রেন এস এস বাহিনিতে ছিল, ওকে নরকে পাঠাতে হবে।’ তখন উইলি ব্রান্ট, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো আমার কয়েক জন বন্ধু খুব চিৎকার জুড়ে দিলে। বাচ্চা বয়সে কে কী করেছে, সেটা ধর্তব্য নয়। তা হলে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টও বাচ্চা বয়সে হিটলারের সিমপ্যাথাইজার ছিলেন, ওঁকে আগে নরকে পাঠাতে হবে। আর এই সব পলিটিকাল চেঁচামেচিতে সন্তরা কবে না ভয় পায়? যিশু লাস্টে ভেটো দিলেন, নরক-টরক নয়। গ্রাস তো অনুতাপ থেকেই পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়েছে, ‘পিলিং দ্য ওনিয়ন’ বইয়ে ওর ছেলেবেলার গোপন পাপ স্বীকার করেছে। ব্যস, সকলের মুখ চুন। যিশু ‘অনুতাপের অশ্রুতে সব পাপ ধুয়ে যায়’ বলতে বলতে মিটিং শেষ করে দিলেন। তা, তোকে এখানে গুপ্তচরবৃত্তি করতে কে পাঠাল? সন্ত পল না পিটার?

প্রতি: কেউ না, কলকাতার আনন্দবাজার কাগজ....

গ্রাস: ও, কলকাতা! বার তিনেক গিয়েছি বটে। স্বর্গ-নরক নিয়ে তোর এত আগ্রহ কেন? তোদের শহরটাই তো আস্ত নরক গুলজার!

প্রতি: মৃত্যুর পর সম্প্রতি আপনার পুরনো বই ‘জুঙ্গে জাইগেন’ নিয়ে ফের বিতর্ক শুরু হয়েছে। বইটার ইংরেজি অনুবাদ: শো ইওর টাং। বাংলায় ‘জিভ কাটো লজ্জায়’। আপনি কী বলতে চেয়েছিলেন স্যর? জিভ দেখাতে, জিভ ভ্যাঙাতে, না লজ্জায় জিভ কাটতে?

গ্রাস: রাবিশ! এখনও তোদের শহরের বস্তিগুলোয় ভাঙাচোরা রাস্তা, টাইমকলে জল নেওয়ার সময় উদ্দন্ড ঝগড়া। পলিথিনের শিট টাঙিয়ে ঝুপড়িতে, ফুটপাতে মানুষ সংসার পাতে। বিয়েবাড়ির ভোজসভার শেষে সারমেয় এবং মনুষ্যশাবক একই ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খায়। তোরা সব সময় লজ্জায় জিভ কেটে, কান ধরে দুনিয়ার সামনে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবি।

প্রতি: এখন কিন্তু অবস্থা পাল্টেছে। সবাই উন্নয়নের কথা বলছে, গতকাল কর্পোরেশন ভোটও হয়ে গেল।

গ্রাস: আর উন্নয়ন দেখাস না। জুঙ্গে জাইগেনে কী লিখেছিলাম মনে আছে? মেদিনীপুরে প্রবল বন্যা, কয়েক হাজার মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে রাস্তায় ভিক্ষে করতে নেমেছে, কিন্তু কলকাতার দুর্গাপুজোয় পরিবর্তন নেই। আলোর মালা, সুসজ্জিত নরনারীর ভিড়। সেই ’৮৬ সালেও দেখেছি, তোরা পাশের লোকটার দুর্দশার কথা ভাবতিস না, এখনও না। তোদের উন্নয়ন মানে রাসবিহারী রোডে সেই জল জমবে, প্লাস্টিকের ব্যাগ, ফুল, বেলপাতা, হাওয়াই চপ্পল ভাসবে। মেয়েরা সন্ধ্যার পর মুখে রং মেখে, গায়ে সস্তা শাড়ি জড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে। শুধু লেক মার্কেটটা ‘লেক মল’ হয়ে যাবে। দয়া করে এ বার পুজোয় আলো দিয়ে গুন্টার গ্রাস বানানোর আদিখ্যেতা করিস না। তা হলে আমার আত্মা জিভ কেটে কেটে পাগলা হয়ে যাবে!

প্রতি: জুঙ্গে জাইগেনে কিন্তু রাস্তায় গরু, ঘুঁটের কথাও লিখেছিলেন। সে সব আর নেই...

গ্রাস: আমায় জ্ঞান দিসনি, বাপ! গত পরশু সূক্ষ্ম শরীরে তোদের শহর থেকে ঘুরে এলাম। হ্যাঁ, খাটাল তুলে দিয়েছিস, রাস্তায় গরু এবং ধর্মের ষাঁড় আর হেলেদুলে ঘোরে না। ল্যাম্পপোস্টে, দেওয়ালে কেউ আর ঘুঁটে দেয় না। তার বদলে ঋতুবন্ধ, শীঘ্রপতন আর শিথিল লিঙ্গ নিরাময়ের পোস্টারে শহরটা ভরিয়ে দিয়েছিস।

প্রতি: গঙ্গার ধারে গিয়েছিলেন? ওখানে কিন্তু মিলেনিয়াম পার্ক-টার্ক অনেক কিছু হয়েছে। সূক্ষ্ম নজরে দেেখননি...

গ্রাস: তুই বাংলা কাগজের সাংবাদিক, না? তাই এত মাথামোটা। তোদের মিলেনিয়াম পার্ক, ইলিয়ট পার্কের সৌন্দর্যায়নে বাগমারি খাল বা রাজাবাজারের বস্তির কী যায় আসে? বরং তোর মতো কিছু ভুঁড়িওয়ালা পাতিবুর্জোয়া ওখানে মর্নিং ওয়াক, ইভনিং ওয়াকে যাবে আর বিদ্যাসাগর সেতুতে সূর্যাস্ত দেখে হাউ বিউটিফুল বলে জাবর কাটবে।

প্রতি: আপনি রাইটার্স বিল্ডিংকেও গালমন্দ করেছিলেন...

গ্রাস: ভুলটা কী করেছিলাম? আমি বলেছিলাম, দৃশ্যটা কাফকার গল্পের মতো। সিলিং-ছোঁয়া কাগজের ফাইল, করিডোরে, বারান্দায় জঞ্জাল। ভিতরে কেউ ঘুমোয়, কেউ চা খায় আর গপ্পো করে। ছ’হাজার কর্মচারী, তাদের চাকরি সরকারি নিয়মে সুরক্ষিত। অথচ বাইরে প্রচুর মানুষ অপেক্ষায়। এতে ভুলটা কোথায়?

প্রতি: এখন রাইটার্স নেই। নবান্ন। ফাইলের পাহাড় আর নেই, সব কম্পিউটারাইজ্ড ই-গভর্ন্যান্স...

গ্রাস: তাতে কী হল? লোকজনকে এখন আর হাত কচলে, ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষায় থাকতে হয় না? একটা তফসিলি জাতির সার্টিফিকেট পেতে জুতোর সুখতলা ক্ষইয়ে দিতে হয় না? ইলেকশনের আগে কী করেছিস? আগে যা-ও বা ফুটপাতে হাঁটতে পারতাম, সূক্ষ্ম শরীরে তাও পারলাম না। সারা কলকাতাটাকে হকার্স কর্নার বানিয়ে দিয়েছিস।

প্রতি: গরিব মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করে দিতে বলছেন?

গ্রাস: এসপ্ল্যানেড, শ্যামবাজার, গড়িয়াহাটের ফুটপাতে এখন দশ ঘণ্টার কিয়স্ক লাগাতে কত হাজার সেলামি দিতে হয়, জানিস? জানলে লজ্জায় জিভ কাটতিস, গরিব মানুষের অজুহাত দিতিস না।

প্রতি: এখানকার চিত্রশিল্পী, কবি, নাট্যকার ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু প্রায়ই আপনার কথা বলেন...

গ্রাস: থাম, আমি সে দিনও চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল-এর নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, জর্জ বুশ থেকে কারও পরোয়া করিনি। এখানকার বুদ্ধিজীবীরা সব চিটেগুড়ে বসা ভনভনে মাছির মতো, কামদুনি থেকে রানাঘাট অবধি কেউ ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটাও কথা বলেছে?

প্রতি: মা কালীর সঙ্গে দেখা হল? আপনি তো ওঁর ভক্ত ছিলেন। শহরের জঞ্জালকুড়ানি, ডাবওয়ালিদের মধ্যেও কালীকে দেখেছেন।

গ্রাস: সে এখনও দেখি। ক্যাওড়াতলার শ্মশানকালী, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী, অনেকের সঙ্গেই স্বর্গে দেখা হল। কিন্তু কালীঘাটের দেবী এখন হাই সিকিয়োরিটি ভিভিআইপি জোনে। ফলে চিত্রগুপ্ত দেখা করার পারমিশন দেননি। রক্ষে কর বাবা, মরে গিয়ে এখন আর পান্ডাও ধরতে পারব না, নীল-সাদা কোটও পরতে পারব না।

gunter grass interview gunter grass gautam chakraborty robibasoriyo robibasoriyo feature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy