Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতা তুমি...

ডাকটা আসছে জানলার কাছ থেকে। এখন ভরদুপুর। বড়মামু অফিসে। একটু আগে একসঙ্গে বসে খেয়েছে বড়মামি আর বুধুয়া। ডাল, আলু পোস্ত আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। এখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে বড়মামি। রোজই দুপুরে ঘুমোয়।

সঞ্জয় দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

তার পর থেকে আর আসেনি মুনিয়া। লজ্জা পেয়েছে নিশ্চয়ই। কী যে সব আগডুম বাগডুম বলে মেয়েটা! যখন আসবে, খুব খেপানো যাবে!

‘বুধুয়া! এই বুধুয়া!’

মুনিয়ার গলা না? চাপা গলায় ডাকছে কেন?

‘অ্যাই বুধুয়া!’

ডাকটা আসছে জানলার কাছ থেকে। এখন ভরদুপুর। বড়মামু অফিসে। একটু আগে একসঙ্গে বসে খেয়েছে বড়মামি আর বুধুয়া। ডাল, আলু পোস্ত আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। এখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে বড়মামি। রোজই দুপুরে ঘুমোয়।

জানলার কাছে এসে পরদা ফাঁক করল বুধুয়া। যা ভেবেছিল তা-ই। মুনিয়া।

‘কালা না কি? কখন থেকে ডাকছি!’

‘ওখান থেকে ডাকছিস কেন? ভিতরে আসতে পারিস না?’

‘শ্‌-শ্‌-শ্‌...’ ঠোঁটে আঙুল দিল মুনিয়া। ‘অত জোরে কথা বলিস না! পিউমাসি জেগে যাবে!’

পিউমাসি মানে বড়মামি। বড়মামির ডাকনাম পিউ। মুনিয়া পিউমাসি বলে ডাকে বড়মামিকে।

‘কী হয়েছে?’ গলা নামাল বুধুয়া।

‘আস্তে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আয়। শব্দ করবি না। পিউমাসি যেন না জাগে!’

‘কী হয়েছে বল না!’

‘তোকে দেখাব বলেছিলাম না? আয়!’

‘আসছি দাঁড়া।’

দ্বিরুক্তি না করে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল বুধুয়া। এখানে তার অগাধ প্রশ্রয়। বেরোতে নিষেধ করে না কেউ।

মুনিয়া তত ক্ষণে এগিয়ে গেছে। হাতের ইশারায় আসতে বলল তাকে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দেখাল, আওয়াজ যেন না হয়। নিজের বাড়ির দিকে কিন্তু গেল না মেয়েটা। ওদের বাড়ির পিছনে, যেখানে আগাছার জঙ্গল, সেখানে গিয়ে ঢুকল।

‘এখানে কী রে?’

‘শ্‌-শ্‌-শ্‌...’ আবার মুনিয়ার ঠোঁটে আঙুল!

হাঁটু সমান আগাছার জঙ্গলের মধ্যে একটা বিশাল আমগাছ। তরতর করে সেটাতে উঠে গেল ডানপিটে মেয়েটা। গাছে উঠতে বুধুয়াও খুব ভাল পারে। সেও উঠে গেল মুনিয়ার পিছন পিছন। একটা মোটা ডালের দু’দিকে পা ঝুলিয়ে বসেছে মুনিয়া। ডালটা এত বড়, সেখানে বুধুয়ারও জায়গা হয়ে গেল। মুনিয়ার পিছনেই একই রকম পা ঝুলিয়ে বসে গেল সে।

খাঁ খাঁ দুপুর! পাকা আমের গন্ধে হাওয়া ভারী হয়ে আছে।

ডালটা থেকে মুনিয়াদের বাড়ির পিছন দিকটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওখানটায় মুনিয়াদের শোবার ঘর। বহু বার তো গেছে বুধুয়া মুনিয়াদের বাড়িতে। কিন্তু উপরের দিকে সরু একটা জানলার মতো টানা ঘুলঘুলিটা লক্ষ করেনি কখনও। বুধুয়াদের বাড়িতে ও রকম উপরের দিকে কোনও জানলা নেই। বড়মামুর বাড়িতে আছে? ফিরে গিয়ে দেখতে হবে!

তারা যেখানটায় বসে আছে সেখানে লতাপাতা আর ছায়া-ঘেরা অন্ধকার। কিন্তু সরু জানলাটার উপরে সরাসরি রোদ এসে পড়েছে, তাই ঘরের ভিতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আর ঘরের মধ্যে চোখ পড়তেই থ হয়ে গেছে বুধুয়া। ফুলিমাসি আর সুজনকাকু বলে লোকটা! দুজনের কারও গায়েই কোনও জামাকাপড় নেই, সব খুলে ফেলেছে। বড়রাও এ রকম করে? কামড়াকামড়ি জাপটাজাপটি করে খেলছে দুজনে! কিন্তু খেলতে খেলতে ও রকম কাতরাচ্ছে কেন? এমন আওয়াজ করছে যেন দুজনেরই খুব ব্যথা লাগছে! ও রকম ব্যথা দিচ্ছে কেন দুজন দুজনকে? হাঁ হয়ে গেছে বুধুয়া। তা হলে কি কুস্তি করছে ফুলিমাসি আর সুজনকাকু?

১৪

আরও বেদনা, আরও বেদনা...

কিছুতেই কথাটা এখানকার কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না শঙ্কর। কুকুররা কখন একজোট হয়ে প্রার্থনা করে? যখন তারা যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়! আর কুকুরগুলো যে প্রার্থনা করছিল, এটা তো কাল রাতে স্পষ্ট দেখেছে সে। শুধু কুকুর নয়, আজ ভোরে পাখিরাও একযোগে যুদ্ধ ঘোষণা করছিল। চড়াই, শালিক, আরও কত কত পাখি! সব কি চেনে নাকি শঙ্কর?

কলকাতায় উপকণ্ঠ ছাড়িয়ে এদিকটায় এলে প্রচুর গাছপালা দেখা যায়। তাই এখানে অনেক পাখি। এই জায়গাটায় আসতে হলে শিয়ালদা থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনের ট্রেনে উঠতে হয়। মাঝের একটা স্টেশনে নেমে অনেকটা হাঁটা। সব মনে আছে শঙ্করের। বাবা আর দাদা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল এখানে! কেন যে নিয়ে এল! বাড়িতেই তো বেশ ছিল সে! কিন্তু তাকে নিয়ে কী যেন একটা অসুবিধে হচ্ছিল বাড়ির সকলের! দাদার বিয়ে হবে তো! পাত্রী দেখা হচ্ছে! কিন্তু বিয়ের আগেই তাকে এখানে এনে রেখে গেল বাবা আর দাদা। বলল, ‘কয়েকটা দিনের জন্য এখানে থাক, বিয়ে ঠিক হলে আবার তোকে এসে নিয়ে যাব।’

বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়ার খুব শখ শঙ্করের। ওই দিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরবে, এটাও সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু বিয়ের তারিখ তো এসে গেল! ওই তো পিছনের মাঠে বিরাট ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে দু’দিন ধরে! বাবা কিংবা দাদার তো এর মধ্যে এসে যাওয়ার কথা! দাদাকেও তো যুদ্ধের কথাটা জানানো দরকার! দাদার বিয়ের আগেই যদি যুদ্ধটা শুরু হয়ে যায়? অথবা বিয়ের দিনই যদি...! না, এ কথাটা তার আগে ভাবা উচিত ছিল। এখনই দাদাকে একটা ফোন করা দরকার! দ্রুতপায়ে অফিসঘরের দিকে পা চালাল শঙ্কর।

‘ও শঙ্করদা, হনহন করে চললে কোথায়?’

সুকুমার মল্লিকের গলা! সুকুমারকে সবাই এখানকার কম্পাউন্ডার বলে। ঘোড়ার কম্পাউন্ডার! ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেঁতো হাসি হেসে ঘুরে বেড়ালেই কি কম্পাউন্ডার হওয়া যায়? লোকটাকে কেন যেন খুব সুবিধের লাগে না শঙ্করের। এক দিন তো শঙ্কর ডিসপেনসারির জানলা দিয়ে দেখে ফেলেছিল, সুকুমার এদিক-ওদিক তাকিয়ে চট করে কতকগুলো ওষুধের শিশি আর ইঞ্জেকশন নিজের চামড়ার ব্যাগটায় ভরে ফেলছে। সুকুমার অবশ্য বুঝতে পারেনি যে শঙ্কর ব্যাপারটা দেখেছে। কথাটা কাউকে বলেওনি শঙ্কর। আজকাল তো তার কোনও কথাই কেউ শুনতে চায় না!

কিন্তু এখন তো শিয়রে সংক্রান্তি! যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে! যে কোনও সময় গুলিগোলা শুরু হয়ে যেতে পারে। সুকুমার লোক যেমনই হোক, ওকে ঘটনার গুরুত্বটা বোঝানো দরকার!

‘সুকুমার, তুমি জানো কুকুররা কখন যুদ্ধ ঘোষণা করে?’

‘কুকুররা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে না কি?’

‘আলবাত করেছে! আমি নিজের চোখে দেখেছি!’

‘দেখেছ? কবে?’

‘গত কাল রাতে।’

‘অ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ। শুধু কুকুররা না, আজ ভোরে পাখিরাও যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’

‘পাখিরাও?’

‘হ্যাঁ, পাখিরাও! কেন, তুমি জানো না, বিপদ এগিয়ে এলে পশুপাখিরা মানুষের আগে টের পায়?’

‘তা পায় বটে! কিন্তু সে তো বনে-জঙ্গলে শঙ্করদা, শহরে...’

‘কেন, বনে-জঙ্গলে টের পেলে শহরে পাবে না কেন?’

‘তা অবিশ্যি! কিন্তু কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল বলো তো?’

‘যারা আমাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তাদের বিরুদ্ধে।’

‘আমাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা? আমাদের এই ‘মনের জগৎ মনস্তাত্ত্বিক কেন্দ্র’ আক্রমণ করবে? কারা?’

‘যারা অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করছে, তারা।’

‘অস্ত্র? কী অস্ত্র?’

সুকুমারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

‘বন্দুক!’

‘বন্দুক? কে বন্দুক জড়ো করছে?’

‘সেটাই তো ধরতে পারলাম না! কাল রাতে এসেছিল। তিন জন লোক। হাতে একটা বন্দুক। পুকুরের ওই পাড়ে, গ্রিন হাউস আর সবজিবাগান ছাড়িয়ে, পিছনে জঙ্গলের দিকটায় গেল। আমি ফলো করছিলাম। কিন্তু তার পরেই সাড়ে আটটায় খাওয়ার ঘণ্টা বেজে গেল! তাই ফিরে আসতে হল।’

এক নিশ্বাসে কথাটা বলে থামল শঙ্কর।

‘তার পর খাওয়া, রোল কল সব হয়ে যাওয়ার পর যেই একটু হাঁটব বলে বেরিয়েছি, দেখি কুকুররা যুদ্ধ ঘোষণা করছে। আজ ভোরে পাখিরাও।’

‘শোনো শঙ্করদা, এখন ক’টা বাজে খেয়াল করেছ? আর একটু পরেই কিন্তু দুপুরের খাওয়ার ঘণ্টা পড়বে। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও এই বেলা। দুপুরে নাহয় আমি এক বার নিতাই আর হরদেওকে নিয়ে খুঁজে দেখব পিছনের জমিটা। দেখি বন্দুকগুলো পাই কি না।’

‘যাক। তাও তুমি কথাটা উড়িয়ে দিলে না। তবে শুধু বন্দুক পেলে হবে না। লোকগুলোকেও ধরতে হবে। ওরা শত্রুপক্ষ!’

‘সে তো নিশ্চয়ই। এক বার বন্দুক বার করতে পারলে লোকগুলোকে ছাড়ব না কি?’

‘গুড। এই তো চাই। তোমায় দিয়ে হবে। ভাগ্যিস তুমি আমার কথাটা উড়িয়ে দিলে না! তাই এ যাত্রা এরা বেঁচে গেল! না হলে শেষরক্ষা হত?’

‘না না, সব ক্রেডিট তো তোমার। তুমিই তো কুকুরদের যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারটা লক্ষ করেছ। যাও এখন, তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নাও।’

কথাটা বলে শঙ্কর হালদারের অপস্রিয়মাণ শরীরটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সুকুমার। ভুরু কুঁচকোনো। পাগলটা কি দেখে ফেলল ব্যাপারটা? কুকুরগুলো কাল রাতে খুব ঘেউঘেউ করছিল বটে।

আসলামভাই অতগুলো টাকার লোভ না দেখালে সে রাজি হত না। আজকের সম্পর্ক তো নয় আসলামভাইয়ের সঙ্গে! মুর্শিদাবাদে আসলামভাইদের বাড়ি ছিল সুকুমারদের দুটো বাড়ির পরেই। সে সব দিন কী ছিল! প্রায়ই বাবার কাজ থাকত না। সুকুমার রাতে খেতে বসে দেখত, সামান্য একটু ভাত পড়ে আছে। মায়ের চোখের সেই বিষণ্ণ চাহনি আজও ভোলেনি সুকুমার।

‘আর যে নেই বাবা, ভাত!’

‘তুমি খেয়েছ, মা?’

‘আমার জন্য তোকে ভাবতে হবে না। তুই খা!’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলত মা।

সেই সব দিনে আসলামভাইয়ের আম্মি অনেক করেছেন সুকুমারের জন্য। কত দিন ডেকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিয়েছেন দুপুরবেলা। আসলামের ছোট ভাই আফসার ছিল সুকুমারের বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ত তারা। আফসাররাও গরিব, কিন্তু আফসারের বাবা ইলেকট্রিকের কাজ জানতেন বলে সরকারি বিদ্যুৎ দফতরের একটা ছোটখাটো চাকরি পেয়েছিলেন কী ভাবে যেন। সুকুমারের বাবা ছিল কাঠের মিস্ত্রি। মুর্শিদাবাদের মতো জায়গায়, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে, কাঠের কাজ করে সারা বছর সংসার চালানো যেত না। তার উপর আবার সুকুমাররা চার ভাই, তিন বোন!

এখানে চলে আসার পর, আসলামভাই-ই কোথা থেকে খবর পেয়ে তাকে খুঁজে বার করে। ওষুধপত্র হাপিস করে যে ভালমত উপরি আয় করা যায়, সেই ধান্দার হদিশ সে-ই প্রথম দেয় তাকে। ‘কোঠি’-তেও তাকে নিয়ে গেছে আসলামভাই। চামেলি বলে একটা মেয়েকে ফিট করে দিয়েছে।

সে দিন চামেলির কাছেই গিয়েছিল সুকুমার। আসলামভাই এসে ধরে পড়ল। একটা অস্ত্র নাকি ওদের ওখানে রাখা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ওর বিশেষ পরিচিত এক জনের মাল, ক’দিন তাদের ক্যাম্পাসের একটা কোনায় লুকিয়ে রাখতেই হবে। আর সে জন্য সুকুমার পাবে তিন হাজার টাকা! রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। শৈশবের দারিদ্রটা আজও ভয় দেখায় সুকুমারকে। টাকা দরকার তার, অনেক টাকা। যে করেই হোক। টাকার আবার সাদা-কালো আছে না কি?

ক্যাম্পাসের ও দিকটায় কেউ যায় না। জঙ্গল হয়ে আছে। কোনও একটা গাছের তলায় একটা ছোট বস্তা কয়েক দিন পুঁতে রাখলে কে টের পাবে? আসলামভাই কথা দিয়েছিল, স্বাধীনতা দিবসের হ্যাপাটা মিটে গেলেই ও এসে আবার জিনিসটা সরিয়ে নিয়ে যাবে। সুকুমার পইপই করে বলে দিয়েছে, রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আসতে। এমন ভাবে কাজ সারতে যেন কেউ দেখতে না পায়।

ক্রমশ

Novel Mystery Novel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy