Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ছোটগল্প
Short story

শোভন সান্যালের সঙ্কট

কোন ধর্মের ধ্বজায় দেশটা ঢাকা পড়তে চলেছে, কারা ধর্মকে বর্ম করে মানুষের সর্বনাশ করার চক্রান্ত করে চলেছে, এ সব আলোচনা যখন যেখানে উচ্চগ্রামে ওঠে, শোভন সেখান থেকে ফুড়ুত হয়ে যান।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

নন্দিনী নাগ
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:০৩
Share: Save:

শোভন সান্যাল পড়েছেন মহা ফাঁপরে, যাকে বলে একেবারে ধর্মসঙ্কট। যদিও ধর্মের সঙ্গে কোনও কালেই সন্ধি নেই তাঁর। সে কারণে ছোটবেলা থেকে বাপের গোমড়া মুখ দেখে আর মা-ঠাকুমার মুখনাড়া খেয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তবে শোভনের এখনকার সঙ্কটটা অবশ্য তাঁর ধর্মাচরণের ধারকাছ দিয়েও যায় না। মাঝবয়সে পৌঁছে নিটোল গোলগাল শোভন তাঁর নিজের চেহারার মতোই জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সকালে বৌয়ের ডাক কানে না পৌঁছনো পর্যন্ত তিনি বিছানা ছাড়েন না, মানে ঘুম ভেঙে গেলেও নিজে থেকে কষ্ট করে চোখ খোলেন না। এ ব্যাপারে অবশ্য তাঁর একটা নিজস্ব তত্ত্ব আছে, পরিচিত বৃত্তে তিনি সুযোগ পেলেই বলে থাকেন, “প্রভু বলিয়াছেন শুইয়া থাকিবার সুযোগ পাইলে কখনও বসিবে না এবং বসিবার সুযোগ পাইলে কখনও দাঁড়াইয়া থাকিবে না।” বন্ধু এবং শত্রুরা যদিও বলে থাকে, এই বাণীটা আসলে শোভনের নিজেরই মুখনিঃসৃত, তবে তিনি এটা আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে স্বীকার করেননি।

যাই হোক, বৌ মুখঝামটা সহযোগে বাজারের থলে আর টাকা যে দিন হাতে ধরায় সেই দিনগুলোতে বেজার মুখে বাজারমুখো হতে হয় তাঁকে। পথে কোনও আড্ডা, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আলোচনার জটলা তাঁর যাত্রাপথে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। বৌয়ের দেওয়া টাকার মধ্যে কী ভাবে বাজারকার্য সুচারু ভাবে সম্পন্ন করা যায়, সে দিকেই মন থাকে তাঁর। নিজের সঙ্কল্পে অটল থেকে টলতে টলতে বাজারের বোঝা টেনে ফিরলেও অবশ্য বৌয়ের মন পাওয়া যায় না কোনও দিনই, কারণ ব্যাগবোঝাই পুঁইশাক কিনে কুমড়ো কেনার কথা মনে পড়ে না যে অপদার্থ স্বামীর, সে আসামি ছাড়া আর কী! তবে বৌয়ের বিষোদ্গারে সবিশেষ হেলদোল হয় না শোভনের। তিনি বুঝে গেছেন, স্ত্রীজাতির কাজই হল স্বামীদের আপাদমস্তক ইস্তিরি করে নেতিয়ে রাখা, যাতে মাড়ের কড়মড়ানি একটুও না থাকে।

অফিসেও গোলযোগের ধারপাশ মাড়ান না শোভন। যেখানেই দেখেন পাঁচ-ছয় মাথা গোল হয়ে বসেছে, সেখানে কখনও যোগ দেন না তিনি। কোন ধর্মের ধ্বজায় দেশটা ঢাকা পড়তে চলেছে, কারা ধর্মকে বর্ম করে মানুষের সর্বনাশ করার চক্রান্ত করে চলেছে, এ সব আলোচনা যখন যেখানে উচ্চগ্রামে ওঠে, শোভন সেখান থেকে ফুড়ুত হয়ে যান।

এমন নয় যে, তিনি বসের সুনজরে থাকার জন্য এমন করেন। কারও ‘প্রিয় পাত্র’ হওয়ার কোনও বাসনা তাঁর মনে গুপ্ত বা সুপ্ত কোনও অবস্থাতেই নেই। জীবনে এক বারই মাত্র ‘পাত্র’ হিসেবে তিনি প্রিয় হতে পেরেছিলেন, তবে সে সব এখন অতীত। বর্তমানের সবটা জুড়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস, অপাত্রের গলায় ঝুলে পড়ার জন্য বৌয়ের হাহাকার।

দাম্পত্য জীবনের সহজপাঠ অবশ্য ভাল ভাবে রপ্ত করে ফেলেছেন শোভন, তাই বৌয়ের হায় হায় শুনেও কখনও তার প্রাণ যায় যায় হয় না। কারণ কান খোলা রেখেও মন বন্ধ রাখার কৌশল তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। বৌয়ের হম্বিতম্বির সামনে গম্ভীরমুখে বসে তিনি শব্দছক করতে পারেন কিংবা হাবার মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থেকে বৌয়ের হাহাকার শুনেও দিব্যি হাসিখুশি থাকতে পারেন। এতে শ্রীমতীর গরম তেলের কড়াইয়ে কত ফোঁটা জলের ছিটে পড়ল, তা তিনি ফিরেও দেখেন না। আর তাতেই সাংসারিক উত্তাপ আরও বাড়ে।

অবশ্য সবটাই যে শ্রীমতী সান্যালের দোষ, তা নয়। পাঁচ বছর আগে তিনি মোটেও দজ্জাল ছিলেন না, বরং বেলতলায় যাওয়ার আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন নরমসরম মিষ্টভাষী প্রেমিকা। গত পাঁচ বছর ধরে শোভন সান্যালের ঘর করে তিনি নিজের পাতলা কাঠামোতে যতটুকু মেদমাংস ধরিয়েছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি শান দিয়েছেন নিজের কণ্ঠস্বরে।

অবশ্য আদতে তিনি ‘শোভনের ঘর’ করেছেন কি-না সেটাও বিশ্লেষণ করে দেখার বিষয়।

রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরে গলায় রজনীগন্ধার মালা দুলিয়ে, নতুন বৌকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে নিজের বাড়ির দরজায় পা রাখামাত্র শোভনের মুখের ওপর ওই দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। সে বারে সমস্যা ছিল জাত নিয়ে। বামুনের ঘরে বেজাতের মেয়ে ঢুকতে পারবে না, এই ফরমান আগেই দিয়ে রেখেছিলেন শোভনের মা-বাবা। তা সত্ত্বেও শোভন দুঃসাহসিক হয়ে উঠেছিলেন আর সদ্য বিয়ে করে আনা বৌয়ের সামনে ওঁর সাহসের ফানুস ফুটো হয়ে গেছিল। সঙ সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে অগত্যা শ্বশুরবাবার শরণাপন্ন হতে হয়েছিল শোভনকে, সেই থেকেই ঘরজামাই।

সে দিন প্রস্তাবটা এসেছিল শ্রীমতীর তরফ থেকেই, “আপাতত বাবার কাছেই গিয়ে উঠি চলো, তার পর পছন্দমতো একটা জায়গা খুঁজে চলে যাব’খন।”

শ্বশুর-শাশুড়িও জামাইকে বিমুখ করেননি, খোলা মনে বলেছিলেন, “থাকো না যত দিন খুশি, আমাদের কোনও অসুবিধে নেই।”

এর পর পাঁচ বছর কেটে গেলেও সুবিধেজনক বাড়ির সন্ধান পাননি শোভন, তাই এখনও তিনি ওই ঘরজামাইতেই আটকে আছেন, হতে পারেননি ‘বর’ কিংবা আর এক ধাপ এগিয়ে ‘বাবা’। বাবা হতে অবশ্য বায়োলজিক্যাল কোনও বাধা নেই শোভনের, কিন্তু গিন্নির মুখে একটাই স্লোগান, “ফ্ল্যাট কেনো ফাদার বনো— বাচ্চা বড় হয়ে দেখবে বাপ ঘরজামাই, পথেঘাটে স্কুলে সবাই হ্যাটা করবে ওকে, এ আমি কিছুতেই হতে দেব না।”

গিন্নির এই অকাট্য যুক্তিকে ভেদ করার চেষ্টা করে ছিলেন শোভন, পরিবেশের দোহাই দিয়ে, “প্রতি দু’জন মানুষ যদি আলাদা বাড়িতে থাকে তবে কত বাড়ি বানাতে হয় ভেবে দেখেছ? এর জন্যই জলাজমি ভরাট করে ফ্ল্যাট উঠছে, চাষের জমি চলে যাচ্ছে। চাষ না থেকে, শুধু বাস থাকলে মানুষ বাঁচবে? খাবে কী?”

শ্রীমতীর চোখে যদি দুর্বাসার তেজ থাকত, তা হলে একটা মানুষ পোড়ানোর মতো বিদ্যুৎ খরচ সে দিনই বেঁচে যেত, সেই সঙ্গে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে লাইন লাগিয়ে চুল্লিতে তোলার ল্যাটাও চুকত।

আপাতত গিন্নির তেজে ভস্মীভূত না হয়েও দিব্যি টিকে আছেন শোভন। ল্যাদখোরের (বৌয়ের ভাষ্যে, লাথখোরের) জীবন কাটাচ্ছেন আর খোয়াব দেখে চলেছেন খুব শিগগিরই তার গার্জেন কল হবে, মানে নিজের বাড়ির গার্জেনরা কল করে বলবে, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরো।’ অমনি ‘ঘরজামাই’ মোড়কখানা গা থেকে খসিয়ে সস্ত্রীক সদর্পে পিতৃগৃহে পদার্পণ করবেন তিনি।

শোভনের এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা শুনে গিন্নি বাক্যহারা হয়ে গেছিলেন। অতিকষ্টে ভাষার ঝুলি হাতড়ে মুখ দিয়ে একটাই শব্দ বার করতে পেরেছিলেন তিনি, “অপদার্থ!”

“ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান বইয়ে পড়োনি বুঝি, পদার্থ কাকে বলে? বিজ্ঞানে আমি তুমি সবাই অপদার্থ!”

গিন্নির রাগের আগুনে এক বালতি ঘি পড়েছিল শোভনেরএই কথায়।

তাই বলে শোভন সান্যালের মানসম্মান নেই এ কথা ভাবা অন্যায়, লজ্জা-ঘেন্নাও যে তিনি বাজারে বিক্রি করে দিয়ে রোজকার সংসার খরচা চালান এমনটাও নয়। আসলে, আশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে গোপনে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন তাঁর শ্বশুরমশাই। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় জামাইকে নিয়ে দাবা খেলতে বসেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গত করে সামান্য স্কচ। তাঁর বিশ্বাস স্কচ সহযোগে দাবা হল মাথার টনিক। মাথাকে সাফসুতরো করে দেয়। সেই সাফ মগজে তিনি জামাইকে মন্ত্রণা দিয়েছেন, “মেয়েমানুষের বুদ্ধি কাগজে, মগজে নয়। আগে ওরা বটতলার বই পড়ে বুলি কপচাত, এখন সব হয়েছে সিরিয়াল কিলার! সারা সন্ধে বসে বসে সিরিয়াল গিলবে, রাতে সেগুলো থেকে বাতেলাবাজি চুরি করে হাজ়ব্যান্ডদের মরাল কিল করবে! এই বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যাবে না তুমি, এই আমার শেষ কথা!”

এক্স-ব্যারিস্টার শ্বশুরের আদেশ শিরোধার্য করে শ্বশুরবাড়িতেই শিকড় নামিয়ে দিয়েছেন শোভন, এখন তাকে নড়ায় এমন ক্ষমতা শ্বশুরের মেয়ে আর কোথায় পাবে!

*****

পল্টন, মিনির ছোটবেলাকার পাড়াতুতো বন্ধু। লুকোচুরি, কুমিরডাঙা খেলার দিনগুলো পেরিয়ে যাওয়ার পর পল্টনের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হলেও তেমন কথাবার্তা হয়নি মিনির, হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না।

সে দিন দুপুরের দিকে দর্জির দোকানে গেছিল মিনি। ইদানীং গায়েগতরে লেগে যাওয়ায় নতুন জামাগুলোও পরতে পারছে না, তাই সেগুলোকে বাড়াতে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল, পল্টন পেছন থেকে ডাকল।

“কী রে! মিনি থেকে না হয় ম্যাক্সি হয়েছিস, তা বলে পাত্তা দিবি না?”

“হলে হয়েছি! তোর তাতে কী? একদম নজর দিবি না বলে দিলাম!”

“নজর আর দিলাম কোথায়! এমনিতেই কখনও সুনজরে দেখলি না, এখন কুনজর দিলে তো আর কথাই বলবি না! চললি কোথায়?”

“মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত জানিস না। বাড়ি ছাড়া আর কোথায় যাব!” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মিনি।

“শুধু মসজিদ কেন? মাঝেসাঝে মন্দিরেও তো যেতে পারিস! যাবি?”

“মানে?”

“পুরী যাবি? সামনের রোববার বাস ছাড়ছি, সিট খালি আছে, যাবি?”

“তুই বাস ছাড়ছিস?”

“আমি তো এই ব্যবসাই করি, পার্টনারশিপে। রোজগারের সঙ্গে বেড়ানোও হয়।”

আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে মিনির।

“বাড়িতে বলে দেখি। আমি তো যাওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া, কিন্তু শুধু আমার ইচ্ছেয় তো আর কাজ হবে না!”

“সন্ধেবেলা তোর বর বাড়ি থাকবে তো? আমি গিয়ে কথা বলে রাজি করাব, তুই চাপ নিস না।”

পল্টনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পুরী বেড়াতে গেল মিনির পুরো পরিবারই। পল্টন কথা বেচে খাওয়া ছেলে, মিনির বরের সঙ্গে ওর বাবা-মাকেও পটিয়ে ফেলতে ওর কোনও অসুবিধেই হল না।

পুরী ঘুরে আসার পর ঘন ঘন পল্টন আসতে লাগল মিনিদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য, মিনির মা-বাবার মগজধোলাই করে ওঁদের পরের ট্রিপে যেতে রাজি করানো। ‘কাকাবাবু’, ‘কাকিমা’ বলে হাঁক পেড়ে যখন পল্টন এসে তার গল্পের ঝুলি খুলে বসত, মিনিও মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে হাজির থাকত সেখানে। মিনির মুগ্ধতা আড়চোখে লক্ষ করে পল্টনের উৎসাহ যেত বেড়ে, যে সব জায়গায় কস্মিনকালেও সে যায়নি, সেখানকার গল্পও এমন ভাবে করত যে বোঝাই যেত না ওটা আসলে গল্প নয়, গুলবাজি।

পল্টন পটাতে এসেছিল মিনির বাবা-মাকে, যাতে টুরের কিছু যাত্রী হাতে নিশ্চিত বাঁধা থাকে, কিন্তু সেখানে কার্যসিদ্ধি হওয়ার আগেই ওর তির সামান্য পথচ্যূত হয়ে গোঁত্তা মারল অন্য লক্ষ্যে, মিনির সঙ্গে পল্টনের লটরপটর হয়ে গেল।

পল্টন বিয়ে করেনি, অন্য কাউকে কথাও দেয়নি, কাজেই ও হোঁচট খেতেই পারে। কিন্তু গোলমালটা হল মিনিকে নিয়ে। অন্যের বৌকে বিয়ে করা যে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, এ কথা কে না জানে! মিনি কিন্তু এ সবে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়, ও-ই পল্টনকে বুদ্ধি জোগাল, “আগে বাড়ির লোকজনকে সম্পর্কের কথা জানিয়ে তাদের মত আদায় করো রে, তার পর কোর্টকাছারি করে পুরনো বিয়ে ভাঙো রে, তার পর রেজিস্ট্রারের কাছে আগাম নোটিস লটকে নতুন বিয়ে করো রে— এ সব সরকারি উন্নয়নের পরিকল্পনা পকেটে রাখ! তার চেয়ে বরং চল, আমরা পালিয়ে যাই, তাতেই পাবলিক সব জেনে যাবে। আমাকে আর মিটিং ডেকে লোক জড়ো করে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করতে হবে না, ‘সবাই শোনো! পুরনো বরে আমার আর পোষাচ্ছে না, তাই তাকে ডিভোর্স করে নতুন একটা বিয়ে করতে চাই।’”

মিনির কথা মেনে নিল পল্টন। ‘যা হবে পরে দেখা যাবে’ গোছের একটা বেপরোয়া ভাব ওর মধ্যে বরাবরই আছে। পাপের সাজা কাটানো আর পুণ্যফল ভোগ করার ক্ষেত্রে যদি ওর অগ্রাধিকারের কথা যমরাজ জানতে চায়, তবে আগে ও পুণ্যফলটাই বেছে নেবে, পেটে খেয়ে পিঠে সওয়ানোর পক্ষপাতী ও। বলা তো যায় না, যদি কোনও কারণে যমের রাজ্যপাট লাটে ওঠে, তা হলে শুধুমুধু সাজাটাই পেতে হবে, সুখের মুখ আর দেখা হবে না।

সুদিন দেখে পল্টনের সঙ্গে পালাল মিনি। তার বর শোভন অফিস থেকে ফিরে এসে জানতে পারল গিন্নি গায়েব। অবশ্য মিনি যদি একটা চিরকুট লিখে রেখে না যেত, আর সেই চিরকুটের সূত্রে ওদের বাড়িময় তোলপাড় না চলত, তবে এটুকু বুঝতেও তার রাত কাবার হয়ে যেত।

সেই থেকেই গভীর সঙ্কটে পড়েছেন শোভন। থানা-পুলিশ করে হারামিদের হাজতবাস করানো কিংবা উকিল-মোক্তার ধরে ডিভোর্স কেস লড়ানোটা এখন তাঁর চিন্তার বিষয় নয়, তার সঙ্কটের শিকড় আরও গভীরে। উথালপাথাল করে ভেবে ভেবেও কোনও তল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। সমস্যাটা এমনই প্যাঁচালো যে, কোনও শাস্ত্রেই এর জন্য কোনও বিধান দেওয়া নেই।

জামাই জাতির সৃষ্টিই হয়েছে মেয়ের সূত্র ধরে। তা এখন বাড়ির মেয়েই যেখানে অন্যের হাত ধরে ভেগে গেছে, অন্য এক জনকে পতি বানাতে ব্রতী হয়েছে, তখন শোভন কী সুবাদে ‘জামাই’ থাকবে? আর ‘জামাই’-ই যদি না হয়, তখন ‘ঘরজামাই’ থাকাটা কী ভাবে সম্ভব? এখানকার বাস এখুনি তার গুটিয়ে ফেলা উচিত কি না এই ভাবনার গোলকধাঁধায় কেবলই ঘুরে মরছে শোভন, খবরটা পাওয়া ইস্তক। বৌ পালানোর জন্য শোক করার সময়টুকুও পায়নি। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে কূলকিনারা না পেয়ে এখন সে ভাবতে বসেছে, এক্স-ব্যারিস্টার শ্বশুরের সঙ্গে বিশদে পরামর্শ করে আসাটা উচিত হবে কি না। যদিও হিসেবমতো ভদ্রলোক এখন আর শোভনের শ্বশুর নন, এক্স শ্বশুর। তিনি সন্ধের দাবা এবং স্কচের সঙ্গতে অবশ্য বলছেন, “ছাড়ো তো! যে গেছে, তাকে যেতে দাও। তুমি খেলো। যত ক্ষণ না আইনি বিচ্ছেদ হচ্ছে, বুঝলে না বাবাজীবন... ব্যারিস্টারের সঙ্গে ইয়ার্কি করতে পারবে না বাওয়া, সে মেয়েই হোক আর যে-ই হোক... তুমি চাল দাও বাবা...”

সন্ধের ঝোঁক উতরে গেলে দিনের বেলা এক্স-ব্যারিস্টার আবার কী বলবেন, সেই দুশ্চিন্তা নিয়েই একটা বোড়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করে শোভন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short story Bengali Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE