Advertisement
E-Paper

কালীপুজোয় লালজি আর হাতির সঙ্গে

হাতি ধরায় আজও কিংবদন্তি তিনি— গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া। কালীপুজোর অন্ধকার রাতে সেখানে টর্চের আলোয় ভাম শিকারে উৎসাহী এক বালকের প্রয়াস। হাতি ধরায় আজও কিংবদন্তি তিনি— গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া। কালীপুজোর অন্ধকার রাতে সেখানে টর্চের আলোয় ভাম শিকারে উৎসাহী এক বালকের প্রয়াস

দীপকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০৪
স্মৃতি: মূর্তি ক্যাম্পে লালজি, পার্বতী বড়ুয়া এবং হাতি ‘তিরথসিং’। ছবি: ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী

স্মৃতি: মূর্তি ক্যাম্পে লালজি, পার্বতী বড়ুয়া এবং হাতি ‘তিরথসিং’। ছবি: ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী

লালজি-কে আমার বাবা, হস্তিবিশারদ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী হস্তিবিদ্যার গুরু বলে মানতেন। লালজিও বাবাকে সস্নেহে ‘ভায়া’ সম্বোধন করতেন। ছোটখাটো একটা মানুষ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরতেন, চোখে স্নেহ, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধির ঝিলিক। মোটা সাদা-কালো গোঁফ, সারা মুখে হাসি ও স্নেহ ভরা। লালজি ভারতে হাতি ধরা আর পোষ মানানোর কাজে এবং মাহুত-মহলে কিংবদন্তি।

লালজি জেঠুকে আমি এবং আমরা সবাই আত্মীয়রূপেই পেয়েছি। হঠাৎ হঠাৎ চলে আসতেন বাড়িতে। কর্তামার হাতের নিরামিষ রান্না খেতেন, আমরা যা খেতাম তা-ই খেতেন। তার পরে বাবার সঙ্গে শুরু হত তাঁর হাতির গল্প। সেই বয়সে আমি বিশেষ বুঝতে পারতাম না, কিন্তু হাঁ করে শুনতাম সব। ‘লালজি’ বলে সবাই যাঁকে আপন করে নিতেন, তিনি আর কেউ নন, অসমের গৌরীপুরের ছোট রাজকুমার প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া। রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়ার দ্বিতীয় পুত্র। হাতি আর জঙ্গল, জঙ্গল আর হাতির মানুষ তাঁর চিরসঙ্গী।

তাঁর দাদা প্রাক-উত্তমকুমার যুগের মহানায়ক, গৌরীপুরের বড়কুমার প্রমথেশ বড়ুয়া। ‘মুক্তি’ ছবির নায়ক প্রমথেশ একটা লম্বা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট শটে পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় দাঁতাল হাতি ‘জংবাহাদুর’-এর পিঠে সওয়ার, তাঁদের আস্তাবলের হাতির সারি নদীর ও পারে দিগন্তের পাহাড়ের উপরে এগিয়ে চলেছে। নেপথ্যে হৃদয় মোচড়-দেওয়া পঙ্কজ মল্লিকের সেই গান, দিনের শেষে ঘুমের দেশে...

পুজোর ছুটিতে প্রথম বার মা ও বাবার সঙ্গে গেলাম মূর্তি হাতির ক্যাম্পে। ঘন জঙ্গলে মোড়া ছোট পাহাড়ের গায়ে মূর্তি নদীর ধারে এই ক্যাম্প। সেখানে লালজি, পার্বতীদিদি, আর প্রতাপসিং-সহ আরও অনেক হাতি। লালজি এক দিন সকালে আমাকে বললেন, ‘‘তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এ বার হাতি চালাও।’’ আমার বয়স তখন বছর আটেক মাত্র, আর যাকে চালাতে বলা হচ্ছে সে হল একটা আট ফুটের উপর লম্বা, দাঁতাল মদ্দা হাতি!

আমাকে শেখানো হল কিছু বোল আর কিছু টেকনিক। একা আমাকে নিয়ে পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে ঢুকল বিশাল দাঁতাল হাতি। নেহাত শিশু বলে আমাকে স্নেহই করল হয়তো, আমার কথা মাঝেমধ্যে শুনে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে সারা পাহাড় ঘুরিয়ে শেষে মূর্তি ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনল— মাহুত বা অন্য লোক ছাড়াই। শুনেছিলাম, কিছু বছর বাদে ‘মস্ত’-এর বশবর্তী হয়ে সে মাহুত আর পাতাওয়ালাকে মেরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গিয়েছিল। লালজির বহু ডাকাডাকি, খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও প্রিয় সেই হাতিকে আর পাওয়া যায়নি।

তার কিছু বছর বাদে বাবা এক বার আমাকে কালীপুজোর ছুটিতে নিয়ে গেলেন কোচবিহারের মাটিয়াবাগে লালজি জেঠুর ‘হাওয়া মহল’ প্রাসাদে। প্রাসাদের তিন দিকে গদাধর নদী। মেঠো ও সুরকির পথ দিয়ে মহলে পৌঁছলাম। তিন পাশে জল, আর মানুষের চেয়েও লম্বা, ঘন ঘাস, জলাজমির জঙ্গল। বিশাল একটা দ্বীপের মতো জায়গা জুড়ে বেশ উঁচু, কাঠের তৈরি বাংলো। তার চারদিক বারান্দায় ঘেরা। দিনের বেলায় এলাহি খাবারের আয়োজন, জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীর নানান গল্প। তার পরে বাবার সঙ্গে আশপাশ ঘুরে বেড়ানো। সন্ধেয় হ্যাজাকের আলোয় বারান্দায় বসে আর এক প্রস্থ গল্প শোনা। নেপথ্যে ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের ঢেউ, অন্ধকারে জোনাকির ঝিকিমিকি, মাঝেমধ্যে শেয়ালের ডাক। আমি পয়েন্ট টু টু বন্দুক হাতে ও টর্চ নিয়ে বাংলোর নীচে অন্ধকারে ভাম মারার চেষ্টা করতাম। অবশ্য বিফলই হত সেই প্রচেষ্টা। গাঢ় অন্ধকারে উঁচু ঘাসের মধ্যে কালো রঙের ভাম খোঁজা, আর টর্চের আলোয় তার জ্বলজ্বলে চোখের এক ঝলক দেখে তাকে মারা অতি দুষ্কর। সেটা আমি বুঝলাম দু’রাতেই। ভাম অতি ধূর্ত এবং দ্রুতগামী, চোখে আলো পড়লে হরিণের মতো অবাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে না।

লালজি এক রাতে বাঁশের ভিতরে মাংসের কিমা ভরে রান্না করলেন। অপূর্ব তার স্বাদ। মাংসের গায়ে আগুনের হালকা ধোঁয়াটে গন্ধ। আরও রাতে প্রতিমা বড়ুয়া দিদি এলেন তাঁর গানের সঙ্গত-সঙ্গীদের নিয়ে। পার্বতীদিদি তখন মূর্তি ক্যাম্প সামলাচ্ছেন। হস্তিবিশারদ পার্বতী বড়ুয়া তাঁর বাবা এবং দিদির ঐতিহ্য এখনও উজ্জ্বল করে রেখেছেন। প্রতিমাদিদির সেই রাতে তাঁর বাবা ও বাবার বন্ধুর সামনে সে কী অবিস্মরণীয় গোয়ালপেড়ে ও হাতি-মাহুতের গান! লালজি আর তাঁর হাতির জগৎ এখন প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। কিন্তু ওই কালীপুজোর ছুটির স্মৃতি চিরকাল আমার মনে আঁকা থাকবে।

Elephant Expert Prakritish Chandra Barua
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy