আজ সকালে লেনিন এসেছিলেন বাড়িতে। ভারতের বিপ্লব নিয়ে তিনি প্রায় দু’-তিন ঘণ্টা আলোচনা করেন দাদুর সঙ্গে। কী ভাবে ভারতের নানা জায়গায় বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে দাদু বিভিন্ন টিপ্স দেন লেনিনকে। যেমন পাড়ার মোড়ে তিনতলা বাড়ি হাঁকানো প্রোমোটার দেবাশিস নন্দীর থেকে লেনিনকে সতর্ক থাকতে বলেন দাদু। দেবাশিসের চোখ পড়েছে এই নোনাধরা দোতলা বাড়িটার ওপর। লেনিন আশ্বস্ত করেছেন, এক বার বিপ্লব হয়ে যাক। তার পর পাড়ার মোড়ে প্রতি পনেরোই অগস্ট কিংবা তেইশে জানুয়ারি যে পোস্টে জাতীয় পতাকা টাঙানো হয়, সেই পোস্টে ফাঁসি দেবেন দেবাশিসকে।
আলোচনার পর চিনি ছাড়া লিকার চা আর নোনতা বিস্কুট খেয়ে লেনিন ঘোষণা করে যান, ‘কমরেড শিবদাস লাহিড়ি, তুমি প্রস্তুত থেকো। আমি বাহিনী নিয়ে আসছি। তোমাকেও বিপ্লবে শামিল হতে হবে।’
অতনু পড়ন্ত দুপুরে বাড়ি ফিরতে মা কাঁদো-কাঁদো গলায় এই সব জানালেন। চট করে কোনও জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে এসে ফ্যান চালাল অতনু। বসন্তকালে চারপাশ জ্বলছে। গাছের নতুন পাতারাও নুয়ে পড়ছে। দূরে গাছের আড়ালে বসে একটা কোকিল হেঁড়ে গলায় ডেকে চলেছে।
অতনুর পিছু-পিছু মা’ও এসে ওর ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘তুই কি এক বার ডা. বোসের কাছে যাবি?’
‘এই তো গত সপ্তাহে গেলাম। আবার যাওয়া মানে আবার চারশো টাকার ধাক্কা।’
‘তবু,’ মা ইতস্তত করলেন, ‘বাবার এই অবস্থা ভাবা যায় না...’
অতনু কথা বাড়াল না। মায়ের বক্তব্য কোন দিকে ঘুরবে ও জানে। মা শুরু করবেন দাদুর গুণকীর্তন দিয়ে। কী ভাবে দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল মানুষেরা দাদুর নেতৃত্বে এখানে প্রতিষ্ঠা পায়। জবরদখলি জমি থেকে দাদুদের উৎখাত করতে দিনে পুলিশ আসত। রাতে এলাকার এক কালের জমিদারের বংশধর রাঘব হালদারের মস্তানেরা। দাদুর কমিউনিস্ট আন্দোলন। বাবার লড়াই। এই কাহিনি শেষ হবে বাবাকে কুপিয়ে খুন করার ঘটনা দিয়ে। অতনুর তখন পাঁচ বছর বয়স। একমাত্র সন্তানের অমন মৃত্যু দেখে ঠাকুমাও আর বেশি দিন বাঁচেনি। আর দু’-দুটো মৃত্যু লাহিড়ি পরিবারকে তছনছ করে দিলেও দাদু ছিলেন অবিচল। দাদু বুঝেছিলেন, তাঁর কিছু হলে বউমা আর নাতির ভিক্ষে করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
অতনু জামা ছাড়ল। বলল, ‘দেখছি।’
মা বোধহয় আরও কিছু বলতেন। কিন্তু বললেন না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
অতনু পায়ে-পায়ে জানলার কাছে আসে। গরম হাওয়া এসে ঝাপটা মারল ওর মুখে। মায়ের সামনে এত ক্ষণ নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল অতনু। মা চলে যেতেই ক্ষোভ, হতাশা ছড়িয়ে পড়ল ওর চেহারায়। অতনু বুঝতে পারে না অমিয় ঘোষ সত্যি বলছে কি না। দু’লাখ টাকারই বা কী হবে? মা এখনও কিছু জানেন না। দাদু তো জানা, না-জানার ঊর্ধ্বে। শুধু অতনু ছটফট করতে থাকল। তা হলে কি শেষ পর্যন্ত দেবাশিস নন্দীর প্রস্তাবই মেনে নিতে হবে?
বাড়ি আসার পথে দাসপাড়ার মোড়ে সুমনাকে দেখতে পেয়েছিল অতনু। তবে অতনুর আগে সুমনাই বোধহয় ওকে দেখেছিল। আর সেই জন্য সুমনা অন্য দিকে হনহন করে হাঁটা দেয়। অতনু এক বার ভাবল সুমনার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলাদা করে আর কিছুই হবে না। তবু প্রায় এক বছর বাদে সুমনার মুখোমুখি হবে। হয়তো এক-আধটা কথা বলবে ওরা।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানলার ধার থেকে সরে এল অতনু। বুকে তিরতিরে কাঁপন। এ বার কি জমি-বাড়ি ছাড়তে হবে? পূর্ববঙ্গ থেকে এসে দাদু লড়াই করে যে জমি নিজের পরিবারের জন্য দখল করেছিলেন, এ বার কি তাও হাতছাড়া হবে? ফের ছিন্নমূল হবে শিবদাস লাহিড়ির পরিবার?
অতনু এসে বিছানায় আধশোওয়া হল। বসার ঘরে মা টিভি-সিরিয়াল দেখছেন। তার শব্দ ছিটকে আসছে। অতনুর ওই সব আওয়াজে বিরক্ত লাগল। চোখ বুজে ও পুরনো কথা ভাবতে থাকে।
বাবাকে কোনও দিন মনে পড়ে না অতনুর। ছোট থেকেই বাবা-ছাড়া জীবনে ও অভ্যস্ত। তবে বাবা না থাকলেও দাদু ছিলেন, মা রয়েছেন। আর ছিল লড়াইয়ের গল্প। সে লড়াই কখনও ছিল খাবারের, কখনও নতুন দেশে জমি দখলের, কখনও শ্রেণিসংগ্রামের, কখনও ক্ষুদ্র স্বার্থের বিরুদ্ধে।
অতনু বরাবরই পড়াশোনায় ভাল। ফুটবল, সাঁতারেও নাম ছিল। দাদুর নির্দেশে দুর্গাপুজো থেকে নর্দমা সাফাই, সব কাজেই এগিয়ে যেতে হত। দাদুর ঘরে ঝুলত লেনিনের ছবি। গণসঙ্গীত বাজত টেপরেকর্ডারে। ওদের বাড়িতে ফেস্টুন, ব্যানার লেখা হত লাল কালিতে। মা উনুন জ্বালিয়ে আঠা তৈরি করে দিতেন।
এ সবের মধ্যেই অতনুর বড় হওয়া।
দাদু ছিলেন স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি রাজনীতি করতেন। কখনও দলের কোনও পদে বসেননি ঠিকই। তবে এলাকার মানুষ জানত শিবদাস লাহিড়ির নির্দেশই কলোনির শেষ কথা। পুকুর সংস্কার, রাস্তাঘাট সারানো, এলাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সব হত দাদুর কড়া নজরদারিতে। শুধু পুজোআচ্চা হলে দাদু সরাসরি জড়াতেন না।
মায়ের কাছে অতনু শুনেছে, বাবার আবার নাকি এ সবে খুব উৎসাহ ছিল। বাবা ধুনুচি নাচ চমৎকার নাচতেন। দোলের সময় মোম দিয়ে ডিমের মতো দেখতে রং ভরা বেলুন বানাতেন।
অতনু অবশ্য দাদুর আদলে বড় হয়েছে। বাবার মতো হয়নি।
সুমনারাও এ পাড়াতেই থাকে। দুজনে পিঠোপিঠি বড় হয়েছে। বয়সে সুমনা বছর দুয়েকের ছোট। সুমনার বাবা বিভাসকাকু চাকরি করতেন। অতনু তখন সিক্সে পড়ে। এক দিন লাফাতে-লাফাতে দাদুর ঘরে ঢুকতে গিয়ে ও থমকে গেল।
অতনু দেখল, দাদু চেয়ারে বসে। দাদুর হাঁটু জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছেন বিভাসকাকু। দৃশ্যটায় এমন কিছু ছিল যে অতনু আর ঘরে ঢুকতে পারেনি। পরে ও শুনতে পেয়েছিল, দাদু রাগী স্বরে মাকে বলছেন, ‘জুটমিলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে বিভাসের একটা হিল্লে করে দিয়েছি। তবে আবার যদি চুরি করে, আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। দেশের লোক হলেও চোর-ছ্যাঁচড়কে তো বারবার চাকরি দিতে পারি না! পার্টির লোকেরা কী বলবে?’
পার্টির লোকেরা আদৌ কিছু বলেছে কি না অতনু জানে না। বিভাসকাকু জুটমিলে ঢুকে চুরি-টুরি করেছে কি না অতনু তারও খোঁজ পায়নি। এখন তো জুটমিল প্রায়ই বন্ধ থাকে। বিভাসকাকুর অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না। পুরনো টিনের চালের বাড়ি ভেঙে বিভাসকাকু দোতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। জুটমিলের চাকরি থাকতে-থাকতেই ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা শুরু করেছিলেন বিভাসকাকু। এখন তাঁর ছ’টা গাড়ি নিয়মিত ভাড়া খাটছে। শোনা যাচ্ছে, দেবাশিস নন্দীর প্রোমোটারি ব্যবসায় কাকুর শেয়ার আছে।
সুমনা আর অতনু চির দিনই এ-সবের বাইরে ছিল। ওদের সম্পর্ক ক্লাস এইট-নাইন থেকে। সে বার পাড়ার সরস্বতীপুজোর দায়িত্ব দাদু দিয়েছিলেন অতনু আর নন্দিনীকে। দুজনে খুব খেটেওছিল। সে দিন সন্ধেবেলা নন্দিনী ইশারায় ওকে প্যান্ডেলের পিছনের অন্ধকারে ডাকল। নন্দিনীর কী মতলব ছিল, অতনু বোঝেনি। কারণ ওরা অন্ধকারে মুখোমুখি হতেই কোত্থেকে সুমনা এসে হাজির হল। অতনুর দিকে চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে ও বলল, ‘ঠাকুরের পিছনে এ-সব করছিস? দাঁড়া, আমি দাদুকে বলছি। তুই খুব খারাপ ছেলে।’
দাদুর কথায় অতনু ছিটকে পালিয়ে এল। নন্দিনীর দিকে ফিরেও তাকাল না। এর পরই সুমনা এসে ওকে ধরল। বলল, ‘ফের যদি দেখেছি আমায় ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশতে, সোজা গিয়ে দাদুকে বলে দেব।’
এ ভাবেই ওরা পরস্পরকে ভালবেসেছে। কিন্তু অতনুর জীবনে গোলমাল হয়ে গেল ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়। দাদুর হঠাৎ সেরিব্রাল হল। মাস খানেক ধরে তুমুল টানাপোড়েন চলল। সেই প্রথম অতনু উপলব্ধি করল, দাদু কত বড় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
দাদু বিছানা নিতেই ওদের চারপাশ দ্রুত পালটে গেল। দাদুর জায়গায় নতুনেরা এলেন। হাওয়ায় উড়তে লাগল, শিবদাস লাহিড়ি এলাকায় সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আশপাশের কারখানা থেকে দাদু নাকি মোটা টাকা তুলতেন চাঁদা হিসেবে। তার নাকি কোনও হিসেব পাওয়া যায়নি।
এর পর পালাবদল হল। দাদুর দলের ছেলেরা ভেসে গেল অন্য দলে। আর গ্যারেজে পড়ে থাকা পুরনো অস্টিন গাড়ির মতো দাদু পড়ে থাকলেন বাড়ির বিছানায়।
অতনু বড় হতে-হতে টের পেল, এক কালে দাদুর অনুগ্রহভাজনেরা হয়েছে এলাকার মাথা। আর তারা সবার আগে দাদুকেই মুছে ফেলতে চাইছে। দাদুর জন্যই কেউ আর ওদের পাশে থাকতে চাইছে না। ক্রমশ ওদের পরিবার কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে বাড়িতে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে থাকল। সেরিব্রালের ফলে দাদুর মাথা বিগড়ে যায়। প্রথমে তিনি ভুল বকতেন। মানুষজন ভাল ভাবে চিনতে পারতেন না। ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে লাগল। কখনও দাদুর চেতনা পিছিয়ে যেত কুড়ি বছর পিছনে। তিনি তখন মাকেও নিজের পুত্রবধূ হিসেবে চিনতেন না। কুড়ি বছর আগের মায়ের চেহারা তাঁর সামনে ফুটে উঠত। সেই সব মুহূর্তে ঠাকুমাকেও খুঁজতেন দাদু। এক-এক সময় তো চলে যেতেন ছোটবেলায় দেখা পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায়।
গোড়ার দিকে দাদুর এই ধরনের আচরণ নিয়ে টেনশন থাকলেও পরে তা থিতিয়ে যায়। তখন শুরু হল হাসাহাসি। দাদুকে নিয়ে হাসাহাসি অতনু বরদাস্ত করতে পারেনি। সুমনার সঙ্গে ওর প্রথম ঝগড়া দাদুর শরীর খারাপ নিয়েই। সুমনা এর পর রোগ সম্পর্কে কিছু বলত না। তবে সবাই যা বলত, ও ঠারে-ঠোরে সে-সব শোনাত। এক দিন তো বলেই ফেলল, ‘সবাই জানে শিবদাস লাহিড়ি টাকা মেরেছে।’
সে দিন ওরা গঙ্গার ধারে বসে ছিল। সুমনার কথায় অতনুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ও বলল, ‘সবাই জানে মানে?’
‘মানে সবাই বলে। আমি শুনেছি বাবার কাছে।’
‘সে টাকা গেল কোথায়?’
‘কেউ বলে লুকনো আছে। আবার কেউ বলে মাথার গোলমাল হওয়ায় নিজেই ভুলে গেছে। গরিবের অত টাকা মারার পাপেই নাকি তোমার দাদুর এই অবস্থা।’
এমন কথা শোনার পর নিজেকে আর সামলাতে পারেনি অতনু। তুমুল ঝগড়া করে সুমনার সঙ্গে। আর ঝগড়ার ভেতরেই ও জানিয়ে দেয় ছোটবেলায় দেখা দাদু আর বিভাসকাকুর সেই দৃশ্যের ব্যাপারে। সুমনা সে দিন অতনুকে বিশ্বাস করেনি। এই ঝগড়ার জেরেই আনঅফিশিয়ালি ওদের সম্পর্ক ভেঙে গেল। অফিশিয়ালি ভাঙল আরও আট মাস পর ভিলাইয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে সুমনার বিয়ে হয়ে যাওয়ায়।
সম্পর্ক ভাঙার চাপে অতনুও ভেঙে পড়েছিল। সারা দিন হয় চুপচাপ বসে থাকত, না হলে এলোমেলো ঘুরে বেড়াত। নিরুপায় হয়ে মা এক দিন ওকে ডেকে বোঝালেন, ‘তোর দাদুর পেনশনে আর কত টানব? আমার গয়নাগাটি মায় তোর অন্নপ্রাশনের হারও বাবার অসুখের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। ব্যাংকে মাত্র সোয়া দু’লাখ পড়ে। তোর দাদুর বাড়াবাড়ি হলে কাজে লাগবে। তুই এবার উঠেপড়ে লাগ। সুমনা আর ফিরবে না।’
মায়ের কথায় জোর ঝাঁকুনি খেল অতনু। সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে ও যখন চাকরির পরীক্ষার বাজারে নামল, তখন দেখতে পেল অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তবু পাড়ার এক জনের কাছে ও ভর্তি হল কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় পাশ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু চারপাশে এত ঝকঝকে ছেলে যে অতনু ওদের পাশে থই পাচ্ছিল না।
এমন সময় ওদের এলাকার মিউনিসিপ্যালিটিতে দুটো পোস্টে লোক নেওয়ার ফর্ম বেরোল। অতনু আবেদনও করল। খোঁজ পেল, পিছন দরজা দিয়ে চাকরি পাওয়ার সুযোগ আছে। তার জন্য ধরতে হবে অমিয় ঘোষকে। এই ভদ্রলোকও দাদুর টাইপের। কোনও পদে নেই। কিন্তু অগাধ ক্ষমতা।
এক সন্ধেবেলা অতনু গিয়ে হাজির হল অমিয় ঘোষের বাড়িতে। অমিয় ঘোষ এক বারে ওকে চিনতে পারল। ডেকে বসিয়ে দাদুর খোঁজ নিল। ওদের বাড়ির কী পরিস্থিতি শুনল। চাকরির কথায় বলল, ‘দ্যাখো, এতে প্রচুর ঘাপলা হচ্ছে। আমার কথায় পুরোপুরি কাজ হবে না। তবে তুমি যদি কিছু ছাড়তে পারো তা হলে হতে পারে।’
‘কত?’ নিশ্বাস বন্ধ করে অতনু প্রশ্ন করেছিল।
‘তিন লাখ।’
অতনু মাথা নাড়ল। বলল, ‘অত টাকা আমাদের নেই।’
‘কিন্তু এর চেয়ে কম হবে না ভাই। বুঝতেই পারছ টাকাটা কোনও এক জনের পকেটে যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, টাকা দেওয়ার জন্য লোকজন ছিপ ফেলে বসে। তোমার দাদুর আমল থেকেই এই সিস্টেম।’
সে দিন মাথা হেঁট করে অতনু বেরিয়ে আসে। তবে হাল ছাড়ে না। পর দিন আবার যায়। এ ভাবে বারবার গিয়ে সাত দিনের মাথায় ও খানিক হলেও অমিয় ঘোষের মন ভেজাতে পারল। অবশেষে তিনি দু’লাখ টাকায় রফা করলেন।
বাড়ি ফিরে মাকে রাজি করিয়ে ও ব্যাংক থেকে দু’লাখ টাকা তুলল। সেই টাকা অমিয় ঘোষের হাতে দিতে সে বলল, ‘তুমি তোমার মতো পরীক্ষায় বসে যাও। এ দিকটা যা করার আমি করব।’
এর পর লেখা পরীক্ষা হল। ইন্টারভিউও হল। নির্দিষ্ট সময় ফল বেরোল। কিন্তু চাকরি পাওয়া ক্যান্ডিডেটদের তালিকায় অতনুর নাম নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো অমিয় ঘোষকে ফোন করেছিল ও। সেই ফোন বেজে-বেজে থেমে গেল। বাড়ি গিয়েও তার দেখা পাওয়া গেল না। এ ভাবে কিছু দিন ঘোরার পর আজ ভদ্রলোকের নাগাল পেল অতনু। পুরসভা অফিসের সামনে দুজনের সঙ্গে কথা বলছেন।
অমিয় ঘোষ তাড়াতাড়ি ওকে এক পাশে সরিয়ে এনে বলল, ‘শোনো, এ বারে তোমার হল না। ওপরতলার ক্যান্ডিডেট ছিল। তোমার মতো আর-একটা ছেলেও ঝুলে। নেক্সট টার্মে তোমাদেরটা করে দেব।’
‘সেটা কবে?’ অসহায় ভাবে বলে অতনু।
‘প্রোব্যাবলি নেক্সট ইয়ার। তবে হয়ে যাবে। একদম চিন্তা কোরো না। তোমার দাদুর আমল থেকেই এই সিস্টেম,’ অতনুর পিঠ চাপড়ে বলল অমিয় ঘোষ।
অতনু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগে ডাক আসায় অমিয় ঘোষ চলে গেল। আর সাইকেলে চড়ে হাজার দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরল অতনু। রাস্তায় সুমনাকে দেখল। বুকের ভেতর সিগারেটের ধোঁয়ার মতো হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল।
পিকলুদের বাড়িতে শাঁখের আওয়াজ হতেই চোখ খোলে অতনু। উঠে বসে। সন্ধে ঘনিয়েছে। ঘর অন্ধকার। উঠে বসে প্রথমেই দাদুর কথা মনে এল ওর। দাদুর পেনশনের টাকায় যেমন ওদের সংসার চলছে, তেমনই দাদুর জন্যই অতনুর জীবন ছারখার হতে বসেছে। সুমনার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙেছে। অমিয় ঘোষও দাদুকে বাদ দিয়ে ওদের ভাবছে না।
অতনুর মাথা গরম হয়ে উঠল। ও পায়ে-পায়ে গিয়ে দাদুর ঘরে ঢুকল। দাদুর ঘরে এমনিতেই রোগী-রোগী গন্ধ। বিকেল হলেই মা মশারি টাঙিয়ে দেন। ফলে দাদুর বিছানা যেন এক জমাট অন্ধকার। দাদু জেগে আছে কি না বোঝার জন্য আর একটু এগোতেই সেই ফ্যাঁসফেঁসে গলা শুনতে পেল ও।
‘কে দাদুভাই নাকি?’
‘হ্যাঁ দাদু।’
‘মায়ের কাছে শুনেছ তো? লেনিন আসছেন। আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।’
অতনু আর এই পাগলামি নিতে পারল না। বলল, ‘লেনিন মারা গেছে দাদু।’
অন্ধকারটা এবার নড়েচড়ে উঠল। অস্ফুটে বলল, ‘নেই?’
‘না দাদু, নেই,’ ছুরি চালানোর মনোভাব নিয়ে অতনু জবাব দিল।
দাদু চুপ করে গেলেন। তারপর আবার বললেন, ‘কাছে আসবে দাদুভাই!’
অতনু বিছানার সামনে যায়। শিরা বের করা একটা শীর্ণ হাত মশারি থেকে বেরিয়ে এসে ওর হাত ধরল। অনেক দিন বাদে দাদুর স্পর্শ পেল অতনু।
ফ্যাঁসফেঁসে গলায় দাদু বললেন, ‘কোথায় নেই দাদুভাই? এই তো আমি ছুঁয়ে আছি।’
অতনু কোনও উত্তর দেয় না।
দাদুর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হাঁপ-ধরা গলায় তিনি বলতে থাকলেন, ‘দাদুভাই, লেনিন মরেনি। মরবেও না। পুরনো লেনিন খসবে। নতুন লেনিন জন্মাবে। পুরনো ইজ্ম যাবে। নতুন যুগের নতুন বিপ্লবের ইজ্মের নিয়ে নতুন সমাজ গড়বে নতুন লেনিন। এক দেশ থেকে আর-এক দেশে, এক জাতি থেকে আর-এক জাতিতে, এক সময় থেকে আর-এক সময়ে। আমাদের শুধু প্রস্তুত থাকতে হবে...’
দাদু কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলেই যান। সেই কথা শুনতে-শুনতে অতনু দেখতে পেল, ওর জীবনের ব্যর্থতারা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আর দাদুর চারপাশের জমাট অন্ধকার কখন যেন আলো হয়ে গেছে।