Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রুমনির সিংহ মুখোশ

সে দিন রুমনিদের পাড়ার একটি ক্লাবে বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। অনেক দূর দূর থেকেও ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়েছিল প্রতিযোগিতায়। বিষয় ছিল, যে যার মতো আঁকবে যে কোনও মাধ্যমে।

মধুসূদন ঘাটী
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০০:২২
Share: Save:

সে দিন রুমনিদের পাড়ার একটি ক্লাবে বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। অনেক দূর দূর থেকেও ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়েছিল প্রতিযোগিতায়। বিষয় ছিল, যে যার মতো আঁকবে যে কোনও মাধ্যমে।

রুমনি ছোটবেলা থেকেই আঁকে। এখন ও ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্যাস্টেল ছেড়ে জলরঙে ও বেশ সাবলীল। ‘ফাইভ থেকে এইট’ পর্যন্ত গ্রুপে ও এঁকেছিল। সবাই তাদের সেরা ছবিটাই এঁকেছিল সে দিন। সকাল দশটায় প্রতিযোগিতা হলেও রেজাল্ট ঘোষণা হল সন্ধেবেলা। ওই দিনই ছিল পুরস্কার দেওয়ার দিন। ফোনে ফলাফল জানানো হয়েছে। কেউ এঁকেছে গাছপালা-প্রকৃতি, নদনদী, পাহাড়-সূর্য, কেউ এঁকেছে দেবদেবীর ছবি। কারও ছবিতে ফুটে উঠেছে গ্রামবাংলা-বাড়িঘর আর মানুষের কাজকর্ম। কিন্তু রুমনি ও সব আঁকলই না। বাবার কাছ থেকে ওর বারোতম জন্মদিনে উপহার পাওয়া বনের জীবজন্তুদের নিয়ে একটি বই থেকে সে আঁকল সিংহের ছবি, পাশে সিংহী। বই পড়ে ও জেনেছে, সিংহের কেশর থাকে কিন্তু সিংহীর কেশর থাকে না। সে রকমই একটি ছবি এঁকে রুমনি প্রথম হয়েছে।

মা-বাবার সঙ্গে পুরস্কার নিতে গেল সন্ধেবেলা। মঞ্চে আঁকার পুরস্কার দেওয়ার সময় ঘোষণা করা হল, ‘খ’ বিভাগে প্রথম হয়েছে রুমনি হালদার। ও এঁকেছে বনে বসে থাকা দুটো সিংহ-সিংহীর ছবি। ওর কনসেপ্ট দেখে পরীক্ষক ভীষণ খুশি হয়েছেন। একেবারে অন্য ধরনের ছবি।

সেই শুরু। বন আর জীবজন্তুর যে কোনও ছবি ও আঁকতেই পারত, কিন্তু ওর আঁকার বিষয় হয়ে উঠল শুধু সিংহ। আঁকার খাতাও দিন দিন ভরে উঠল সিংহের ছবিতে। ও জেনেছে, সিংহ হল পশুর রাজা। সিংহের গর্জন নাকি খুব গম্ভীর আর ভয়ঙ্কর।
আফ্রিকার টাকার্ন জাতির লোকেরা এই গর্জনকে বলে ‘নানি মুয়েনে ইনচি-আংগু-আংগু-আংগু।’ এর মানে হল, ‘এ বন কার— আমার আমার আমার।’

আঁকার স্যর আরণ্যকবাবু রুমনির বাড়িতে আঁকা শেখাতে আসেন প্রতি রবিবার বিকেলে। রুমনির আঁকার আগ্রহ দেখে স্যর এক বার বলেছিলেন, ‘রুমনি অনেক বড় আঁকিয়ে হবে।’ মা-বাবার তাই চিন্তা, ও যদি শুধুই সিংহের ছবি আঁকে তবে বড় আঁকিয়ে হবে কী ভাবে!

রুমনি জেনেছে, বাঘেরা এখন ভারতের জাতীয় পশু। কিন্তু এক সময় সিংহরাই তো সেই জায়গাটা দখল করে রেখেছিল। কেন কেড়ে নেওয়া হল তাদের এই সর্বোচ্চ সম্মান!

রুমনির ক্লাসে যিনি জীবনবিজ্ঞান পড়ান, সেই অমূল্যরতনস্যর এক বার বলেছিলেন, কেবলমাত্র এশিয়া আর আফ্রিকাতে সিংহেরা বাস করে। এরা বেড়াল বংশের প্রাণীদের সদস্য। একসঙ্গে দশ-কুড়িটি সিংহ দল বেঁধে থাকতে ভালবাসে। তখন এদের বলে ‘প্রাইড’।

সে দিন থেকে রুমনির মাথার ভিতর সিংহেরা আরও বেশি করে নড়াচড়া শুরু করল। অনেক সময় তার ছবি আঁকার খাতায় কোনও সিংহের ছবির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রুমনি, ‘তোমরা চুপচাপ আছ কেন, প্রতিবাদ করছ না কেন?’

এই প্রতিবাদের বিষয়টিতে রুমনি ক্লাসে বেশ এগিয়ে। কেউ ক্লাসে অন্যায় আচরণ করলে বা জোরে কথা বললে রুমনি তার প্রতিবাদ করে। ও যদিও ক্লাসের মনিটর নয়, তবুও সবাই ওকে মনিটরের মতো ভাবে। এখন আবার সিংহ নিয়ে চর্চা শুরু করেছে জেনে সহপাঠীরা বলে, ‘রুমনি এখন ক্লাসের রাজা।’ ও কিন্তু নিজেকে রাজা ভাবতে চায়নি। ও চায় বনের রাজা সিংহ তার পুরনো জায়গা ফিরে পাক। কয়েক মাসের মধ্যে ক্লাসের অনেককে নিজের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলল। অনেকেই সিংহ নিয়ে নানান আলাপ-আলোচনা করতে পারে এখন। রুমনির ভাল লাগে।

অনিন্দিতার বাবা বনকর্মী হিসেবে উত্তরবঙ্গের কোনও বনে চাকরি করেন। তাই জেনে রুমনির আগ্রহ বাড়ে। এক দিন অনেকে মিলে অনিন্দিতার বাড়িতে গিয়েছিল তার জন্মদিন উপলক্ষে। রুমনির ইচ্ছে, অনিন্দিতার বাবা সুনন্দআঙ্কলের কাছ থেকে সিংহ নিয়ে অনেক তথ্য জেনে নিতে পারবে। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর বনে কাটিয়েছেন। আরও অনেকগুলো বছর কাটাবেন। সে-দিন দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া শেষে গোলটেবিলের আড্ডা জমে গিয়েছিল। সুনন্দআঙ্কল বলেছিলেন, ‘বাঘকে জাতীয় পশু করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই জায়গাটা সিংহেরই থাকা উচিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সিংহেরা বাঘের মতো হিংস্র নয়। এমনকী মানুষের ভালবাসা-আদর পেলে পোষ্যও হয়ে যেতে পারে। অকারণে মানুষকে আক্রমণ করে না। এরা হল ন্যায়, অহিংসা, সাহস আর বীরত্বের প্রতীক। ভারত সরকার সম্রাট অশোকের সিংহস্তম্ভটিকেই রাষ্ট্রীয় চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছে। আবার দেবী দুর্গার বাহন হিসেবেও সিংহকে আমরা পুজো করি। অসুর নিধনে সিংহের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো।’

গুজরাতের গির অভয়ারণ্যে সিংহের সংখ্যা কমছে। যা সত্যিই রুমনিদের ভাবিয়ে তুলল। ওদের এই ভাবনার সদস্য সংখ্যা এখন তিরিশ পেরিয়েছে। এ বছর ওদের ক্লাস এইট হল। অনেকেই এখন ছবি আঁকার খাতায় সিংহ-সিংহীর ছবি আঁকতে পারে।
ওরা বই পড়ে জেনেছে, বহু বহু বছর আগে প্রথম এশিয়াটিক সিংহেরা পা রেখেছিল সৌরাষ্ট্র উপদ্বীপে।

রুমনি জীবজন্তুদের বই পেলে মন দিয়ে পড়ে। তাদের ইতিহাস জানতে চায়। এমনিই একটি বই থেকে জেনেছে, সিংহেরা দিন দিন যখন বাড়ছে, তখনই সিংহ শিকারে যাওয়ার ইচ্ছে জাগল রাজা কিংবা জমিদারদের। ছোটখাটো প্রাণী শিকার ছিল তাঁদের কাছে জলভাত, কিন্তু সিংহ শিকারে নাকি শিকারিদের জাত চেনা যেত।

দেখতে দেখতে রুমনি অনেক বড় হয়ে উঠল। সে এখন ক্লাস টেনে পড়ে সিংহ সম্পর্কে তার ধারণা অনেক বেড়েছে। এক বার গ্রামের চৈত্র মাসের শেষ চড়ক মেলায় গিয়ে কয়েকটা সিংহের মুখোশ কিনেছিল। তাই দিয়ে পড়ার রুম সাজিয়েছে। নিঝুম ঘরে যখন ও একা একা পড়তে বসে, সেই সিংহের মুখোশের আড়াল থেকে যেন বেরিয়ে আসে আস্ত একটা জীবন্ত সিংহ। ছবির খাতায় আঁকা সিংহের মতো চোখ দুটো গোল গোল করে যেন বলে ওঠে, ‘তুমি কি আমাদের বাঁচাতে পারবে রুমনিদিদিমণি? ফিরিয়ে দিতে পারবে আমাদের আগেকার সম্মান?’

একটা বইতে রুমনি পড়েছিল মুখোশেরা কথা বলে। রাজা মুখোশ, রানি মুখোশ, বাঘ মুখোশ, সিংহ মুখোশ, আদিবাসী মুখোশ, এমনকী ভূত মুখোশেরাও কথা বলতে পারে মানুষের মতো। তাই তার পড়ার ঘরে সাজানো সিংহের মুখোশের দিকে তাকিয়ে রুমনি এক দিন বলে ফেলল, ‘তোমাদের দুঃখ অনেক। সেই দুঃখ দূর করতে গেলে তোমাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’

মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সিংহের চোখে তখন জলের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে। রুমনি সত্যিই যেন শুনতে পেল, সিংহ বলে উঠছে, ‘আমাদের আরও নতুন আস্তানা চাই। বনের গাছ কেটে আমাদের বাঁচার জায়গা ছোট করে দিচ্ছে মানুষেরা। মানুষ সচেতন হলে আমরা আবার ফিরে আসব অনেককে সঙ্গে নিয়ে। তখন যেন আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পশুর তকমা ফিরে পাই। তোমরাই পারো আমাদের দুঃখ দূর করে শুকনো মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে। সেই দিনটির জন্যে অপেক্ষা করে থাকলাম।’

রুমনির চোখেও কখন নেমে এসেছে জলের ধারা। সামনে খুলে রাখা সিংহ আঁকা খাতার পাতায় ক’ফোঁটা জল পড়ে কখন জলছবি হয়ে উঠেছে। ঝাপসা চোখে সেই ভেজা জলছবির উপর আঙুল দিয়ে রুমনি লিখল, ‘উইন’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lion mask short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE