E-Paper

হৃদয়ই দেবীর আসন, মনই তাঁর পূজার অর্ঘ্য

বাহ্যিক নয়, এগুলি দেবীর মানস-আরাধনার উপচার। আকাশ-তত্ত্ব দেবীর বস্ত্র, ভূমি গন্ধ, চিত্ত পুষ্প। সাধকের দেহ আর বিশ্ব যেন মিলেমিশে যায় এখানে। এই পূজায় ঘ্রাণ হবে ধূপের প্রকল্প, অন্তর্গত তেজ হবে প্রদীপ, সুধাসমুদ্র হবে ভোগ-নৈবেদ্য। শাস্ত্রেই বর্ণিত আছে এই অন্তর-যাগের কথা।

অভিষেক বসু

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৮:২৪

দক্ষিণ শহরতলির কর্পোরেশন বাজারের গেটের সামনে স্থায়ী ভাবে অস্থায়ী একটি চৌকির উপর ‘মাসি’র অবস্থান। ব্যস্ত বাবুরা তাড়াহুড়োর বাজারপর্বের শেষে মাসির কাছ থেকে দশ টাকার বিনিময়ে একটি ফিনফিনে পলিপ্যাক সংগ্রহ করে থাকেন। প্যাকেটের মধ্যে ক’টা গাঁদা, এক মুঠো দোপাটি, দু’-তিনটি জবা, একটি তুলসীর ডাল, কয়েকটি বেলপাতা ও দুব্বো জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। এই পুষ্পপল্লব বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ির আলমারির মাথায়, বেডরুমের কোণের উদ্বৃত্ত এক ফালি স্পেসে কিংবা দেয়ালে ফিট করা ঠাকুর-দেবতাদের চরণে নিত্য পরিবেশিত হয়। বাবুদের ব্যস্ততা ফুলওয়ালি মাসির কাছে এসে তুঙ্গে ওঠে, সুতরাং কে কার আগে ছোঁ মেরে ফুলের প্যাকেটটি নিতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলে। মাসিও হাত চালিয়ে আর পেরে ওঠেন না। একটু বেলার দিকে যারা বাজারে যায়, তাদের কাছে অবশ্য তাঁর অন্য চেহারা। ফুল-পাতার সঙ্গে সঙ্গে তখন টুকটাক কথাও চালাচালি হয়, “সে কী গো! মালা নেবে না? জানো তো কত ফুল ফোটে, ঝরে যায়, কেউ দেখে নাকো! এরা তাও এতদূর এসেছে। এখন তুমি নিয়ে ঠাকুরের চরণে দিলে ওদের জম্ম সাত্থক হয়। আট টাকাই দিও না-হয়।”

জানি, অনেকে হয়তো একে বলবেন নিছক বিক্রিবাটার ফিকির। হতে পারে। কিন্তু এই রকম কথা শুনতে পেলে দিনটা কেন যেন ভাল হয়ে যায়।

ফুলওয়ালির এই বয়সে এত ধকল আর পোষায় না! রাত থাকতে উঠে মল্লিকঘাট ফুলের হাটে যেতে হয়। সেখান থেকে কাঁচামাল কিনে ঘাড়ে করে এসে দাঁড়িয়ে থাকা। ফুলের ওজন যে কত, সে যারা জানে না, তারা মালুম পাবে না। তার পর বাসের কন্ডাক্টরের হুজ্জত সামলানো। কোনও বাসে তুইয়ে-বুইয়ে একটু কম ভাড়ায় রফা করে সাতসকালে এসে দোকান ধরতে হয়। আর খুচরো খদ্দের সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! যতই দেওয়া যাক, বলবে “এইটুকুন ফুল দিলে মাসি!” তবু ওর মধ্যেই সে লোককে সতর্ক করার চেষ্টা করে। “তুলসী চাইছ, আমার দিতে কী আছে বলো! কিন্তু তুলসী নষ্ট করলে কী হয় জানো তো?” সে তো আর হেলাফেলা জিনিসের কারবার করে না! পূজার উপকরণ নিয়ে তার জীবিকা আর্থিক কারণে হতে পারে, কিন্তু এর পারমার্থিক মাহাত্ম্য বিষয়ে তার জ্ঞান টনটনে!

সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়

সে বার সরস্বতী পুজোয় আমার ফুলের ডিপার্টমেন্টে ডিউটি পড়েছিল। পুজোর দিন ভোরবেলা হাওড়ায় গঙ্গার ধারে মল্লিকঘাটের ফুলবাজারে যেতে হবে। এগারো ক্লাসে পড়ি। সুতরাং গঙ্গার ধারে ফুলের একটা গোটা বাজার, তার রোম্যান্টিসিজ়ম। সেই সঙ্গে ইতিহাসের হদিস; উনিশ শতক থেকে সে বাজার নাকি রমরমিয়ে চলেছে। আর এটাই নাকি এশিয়ার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো ফুলের হাট। সিনিয়র দাদারা বলেছে যে, সে নাকি স্বপ্নের মতো একটা জগৎ! উত্তেজনায় রাতে ঘুমই হল না। ভোরের আলো ফোটার আগেই মহারাজের সঙ্গে রওনা দিলাম। যা দেখব বলে ভেবেছিলাম, গিয়ে অবশ্য তার কিছুই মিলল না। অত ভোরে অত ভয়ানক হট্টগোল তার আগে আমি কখনও শুনিনি। মহারাজের সঙ্গে এ গলি-ও গলি যাই, পায়ের নীচে কী রকম নরম-নরম লাগে। ভোরের আবছায়া একটু আলো হতে ঠাহর করে দেখি, হাঁটছি আসলে ফুল-পাতার উপর দিয়ে। সে ফুল-পাতার স্তর এত পুরু যে, আগের দিনেরও হতে পারে, আগের বছরেরও হতে পারে। এবং সেই সব পচে-গলে এমন একটা বীভৎস গন্ধ বেরোচ্ছে, যে বাজারের ভিতর মহারাজের দেখাদেখি আমাদেরও নাকে কাপড়। ফুলের সঙ্গে গন্ধের অবিচ্ছেদ্য যোগ আমাদের মনে, সুতরাং এই বাস্তবতা আমার ফুল-হাট বিষয়ক কিশোর-কল্পনাকে বড়ই দলে-মুচড়ে দিয়েছিল। আবছা আলোয় দেখছি যে, অনেক উঁচুতে টঙের উপর ব্যাপারিরা সব বসে বসে আছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারছি যে, কেউ বসে আছে স্তূপীকৃত গোলাপের উপরে, কেউ পদ্মের টাওয়ারে, কেউ বেলফুলের মিনারে! হায় ফুল, সোনালি গন্ধের ফুল!

কোনও পুজোর আগে আগে বাজারে গেলেই দেখি চেনা দোকানগুলোয় কলাগাছ, কলাপাতা, ডাব, ধানের ছড়া বা শোলার নৌকো বা কোনও দিনই-ফুটবে-না পলাশের এমনতরো কুঁড়ি এসে হাজির। আর হাজির সেই সব দোকানিরা, যারা শুধু পুজোপালার আগেই এ রকম পসরা সাজিয়ে এসে বসে। অতিথি-ঠাকুরেরা আসবেন বলে বাড়তি চাহিদা মেটাতে অতিথি-দোকানির আগমন হয় এবং ছোট বাজার তখন বাইরের রাস্তায় উপচে পড়ে।

দুর্গাপুজোর আগে বাজারের এই ব্যাপারটা শুধু আমি নয়, বঙ্গবাসী সকলেই বেশ অনুভব করেন। কারণ, এই পুজোয় প্রয়োজন পড়ে শতেক উপকরণ আর উপচার। পুজোর আচারে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেছে স্মৃতি, পুরাণ আর তন্ত্রের বহুবিধ ধারার অনুশাসন। দুর্গাপুজোকে এমনি এমনি তো আর মহাপূজা বলা হয় না। তার ভিতর ঢুকে আছে মহাস্নান, চণ্ডীপাঠ, হোমযজ্ঞ ইত্যাদি বহু ক্রিয়াকলাপ। সামাজিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে এই বাৎসরিক পার্বণে যে বহু রকমের বিশ্বাস ও আচরণীয় কৃত্য এসে মিলে গেছে, সে কথা সর্বজনবিদিত। দেবী হৈমবতী উমার সঙ্গে মিশে গেছে ব্যাঘ্রবাহিনী বা সিংহবাহিনী পর্বতবাসিনী পার্বতী দেবীর উপাসনা। শবর-নিষাদ-পুলিন্দ পূজিতা আরণ্যক চণ্ডী-চামুণ্ডার সঙ্গে কৃষিজীবনের শস্যের আকাঙ্ক্ষা লীন হয়েছে নবপত্রিকার কল্পনায়। সেই মহাপূজার জন্য তাই দরকার হয় মহা-আয়োজন। তার ফর্দের সব জোগাড় করতে আপনাকে গন্ধবণিক, কংসবণিক, তন্তুবায়, মালাকার, মিঠাইওয়ালা, কুম্ভকার, কর্মকার, বাদ্যকর এ রকম শতখানেক লোকের কাছে যেতে হবে। শহরে বসে এত রকম জিনিস ঠিকঠাক জোগাড় করে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। পকেটে রেস্ত থাকলেও নয়।

বড়ো দীর্ঘতম বৃক্ষে ব’সে আছো, দেবতা আমার

যে জন্য ফুলের কথা হচ্ছিল। দুর্গাপুজোর উপকরণের মধ্যে নানা রকম গাছপালা, গাছের ডাল, বাকল, ফুল, পাতা, ফল প্রয়োজন। পুজোর বিধিগুলো যদি কেউ মন দিয়ে পড়েন, তা হলেই বুঝতে পারবেন যে, এ যেন চার পাশের পরিবেশের প্রতি একটু মনোযোগী ও যত্নবান হতে বলা হচ্ছে আমাদের। হলুদ-হলুদ ফুল ফোটানো রাস্তার ধারের যে গাছকে আমরা কোনও দিন খুব একটা নজর করে দেখিনি, তা-ই যে জয়ন্তী নামে নবপত্রিকা ওরফে কলাবৌ তৈরির আবশ্যিক উপকরণ, তা কে জানত! আপনি বাজারে গিয়ে ফুলওয়ালাকে অর্ডার করে দিলেন, সেও খুঁজেপেতে জয়ন্তীগাছের ডাল এনে আপনার মণ্ডপে হাজির করে দিল। বেলের ডাল দরকার, তাতে ফলে থাকবে জোড়া বেল। সুতরাং বাংলার সমস্ত বেলগাছ পঞ্চমী-ষষ্ঠী নাগাদ ত্রস্ত হয়ে রইল, জোড়া বেল ফলালেই বিপদ। কাটারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মানুষ তৈরি হয়ে আছে। কারণ পুজোয় লাগবে! অথচ এ বিধান যখন তৈরি হয়েছিল, তখন বেলের ডাল নয়, বৃক্ষটিকে অর্চনা করার কথা ছিল। শ্রীফল শ্রীনিকেতন। গাছটিকে আগের দিন সসম্মানে আরাধনা করে, তার অনুমতি নেওয়া হবে। কাল তোমার একটি ডাল পুজোর জন্যে নেব, দুঃখ কোরো না বাপু, আঘাত পেয়ো না। বাজারে গিয়ে যখন শত-শত জোড়া বেলকে গড়াগড়ি খেতে দেখি, কলাগাছের রক্তে জামায় দাগ হয়ে যায়—আমার কেন যেন সেই সব নাম-না-জানা গ্রামের নাম-না-জানা বৃক্ষদের কথা মনে পড়ে। অপরাজিতার লতাটুকু দরকার, সুতরাং হাজার হাজার অপরাজিতা লতা শেকড়বাকড় সুদ্ধ উপড়ে এসে শহরের বাজারে পড়ে থাকে। যারা নবপত্রিকার জন্য পুজোর উদ্যোক্তাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়, তারা মণ্ডপে মণ্ডপে রওনা দেয়। বাকিরা বাজারেই পড়ে থাকে, রোদ বাড়লে ম্লান হয়। শেষে পুরসভার ভ্যান এসে বাতিল জঞ্জালের সঙ্গে সেই সব গাছেদের মৃতদেহ নিয়ে কে জানে কোথায় যেন চলে যায়!

লক্ষ্য হয়তো ছিল চার পাশের পরিবেশের প্রতি আর একটু মনোযোগী হওয়া, কিন্তু গাছপালা তো আমরা সাফ করে ফেলেছি। লতা-গুল্ম-বীরুৎ এবং অবশ্যই ‘আগাছা’ সমেত। শাস্ত্রবিধি পালন করতে গিয়ে প্রবল বেগে তার উল্টো দিকে চলে যাচ্ছি না তো! গাছের পুজো করতে গিয়ে গাছ কাটার এই উৎসব আমাদের সভ্যতার অন্তর্গত স্ববিরোধেরই বড় অর্থপূর্ণ প্রতীক বলে মনে হয়।

অবশ্য আজও পূজাবিধিতে এমন একটি-দু’টি ঘটনা ঘটে, যা চার পাশের জোগাড়যন্ত্র আর হই-হট্টগোলের মধ্যে ব্যতিক্রমী। যেমন মানস-পূজা। এত সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিব্যি লুকিয়ে বসে থাকা একটি অন্তর্মুখী প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটি তীব্র ভাবেই আধ্যাত্মিক, কিন্তু আমাকে আকর্ষণ করে তার ভিতরকার কাব্যময়তা। দুর্গাপূজা সাধারণত কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ কিংবা বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ অনুসারে হয়ে থাকে। এই সব ক’টি বিধিতেই দেখি, মানসপূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কোথাও কোথাও একে অন্তর-যাগও বলা হয়ে থাকে। মহাপূজার বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে হোম বা যজ্ঞের বিধিটি এই যুক্ত-ঐতিহ্যে বৈদিক অগ্নি-উপাসনার প্রতিনিধিত্ব করছে— এ কথা সহজবোধ্য। কিন্তু সেই যজ্ঞ ছাড়াও, মানসপূজাকেও যজ্ঞ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। এই যজ্ঞে ফুল-পাতা বা ঘি-পুরোডাশ এ সবের দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে অন্য রকম কিছু উপাদানের। যজ্ঞের কী ও কেন, অগ্নি-উপাসনার ইতিহাস, বেদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উপনিষদের দার্শনিকতার সম্পর্ক নিয়ে সাতকাহন করা যেত, কিন্তু আজ উদ্দেশ্য অন্যবিধ। দুর্গা অর্চনায় মানসপূজার ভূমিকাটি খতিয়ে দেখা।

দেবীভাগবতে হিমালয়ের প্রশ্নের উত্তরে দেবী বলছেন যে, আমার পূজা দুই প্রকার। বাহ্যিক আর আভ্যন্তরিক। বাহ্যপূজার সবিস্তার ক্রম বর্ণনা করার আগে দেবী আভ্যন্তরিক পূজার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছেন। “সম্বিৎ অর্থাৎ জ্ঞানরূপ পরব্রহ্মে যে চিত্তের বিলয় হয় তাহাকেই আভ্যন্তরিক পূজা কহে।” অবশ্য সেই সঙ্গে এটাও বলা থাকছে যে, আভ্যন্তরিক পূজা উচ্চস্তরের অধিকারীদের জন্য। “যে পর্য্যন্ত আভ্যন্তরিক পূজায় অধিকার না হয়, তাবৎ বাহ্যপূজার আশ্রয় গ্রহণ করিবে, কখনই তাহা পরিত্যাগ করিবে না।” আমরা দেখি যে, পরবর্তী কালে আভ্যন্তরিক পূজার এই প্রক্রিয়াটি ‘রিচুয়াল’-এর অঙ্গ হিসেবেই যেন, বাহ্যিক পুজোরও একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে। পূজার সমস্ত পদ্ধতিতেই পূজককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক কৃত্য বা সামান্য-কাণ্ডের পর দেবীর ধ্যান। তার পর, মানস উপচারে পুজো করতে হবে। এবং মানস-পূজার পরেই অর্ঘ্য স্থাপন। অর্থাৎ মানস-পূজাটি যেন বাহ্যিক পূজার বিধি-আচারের ব্র্যাকেটের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে। দেবীভাগবতে দেবীর স্বকথিত পূজাক্রমের মধ্যেই এর উল্লেখ পাওয়া যাবে।

পূজক কল্পনা করেন— ‘হৃৎপদ্মমাসনং দদ্যাৎ সহস্রারচ্যুতামৃতৈঃ। পাদ্যং চরণয়োর্দদ্যাৎ মনস্ত্বর্ঘ্যং নিবেদয়েৎ॥’ দেবীর আসন হৃদয়কমল। সেখানে দেবীকে স্থাপন করে তাকে স্নানীয়-পানীয় জল হিসেবে দেওয়া হবে ষট্‌চক্রের শেষতম অধোমুখ সহস্রদল পদ্ম বা সহস্রার থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়া অমৃতবিন্দু। এই বার পূজা আরম্ভ হচ্ছে। মন হবে দেবীর অর্ঘ্য। আকাশ-তত্ত্ব দেবীর বস্ত্র, ভূমি গন্ধ, চিত্ত পুষ্প। সাধকের দেহ আর বিশ্ব যেন মিলেমিশে যায় এখানে। জগন্মাতার পোশাক কি পূজকের দেহের ভিতরের আকাশ, নাকি পৃথিবীর আকাশ? এই পূজায় ঘ্রাণ হবে ধূপের প্রকল্প, অন্তর্গত তেজ হবে প্রদীপ, সুধাসমুদ্র হবে ভোগ-নৈবেদ্য। আরতির ঘণ্টাধ্বনি হবে অনাহত নাদ— যে অনাহত ধ্বনিকে কবীরদাস বলেন ‘অনহদ্‌’। কবীর বলছেন, “সুনতা নহী ধুন কি খবর/ অনহদ্‌ কা বাজা বাজতা।” তাঁর ব্যঙ্গ বাইরের দুনিয়া নিয়ে যে মত্ত হয়ে থাকে সেই শ্রোতার প্রতি, যে নিজের ভিতরের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করেনি কোনও দিন। নির্গুণ নিরাকার ভক্তিধারার সন্ত যে ভিতরের শব্দ শুনতে পরামর্শ দিচ্ছেন, সগুণ সাকার দুর্গার আচারমূলক উপাসনার পদ্ধতিতে সেই অনাহত হয়ে উঠছে ঘণ্টাধ্বনি। সেই ঘণ্টা, যাকে বলা হবে সর্ববাদ্যময়ী।

এই আরতিতে ঢাক বাজে না। ভিতরের শব্দই গান, এবং কী আশ্চর্য, ইন্দ্রিয়ের চাঞ্চল্যই নৃত্য! যে ইন্দ্রিয়চপলতাকে সাধারণত পুজো-আচ্চা বা যে কোনও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার বিঘ্নস্বরূপ বলেই মনে করা হয়, তাকেও এখানে বাদ দেওয়া হয়নি, উপাসনার উপচার হিসেবে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। মানস-প্রক্রিয়া হলেও এতে আমাদের বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকা জীবনের কোনও দিকই বর্জনীয় নয়। প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসই এখানে মন্ত্র।

স্মারক বাগানখনি গাছ হ’য়ে আমার ভিতরে

বাউলে বলবে, শরীরের ভিতর শুধু প্রাণ নয়, এই ব্রহ্মাণ্ডের মতো আর একটি ব্রহ্মাণ্ড দিব্যি ঠাঁই করে নেয়। তবে সে তো করণ-কারণের কথা। অত গভীর সাগরে ডুব না দিয়ে এবং নিগূঢ় তত্ত্বভেদ বাদ রেখেও দুটো কথা বলা যায়। দুর্গাপূজায় মানস-যজ্ঞের বিধানে একই সঙ্গে নিজের কাছে ফেরা আর নিজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরের দিকে মেলে ধরা— এই দুয়েরই হদিস আছে। মনের ভিতর এমন অর্চনার প্রতিসাম্যে মনে পড়ে মধ্যকালের শৈব বচনকার বাসবান্নার কথা। কর্নাটকের বীরশৈব ভক্তিধারায় ভক্ত হলেন জঙ্গম, গতিশীল। যেমন গতিশীল তাঁর উপাস্য শিব, বাসবান্না যাঁকে কুডলসঙ্গম প্রভু বলে ডাকেন। এই জঙ্গমতার প্রতিপক্ষে আর সব কিছুই স্থাবর। সেই স্থাবরতার মধ্যে কিন্তু আচারমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেও ধরা হচ্ছে। বাসবান্না একটি বচনে বলছেন, নবনীতা দেব সেনের অনবদ্য অনুবাদে— “যার আছে, সে বানিয়ে দেবে শিবমন্দির/ আমি কি পারি? গরীবদুঃখী মানুষ, প্রভু!/ আমার পা’দুটো থাম, এই দেহটাই নাটমন্দির/ এই মাথাটাই স্বর্ণকলস হোক— / শোনো হে প্রভু কুডলসঙ্গমের/ স্থাবর যা, তা বিনষ্ট হয় বটে/ জঙ্গমের তো বিনাশ নেই জগতে।”

ভাবতে অবাক লাগে যে, শৈব বাসবান্না, নির্গুণপন্থী কবীর, এঁরা ভিতরের দিকে যে-যাত্রার কথা বলেছেন, দেবী দুর্গার তন্ত্র-স্মৃতি নির্ধারিত ‘শাস্ত্রীয়’ অর্চনা-পদ্ধতিতেও তার কেন্দ্রীয় প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসের নিরিখে দেখলে এর মধ্যে অনেক টানাপড়েন কিংবা আদানপ্রদানের সূত্র হয়তো মিলতে পারত, কিন্তু এই শরতে সে কথা না-হয় থাক। মানসপূজার স্তোত্রটি অনেক লম্বা, শেষ দিকে গিয়ে দেখছি কাম-রূপ ছাগল এবং ক্রোধ-রূপ মহিষ বলি দিতে বলা হচ্ছে! আর তার আগেই রয়েছে ফুলের কথা। এই পুজোয় ভাবের ফুল চাই দশটি— অমায়া, অনহঙ্কার, অরাগ, অমদ, অমোহ, অদম্ভ, অদ্বেষ, অক্ষোভ, অমাৎসর্য এবং অলোভ। তার সঙ্গে আরও পাঁচ রকম ফুল চাই— অহিংসা, ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞান, দয়া এবং ক্ষমা। মল্লিকঘাট ফুলের হাটে বোধহয় সে ফুলের দেখা মিলবে না। এই সব ফুল-পাতা সংগ্রহের জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা পড়বে না, বাগানের পর বাগান সাফ হয়েও যাবে না। যা সাফ হবে তা মন-মানসেই হবে। সে জন্য বিশেষ করে এ সময়ের পুজোয় এই সমস্ত ফুল খুব দরকারি বলে মনে হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: পুরোহিত দর্পণ— সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য; বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণোক্ত শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা পদ্ধতি—শ্যামাচরণ ভট্টাচার্য; দুর্গাপূজা পদ্ধতি— অশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়; দেবীভাগবত মহাপুরাণ— হরিচরণ বসু (সম্পাদিত)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy