ন’মাসে মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে শিশু। ধরার বুকে আরও একটি প্রাণের জন্ম হয়। জীবনের সাতাশটি বছর পার করে ঘটনাচক্রে ফের সেই ন’মাসের কালচক্র ফিরে এল। এ বার আমাকে লালন-পালন করতে মাতৃগর্ভের রূপ নিল বিশ্বমাতা। এই ন’মাসে ঘুরেছি তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, চিন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজ়াখস্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। বিশ্বের এই ১২টি দেশের তাক লাগানো সৌন্দর্য, সেখানকার মানুষ, আতিথেয়তা মনের অজানা গলির রুদ্ধদ্বারে কড়া নাড়ল। দরজা খুলতেই উপলব্ধি করলাম, জন্মভূমি পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে প্রান্তিক গ্রাম বুড়দায় যে উষ্ণতা পাই, তার চেয়ে কম কিছু পাইনি এই সফরে। মাতৃজঠরের সুরক্ষার মতোই ধরিত্রীও ঠিক আগলে রাখে। সময়ে খাবার জোগায়, পাশে হাঁটার বন্ধু পাঠায়, ঝড়ের মুখে সামলে নেয়। সাইকেলের দু’চাকায় বিশ্ব ঘোরার সাহস ও শক্তি জোগায়।
আমি অক্ষয় ভগত।
এটা আমার সত্যিকারের গল্প।
দু’চাকাই বন্ধু
একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ঘুম ভাঙল। ওই শব্দেই রোজ ঘুম ভাঙে। সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছেন বাবা। প্রথমে দুধ, তার পরে খবরের কাগজ বিক্রি করতে যাবেন। স্নান-খাওয়া সেরে যাবেন জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে। দিনশেষে মোড়ের মাথায় ছোট্ট টেবিল পেতে বসবেন লটারির টিকিট বিক্রি করতে। স্থায়ী কাজের ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে, ন’টি পেট চালাতে গোটা দিনটাকে এ ভাবেই টুকরো টুকরো কাজে ভাগ করে নিয়েছেন বাবা। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। বাবার সাইকেলটা পরিবারের আর্থিক অবস্থার মতোই জীর্ণ। প্রতিদিন ভোরে ঘুম-জড়ানো চোখে তাতে চেপেই তাঁকে বেরোতে দেখতাম। মনে হত বাবা সাইকেলটায় চেপে বসতেই যেন সেটি কোওন জাদুতে খানিকটা বলিষ্ঠ হয়ে উঠত। ন’জনের সংসারে অন্নদাতার বাহন সে। ক্লাস ফাইভ বা সিক্স তখন। বাবার সাইকেলের প্যাডেল পর্যন্ত পা পৌঁছয় না। তবে বাবার কাঁধে হাত রাখার ইচ্ছা হত। হাফ-প্যাডেলেই শুরু হল যাত্রা। ঘুম-জড়ানো চোখে আমিও বেরোলাম দুধ, কাগজ বিক্রি করতে। কখন যেন হাফ-প্যাডেল আরোহীর বন্ধু হয়ে উঠল সংসারের অন্নদাতার জীর্ণ সাইকেলটা।
ছাপার অক্ষরে পৃথিবী
রেললাইনের পাশে জলাজমি-ঘেঁষা জায়গায় কাশফুলের বন মাথা তুলছে। পুজো আসতে বাকি আর ক’টা দিন। এ বার পুজোয় কে ক’টা জামা কিনবে, কোথায় ঘুরতে যাবে, ক্যাপ-বন্দুক হল কি না, এ সব নিয়ে আলোচনা করছিল বন্ধুরা। আমি সাইকেলটা ধরে দূরে দাঁড়িয়ে কাশফুলের বন দেখছিলাম। প্রতিটি ডাঁটির ডগায় যেন মেঘ নেমে এসেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, এ বার ক’টা পুজোবার্ষিকীর অর্ডার পেয়েছি। পরের দিন সকালে হাতে এল সেগুলো। প্রচ্ছদে দুগ্গাঠাকুরের ছবি। দেবীর টানা-টানা চোখ, ত্রিশূলের ডগায় ধ্বস্ত মহিষাসুর। ইস! একটা বই যদি আমি কিনতে পারতাম! কিনতে না পারি, পড়তে তো পারি। একটা বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। মিশরের পিরামিড নিয়ে লিখেছেন এক লেখক। পড়তে পড়তে হারিয়ে গেলাম ফ্যারাওদের দুনিয়ায়। দু’চোখের সামনে এসে হাজির হল অনন্ত বালিয়াড়ি, সুউচ্চ পিরামিড, সেগুলির ভিতরে লুকিয়ে থাকা হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। পরের দিন পড়লাম আরও এক জনের ভ্রমণ কাহিনি। তার পরের দিন আরও এক জনের। সাইকেল চালাতে চালাতে গোগ্রাসে পড়ছি একের পর এক প্রতিবেদন, গল্প। পরের পুজোয় বাবার কাছে আবদার করলাম একটা পুজোবার্ষিকীর। জামাকাপড় কিচ্ছু চাই না, শুধু একটা পুজোবার্ষিকী।
পালিয়ে পুরী
অ্যাপার্টমেন্টের নীচে বসে মশার কামড় খেতে খেতে বিরক্ত লাগছিল। টাটায় এই অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তারক্ষীর কাজে যোগ দিয়েছি কয়েক দিন আগে। মাধ্যমিকে ভৌতবিজ্ঞানে ৮২, জীবনবিজ্ঞানে ৮০ পাওয়ার পর সায়েন্স নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্লাস ইলেভেনের পরীক্ষার পরে বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করল। পড়ায় আর মন বসল না। বইপত্র ছেড়ে তাই কাজের খোঁজে বেরোই। কিন্তু এই কাজেও যে মন বসে না। ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে জড় বস্তু মনে হয়। এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে যেন হাড়-মজ্জায় মরচে ধরছে।
আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে এক দিন ফোন ঘাঁটছি। পিছন থেকে হঠাৎ এক জন ফোনটা কেড়ে নিলেন। কড়া গলায় বললেন, “কাজের মাঝে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি চলবে না।” অনেক দিন ধরেই চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম, এই ঘটনার পরে মনঃস্থির করে ফেললাম। আই-কার্ড, পোশাক রেখে বেরিয়ে পড়লাম ব্যাগ কাঁধে।
কিন্তু যাব কোথায়? বাড়ি গেলেই তো হাজারো প্রশ্ন ধেয়ে আসবে। এর মধ্যে পোঁ শব্দে সামনে এসে দাঁড়াল একটি ট্রেন। সাত-পাঁচ না ভেবে চেপে পড়ি। নামলাম পুরীতে। সেই প্রথম সমুদ্র দর্শন। সেই প্রথম কাউকে কিছু না বলে একা একা বেরিয়ে পড়া।
দৈত্যাকার ঢেউ যেন আমাকে শোনাল অন্তরের কথা। কান পেতে শুনলাম আমার মন বলছে, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’। পুরী থেকে সোজা গেলাম ঝাড়খণ্ডে বড়দির বাড়িতে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে ঠিক করলাম, এ বার প্রস্তুতি নিতে হবে।
ভারত আমার ভারতবর্ষ
বাড়ি ফেরার পরে গ্রামের লাইব্রেরিতে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত। লাইব্রেরির একটা ঘরেই গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করি। বাকি সময়টা ডুবে থাকতাম বইয়ের জগতে। লাইব্রেরির কোন তাকে কোন বই রয়েছে, সব তখন নখদর্পণে। বাড়ির লোককে তত দিনে বোঝাতে পেরেছি, গতে বাঁধা জীবনে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। বই দু’দণ্ড শান্তি দেয়। বিশ্বের আশ্চর্যের ইতিহাস, ভৌগোলিক কাহিনি জীবনীশক্তি জোগায়। তাঁরাও এক রকম মেনেই নেন। এ বার প্রস্তুতি নেওয়ার পালা। এক দাদার ফোন হাতে পেলেই গুগলে খুঁজে দেখি ভারত থেকে লন্ডনে যাওয়ার রাস্তা, পাসপোর্ট, ভিসা করাতে কী কী লাগে, বিমানের খরচপাতি কত, ইত্যাদি। কিন্তু অত টাকা কোথায়? এক দিন রাস্তার ধারে এক দল রাইডার্সের সঙ্গে দেখা। বাইক নিয়ে বেরিয়েছে তারা। কথা হল অনেক ক্ষণ। তাদের মধ্যে এক জন বলল, সংসারের মায়া কাটিয়ে বেরনোর আগে বিমল মুখোপাধ্যায়ের ‘দু’চাকায় দুনিয়া’ পড়তে। সেই বই তো লাইব্রেরিতে নেই। তবে পিডিএফ ফাইল পেলাম। দিন দুয়েকে ঝড়ের গতিতে পড়ে ফেলি ভারতের প্রথম সাইকেল আরোহী ভূ-পর্যটকের কাহিনি। তিনি পারলে আমি কেন নয়? সাইকেল তো একটা আছেই। তাতে চেপে না-হয় প্রথমে নিজের দেশের রূপই দেখি!
কী ভাবে যেন আমার মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। আসা-যাওয়ার পথে কেউ না কেউ দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী রে, শুনলাম তুই নাকি সাইকেলে করে দেশ ঘুরবি? এমন ভূত কেন হঠাৎ মাথায় চাপল?”—শুনতে হয়েছে আরও বাঁকা কথা। তাতে বরং মনের জোর বেড়েছে আরও। এক-দেড় বছরের মাথায় আমার সেই জোর বাড়তে বাড়তে অযোধ্যা পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে ফেলল। বুঝতে পারল গ্রামের লোকজনও। কয়েক জন পাশে এসে দাঁড়ালেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাস। একটি সাইকেল, একটি মশারি, ম্যাট, ভাঙা মোবাইল আর পকেটে ২২০০ টাকা নিয়ে বেরোলাম এই ভারতের রূপ দেখতে দেখতে। সত্যি বলতে যতই মনের জোর দেখাই না কেন, মনের ভিতরে ভয়ের শিখা মাঝেমধ্যেই দপ করে জ্বলে উঠে প্রশ্ন তুলছিল, ‘পারব তো?’ এখনও মনে আছে, বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে চোখের দু’কূল উপচে পড়েছিল। তবু প্যাডেলে পা রাখলাম। সাইকেলের সঙ্গে অতর্কিতে ঘুরল ভাগ্যের চাকাও। ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, চণ্ডীগড়, হিমাচল, কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, ছত্তীসগঢ় হয়ে নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ফিরি। ৪০১ দিনে কাশ্মীর টু কন্যাকুমারী। রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত, আশ্রম, ধর্মশালা, অচেনা লোকের বাড়ি থেকে শুরু করে শ্মশানে পর্যন্ত রাত কাটিয়েছি। থাকা-খাওয়ার অভাববোধ করতে দেননি ভারতবাসী। বাল্যবিবাহ রোধে নানা নামী-দামি স্কুল, কলেজে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছি। যে ২২০০ টাকা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, বাড়ি ফেরার সময়েও তা পকেটেই ছিল। গ্রামে ফিরে দেখলাম, যারা হাসিঠাট্টা করেছিল, তারাই ফুল-মালা নিয়ে ভারতভ্রমণকারী অক্ষয়কে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে।
টুঁটি চেপে ছিনতাই
কোভিড অতিমারির প্রথম পর্যায়ের পরেও এক বার ভারত ঘুরি। সেই থেকেই বিশ্ব ভ্রমণ করার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ভাবলাম, শুরুটা হোক চাঁদের পাহাড়ের দেশ দিয়ে। শঙ্কর যে পথে আফ্রিকা ঘুরেছিল, সেই পথেই যাব। কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরে অযোধ্যা পাহাড়ের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ট্রেকিং, ক্যাম্পিং করিয়ে টাকা জমাই। বেরিয়ে পড়ি আফ্রিকা ভ্রমণে। ফ্লাইটে করে নির্দিষ্ট একটি গন্তব্যে পৌঁছে পুরোটাই সাইকেলে ঘুরেছি।
পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার মোম্বাসা, যেখানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর রেললাইনের কাজে যোগ দিয়ে প্রথম পা রেখেছিল, সেখানে আমার পা-ও পড়েছে। খুশিতে তখন আমি ডগমগ। সে দেশের মানুষের কোনও ভাষাই সে ভাবে বুঝতে পারছি না, তবু হাত-পায়ের ভঙ্গি আর মুখের হাসি দিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে যাচ্ছে। তাতে উৎসাহ, উদ্দীপনা বাঁধন ছিঁড়েছে। নাইরোবির হটেলে ব্যাগপত্র রেখে একাই বেরিয়ে পড়ি চাল-ডাল কিনতে। দিব্য হাঁটছি, শহর দেখছি, বাজার ঘুরছি। আচমকা একটি বলিষ্ঠ হাত টুঁটি চেপে ধরল। ঘিরে ধরল পাঁচ জন। গলায় ছুরি ধরে ইংরেজিতে বলল, “নড়লেই মরবে। সঙ্গে যা আছে দিয়ে দাও।”
গলায় থাকা রুপোর চেন, দিদির দেওয়া সোনার বজরঙ্গবলীর লকেট, ন’হাজার শিলিং এবং ৬০ হাজার ভারতীয় টাকা ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষান্ত হল তারা। গলার কাছটায় প্রাণটাই যেন দলা হয়ে আটকে ছিল। এর পরে সিঁটিয়ে যাই। বেশ কয়েক দিন হোটেলের ঘরে বন্দি থাকি। এই বিভুঁইয়ে নিজের বলতে নেই কেউ। ফের যদি এমনটা হয়! এক নিরস্ত্র ভারতীয় পর্যটকের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়া এত সহজ? ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়াই। ব্যাগ গোছাই। আর শহরে নয়, গ্রাম ঘুরব। কেনিয়ার গ্রামে ছিলাম ৩০ দিন। ওই টুঁটি চেপে ছিনতাইয়ের ভয় বুদবুদের মতো উবে গিয়েছে গ্রামবাসীর আদর-যত্নে। থাকা-খাওয়া সব তাঁদের বাড়িতেই। সাভানা তৃণভূমির উপর দিয়ে সাইকেল চালানোর সময়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ মনে হচ্ছিল। সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়েছে জ়েব্রা, জিরাফের দল। নীল নদের উৎপত্তিস্থল ভিক্টোরিয়া হ্রদের ধারে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে। তানজানিয়ার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার প্রতীক। মশলা-দ্বীপ জ়াঞ্জিবারে পৌঁছে বাড়ির ফোন পাই। ও পারে থাকা কণ্ঠে শুনি, ‘বড়দি আর নেই’। আকাশে জ্বলজ্বল করা নক্ষত্ররাশি যেন নিভু-নিভু হয়ে আসে।
নতুন জন্ম
কত জন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন, জানা নেই। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়ে সেই আধ্যাত্মিক পথকেই বেছে নিয়েছিলাম। দিদিকে হারিয়ে তখন দিশাহীন। বিষাদ কাটাতে সাইকেল নিয়ে দু’মাস বাংলাদেশ ঘুরি। উদ্দেশ্য ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে সেখানে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরা। সেখানেও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ফেরার দিন আমার গো-প্রো ক্যামেরাটি চুরি যায়। বাড়ি ফিরেও কিছুতেই মন বসে না। চলে যাই বেনারস। সেখান থেকে অযোধ্যা। রামমন্দির উদ্বোধনের তখনও ছ’মাস বাকি। ঠিক করি, অযোধ্যা থেকে রামেশ্বরম, যে পথে রাম বনবাস যাত্রা করেছিলেন সেই পথেই যাব। পায়ে হেঁটে তিন হাজার তিনশো কিলোমিটার পথ পেরিয়েছি। প্রতি পদক্ষেপে ফিরে পেয়েছি হারানো আত্মবিশ্বাস।
বিশ্ব-দরবারে
২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর ঘর ছেড়ে বেরোই। যাব কোথায়? পুরুলিয়া থেকে রাশিয়া। পুঁজি বলতে জমানো কিছু টাকা। সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিই। তাইল্যান্ডের ফ্লাইট বাকিগুলির তুলনায় সস্তা। ও দিক দিয়েই শুরু করি। সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে পেরিয়েছি ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, চিন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজ়াখস্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান। ভিয়েতনামের হ্যানয় স্ট্রিটের রেললাইনের উপরের বাজার দেখেছি, লাওসের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত দেখেছি। এর পরে ত্রিশ দিনের ভিসা নিয়ে চিনে পৌঁছই। বইয়ের পাতায় পড়া চিনের প্রাচীর আমার চোখের সামনে। ইটের পাঁজরে হাজার বছরের ইতিহাসের গন্ধ। ভারতীয়দের মনে চিন নিয়ে নানা বিরূপ ধারণা হয়তো রয়েছে। তবে সে দেশে পা রাখলে সেই ধারণা বদলাতে বাধ্য। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়। উন্নত প্রযুক্তি, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দেশ চিন। সাইকেল চালাতে চালাতে এক দিন হাঁপিয়ে রাস্তায় বসে পড়ি। দু’মিনিট পরে সামনে এসে দাঁড়াল পুলিশের গাড়ি। একটু থমকে গিয়েছিলাম। তবে আমি ক্লান্ত দেখে পুলিশকর্মীরা নিজে গিয়ে জল কিনে আনলেন। নম্বর দিয়ে বললেন, যে কোনও প্রয়োজনে যেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেখানকার রেল ব্যবস্থা আমায় মুগ্ধ করেছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাই সে দেশের মূল সম্পদ। চিন থেকে যাই মঙ্গোলিয়া। ঠান্ডা গোবি মরুভূমিতে সাইকেল চালাচ্ছি, নিজে খাবার বানিয়ে খাচ্ছি ভেবেই শিহরিত হচ্ছিলাম। মঙ্গোলিয়াতে বোধহয় জনসংখ্যার থেকে ঘোড়ার সংখ্যা বেশি।
এই দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রথম বার অসুস্থ হয়ে পড়ি মঙ্গোলিয়া পেরিয়ে রাশিয়ায় পা রেখেই। পথের ধারে পড়ে ছিলাম। পাশ দিয়ে একটি গাড়ি শোঁ করে বেরিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার ফিরে এল। কাচ নামিয়ে এক জন মেয়ে ওদের ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আমিও কিছু বললাম। কিন্তু দু’পক্ষেরই তা বোঝা দায়। মেয়েটি তার ইংরেজি-জানা ভাইকে ফোন করলেন। তিনি আমার ভাষা অনুবাদ করে বোঝালেন। আমার অসুস্থতার কথা জেনে মেয়েটি আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেবা-শুশ্রূষা তো করলেনই, সঙ্গে নিজের নামে কিনে দিলেন একটি সিম-কার্ড। যুদ্ধ চলায় সে দেশে সিম-কার্ড পাওয়া এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া পেরিয়েও সিম-কার্ড মেলে না। নিজে সিম-কার্ড কিনে তা চালু করতে পারিনি। ওই তরুণীই সাহায্য করেন। এর পর সাইবেরিয়া ঘুরে নিজের ভ্রমণসূচির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলি। কিন্তু পিপাসু মনের তৃষ্ণা যে তখনও মেটেনি!
তালিবানের দেশে
কাজ়াখস্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে পা রাখি। দিনটা ছিল ১৫ অগস্ট। পৌঁছেই ভারতের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে উদ্যাপন করি। ঘটনাচক্রে দিনটি তালিবানের জন্যও স্বাধীনতা দিবসের থেকে কম কিছু নয়। ২০২১ সালে ওই দিনেই কাবুল দখল করে তালিবান। সে দেশ বড় অদ্ভুত। বন্দুকই সেখানকার পরিচয়পত্র। বোরখা পরিহিত মেয়েদের চোখ পর্যন্ত দেখা যায় না। মেয়েদের চলাচলেও বেশ কড়াকড়ি। প্রতি চেকপোস্টে রাশিয়ান, আমেরিকান বন্দুকের প্রহরা। মেপেবুঝে চলছি। হঠাৎ এক বন্দুকধারী জিজ্ঞেস করলেন, “কে, কোথা থেকে এসেছ?”
ভারতীয় পরিচয় দিতেই বন্দুকধারীর মুখে স্মিত হাসি। ‘হিন্দুস্তানি’ বলে জড়িয়ে ধরল! মুহূর্তে আরও লোকজন জড়ো হয়ে গেল। তখন তাঁদের দেশের অতিথি আমি। যত দিন ছিলাম তত দিন কারও না কারও বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছি। সে দেশের আফগান রুটির সঙ্গে টোম্যাটোর তরকারির যে কী স্বাদ— তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু সেখানকার মেয়েদের জীবন আমায় ব্যথিত করেছে। মেয়েরা সেখানে বন্দি। শরিয়া আইন তাঁদের পায়ে বেড়ি পরিয়েছে। জীবন, নাকি দাসত্ব? মাঝে মাঝে তাঁদের দেখে মনে জাগত এই প্রশ্ন। মিষ্টি অভিজ্ঞতা তেতো লাগত।
ফাঁকা পকেটে বাড়ি ফিরছি আপাতত। এর পরেও এক বার আফ্রিকা যাওয়ার ইচ্ছা আছে। সে মহাদেশে গিয়ে বুঝেছি, ‘চাঁদের পাহাড়’ বলতে বিভূতিবাবু বোধহয় নির্দিষ্ট পর্বতের কথা বোঝাতে চাননি। হয়তো তিনি ওই দুর্গম যাত্রাপথটিকেই চাঁদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
অনুলিখন: শ্রেয়া কর্মকার
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)