Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘প্রথমেই মনে হয়েছিল, ক্রিকেটের এই লেভেলটায় আমি বিলং করি’

কুড়ি বছর হল। ওই কভার দিয়ে মারা শটটা যখন আমাকে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে দিচ্ছে, আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, ক্রিকেটের এই লেভেলটায় আমি বিলং করি।এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, লর্ডসে আমার জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলার কুড়ি বছর পূর্ণ হয়েছে। যে কোনও মানুষের জীবনেই কুড়ি বছর একটা দীর্ঘ সময়, আর এই কুড়ি বছরে আমার জীবনটাও যে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, লর্ডসে আমার জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলার কুড়ি বছর পূর্ণ হয়েছে। যে কোনও মানুষের জীবনেই কুড়ি বছর একটা দীর্ঘ সময়, আর এই কুড়ি বছরে আমার জীবনটাও যে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আর আইপিএল-এর মধ্যে দিয়ে ক্রিকেট খেলাটাতেই একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ব জুড়ে টেস্ট ক্রিকেটকে চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়েছে এই শর্ট ফর্ম্যাটের ক্রিকেট। আমি নিজে সব ধরনের ক্রিকেটই খেলেছি, কিন্তু গর্বের সঙ্গে বলব, লর্ডস-এ করা ওই টেস্ট সেঞ্চুরিটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত।

আমি আজ যা কিছু, তার শুরুটা হয়েছিল সেই দিন। ২২ জুন ১৯৯৬, লর্ডসের দারুণ এক শনিবারের বিকেলে। লর্ডসে কোনও টেস্ট ম্যাচে শনিবারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। উইকএন্ড তো, একটাও আসন ফাঁকা ছিল না সে দিন। আর চা-বিরতির ঠিক আগেই, ডমিনিক কর্কের একটা পিচ্‌ড-আপ ডেলিভারিতে নেওয়া গোলার মতো একটা কভার ড্রাইভ আমার ক্রিকেট কেরিয়ারের গতিপথ পালটে দিয়েছিল।

বহু মানুষ সে দিনটার কথা, লর্ডসে আমার সেই ইনিংসটার কথা বলেন। কিন্তু আমার কাছে ওই টেস্ট ম্যাচটার আগের দেড় মাসটাই সব, কারণ সেই সময়েই আমার মধ্যে এই বিশ্বাসটা এসেছিল, আমি ক্রিকেটের এই লেভেলেও রান করতে পারি, পারব। ব্রিস্টলের সেই বিকেলটা মনে পড়ে। ডব্লিউ জি গ্রেস-এর স্ট্যাচুর সামনে, ছোট্ট একটা বেঞ্চে বসে আছি, ভারত আর গ্লস্টারশায়ারের একটা ম্যাচ চলছে সামনে। সেটাই মরশুমের প্রথম ম্যাচ, জোনাথন লিউয়িসের বল-এ শূন্য রানে আউট হয়ে, মনখারাপ করে বসে আছি। আমার দাদা, যে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন নিয়ে পড়ত, আমায় ও ভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল। পাশে একটু চুপ করে বসে থেকে বুঝল, আমার মনের অবস্থা খুব খারাপ। হেসে বলল, তুই কিন্তু এখান থেকে আর খারাপ নয়, শুধু ভালই করতে পারিস।

পুরো সিরিজে আমি ওই কথাটা মনে রেখেছিলাম, আর সত্যিই ভাল, আরও ভাল খেলছিলাম। ওই ম্যাচটাতেই সেকেন্ড ইনিংসে ৬৮ নট আউট ছিলাম। ওই তিন মাসে তার পর আর ফিরে তাকাইনি। মরশুম শেষ করেছিলাম ১০০-রও বেশি গড় নিয়ে, এক ‘ইংলিশ সামার’-এ এর থেকে বেশি অ্যাভারেজ ছিল শুধু রঞ্জিত সিংহের। দুর্দান্ত সেই সিরিজটা এখনও আমার স্মৃতিতে ভাসে।

প্রত্যেকটা প্র্যাকটিস ম্যাচেই আমি রান পেয়েছিলাম, তবে ম্যাঞ্চেস্টারে হওয়া একটা ওয়ান-ডে খেলার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, শ্রেষ্ঠ বোলিং অ্যাটাকের বিরুদ্ধেও আমি রান করতে পারি।

উত্তর ইংল্যান্ডের একটা বৃষ্টিভেজা সকাল ছিল সেটা। টস হেরে গিয়ে, ওই ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় ব্যাট করা, সে এক বিরাট কঠিন পরীক্ষা। ঠিক তার আগেই ভয়ংকর একটা আউট-সুইঙ্গারে কর্ক আউট করেছে সচিনকে। আমি যখন ক্রিজে এলাম, উইকেটের পেছনে অ্যালেক স্টুয়ার্ট তক্ষুনি মনে করিয়ে দিল, কর্ক কত বার ব্রায়ান লারাকে আউট করেছে, আমার পক্ষে এই আবহাওয়ায় ওকে খেলা কতটা শক্ত হবে, এই সব। সেই ইনিংসে আমি বেশ লড়লাম, আউট হলাম ৪৬-এ। খুব আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল আমাকে ওই ইনিংসটা। প্লেয়িং কন্ডিশন এত খারাপ ছিল, বলগুলো এত বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল, ব্যাটে নাগাল পাওয়া শক্ত।

এজবাস্টনে প্রথম টেস্ট ম্যাচটার শেষে— যেটা ভারত হেরেছিল— মনে আছে, রিচি বেনো বলেছিলেন, ভারত এই সিরিজে এখনও পর্যন্ত তার টেকনিকালি সেরা ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানকে ছাড়াই খেলছে। আমাকে সেই কথাটা খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল, কারণ আমার টিমমেটরাও ওটা লাইভ শুনেছিল। সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আমি হয়তো টিমে ঢুকব এ বার।

লর্ডসের টেস্ট টিমে আমি নির্বাচিত হলাম। ভারতের প্রথমে ফিল্ড করাটা আমার পক্ষে ভাল হয়েছিল। জানতাম যে আমাকে ব্যাট করতে হবে তিন নম্বরে, তাই টসের আগে একটু নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু ভারত ফিল্ডিং‌য়ের সিদ্ধান্ত নিতে একটু স্বস্তি হল। মনে আছে, বৃহস্পতিবার সকালে আমি যখন লর্ডসের লং রুম-এ হাঁটছি, আমার নার্ভগুলো তখন শান্ত। ইংল্যান্ডের ইনিংসে আমি দুটো উইকেট নিয়েছিলাম, সেটা খুব কাজে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই তো, আমি দুর্দান্ত বল করেছি। শুধু উইকেট পাওয়াটা নয়, আমার মনের ওপর তার প্রভাবটা খুব জরুরি ছিল। মনে হয়েছিল, আমি আমার টিমের কাজে লাগতে পেরেছি।

ব্যাট করতে নামার সময় মনটা তাই অনেক শান্ত ছিল। আর আমি এর আগেও বহু বার বলেছি, লর্ডসের ওই টেস্টটা খেলতে নামার আগে আমার যে মানসিক অবস্থা ছিল, ভারতের হয়ে তার পরে খেলা আরও ১১২টা টেস্টে সেই অবস্থাটা ফিরে পেতে আমাকে কষ্ট করতে হয়েছে। ওই টেস্টে প্রত্যেকটা ডিফেন্সিভ শট খেলে কী যে ভাল লেগেছিল! প্রতিটা বল আমি খেলেছিলাম এই ভেবে, যেন এটাই আমার শেষ বল।

সেই সন্ধের প্রেস কনফারেন্সটা মনে আছে। আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, সমালোচকদের মুখের ওপর জবাব দিতে পারার অনুভূতিটা কেমন।

বিশ্বাস করুন, আমি এক বারও ও রকম ভাবে ভাবিনি।

কভার দিয়ে মারা শটটা যখন আমাকে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে দিচ্ছে, আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, ক্রিকেটের এই লেভেলটায় আমি বিলং করি। আমিও এই লেভেলটায় রান করতে পারি। অন্তত সামনের দশটা বছর আমি এখানে টিকে থাকতে পারব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibashariya Sourav ganguly Lords Cricket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE