Advertisement
E-Paper

লাল জুতো কালো জুতো

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: কাদম্বরী দেবী

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০০:০৩
কাদম্বরী, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত কৌতূহলে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

কাদম্বরী, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত কৌতূহলে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

প্রতিবেদক: শুনেছেন তো, আপনাকে নিয়ে সিনেমা, বেস্টসেলার বই...
কাদম্বরী: না শুনে উপায় আছে? অবশ্য এ বিষয়ে আমার যেটা বলার, সেটা খুবই ছোট একটা বাক্য: আমার আর রবির মধ্যে প্রেম ছিল কি ছিল না, তাতে কার বাবার কী?
প্রতি: ছি ছি, এ কী ভাষা ইউজ করছেন...
কাদম্বরী: ও! তোরা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে, আমাকে আর আমার দেওরকে জড়িয়ে যা খুশি বই লিখতে পারিস, সিন দেখাতে পারিস, বাসে-ট্রামে মুখরোচক আড্ডা দিতে পারিস, আর আমি খ্যারখ্যার করে কথা শোনালেই মনে হয় রুচির বাইরে চলে যাচ্ছি?
প্রতি: না, মানে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির কৌতূহল থাকা তো স্বাভাবিক!
কাদম্বরী: রবীন্দ্রনাথ কেন, রণবীর কপূরকে নিয়েও কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। যে কোনও বিখ্যাত মানুষ কার কার সঙ্গে শুয়েছে আর কার সঙ্গে শুতে পারেনি, তা নিয়ে উদগ্র উৎসাহ পৃথিবীতে সক্কলের। কিন্তু স্বাভাবিক হলেই তো একটা ব্যাপার খুব চমৎকার হয়ে যায় না, তাই না? পায়খানা পাওয়া স্বাভাবিক হলেও আমরা তা সাধারণত রাস্তাঘাটে না করে ফেলে বাড়ি ফেরা অবধি চেপে রাখার চেষ্টা করি।
প্রতি: আপনি শুধু বদ-রুচি দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করছেন কেন, লেখকের লেখা বুঝতেও তো এটা সাহায্য করে!
কাদম্বরী: তাই বুঝি? কী ভাবে করে? টি এস এলিয়ট সমকামী হলে ওয়েস্টল্যান্ডের মানে বদলে যায়, আবার বিষমকামী হলে ওয়েস্টল্যান্ডের মানে অন্য হয়ে যায়?

প্রতি: অতটা হয়তো নয়, কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার তো আরও স্পষ্ট করে বোঝা যায়, মানে, এটা আসলে কেন লিখেছেন, ওটা কেন জুড়েছেন...

কাদম্বরী: তাতে শিল্পটার রস কী করে এক্সট্রা পাওয়া যায়? ধর, রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটা লাল জুতো পরে লিখেছিলেন না কালো জুতো, লেখার সময় তিনি সকালবেলা দক্ষিণের বারান্দায় আরামকেদারায় হেলান দিয়েছিলেন, না সন্ধেবেলা রেড়ির তেলের প্রদীপের সলতে আড়াই বার উসকে চাকরকে পঞ্চাশ পোস্ত আনতে দিয়েছিলেন, সেটা রিসার্চ করে জেনে, ওই কবিতাটার মর্মার্থ আরও ভাল বোঝা যায়?

প্রতি: লাল জুতো কালো জুতোটা তো ফালতু ইয়ে...

কাদম্বরী: কী করে বুঝলি? লাল জুতো পরার প্রভাব ওঁর মানসিকতায় কতটা, কী করে জানবি? ‘পোস্ত আসছে’র প্রসন্নতা ওঁর কাছে যদি প্রেমের চেয়ে বেশি হয়? আচ্ছা, খুব ভাইটাল জিনিসগুলোই ধর। কালিদাস বা বাল্মীকির যৌনতা বা বিরহ সম্পর্কে ডিটেল আমরা পাই না বলে, ব্যাসদেবের ক’টা প্রেমিকা ছিল এবং তিনি তাঁদের নিয়ে পালঙ্কে কোন দিকে মাথা করে শুতেন জানি না বলে, ও-সব কাব্য আমরা অতটা ভাল বুঝতে পারি না? বা, ধরা যাক, যে লোকটা নেরুদার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনেই তাঁর কবিতাটা পড়ছে, সে নেরুদার বায়োগ্রাফি-জান্তা পাঠকের চেয়ে কবিতাটা কম বুঝছে?

প্রতি: হ্যাঁ, কম বুঝছে। মানে, যে জীবনী পড়েছে, সে হয়তো বুঝছে নেরুদা এটা কাকে ভেবে লিখেছিলেন...

কাদম্বরী: আঃ! তাতে রসালো অ্যানেকডোট পাওয়া গেল! কিন্তু কবিতাটা কী করে বেশি বোঝা গেল? এ তো গোটা ব্যাপারটাকে উলটে দেখার চেষ্টা! তোর সামনে একটা কবিতা আছে। তুই তার লাইনগুলো পড়ে, চিত্রকল্পগুলো ভেবে, শব্দগুলো ছেনে, তার ভাবটা, ঘোরটা নেওয়ার চেষ্টা কর। তার বদলে খুঁটতে বসলি, এটা লেখার সময় কবির কার সঙ্গে অ্যাফেয়ার চলছিল? কবিতাটাকে স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে না ধরে, কবিতাটাকে লাস্ট স্টেশন হিসেবে ধরলি? আর ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে জানতে চাইলি, কবিতাটার ফিনিশ্ড প্রোডাক্টটায় কী করে অ্যারাইভ করা গেল! এই শেকড়-গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে কেচ্ছা-শুঁকশুঁকের পার্থক্য কী?

প্রতি: বাঃ, একটা লাইন কবি কেন লিখলেন, সেটাই তো সাহিত্য-বিশ্লেষণ!

কাদম্বরী: না। ‘কেন লিখলেন’ আর্টে কোনও প্রশ্নই নয়। প্রশ্নটা হল, কী লিখলেন। লেখাটা কী বলছে। ধর, এক পরিচালক বললেন, আমার বাবা আমার মা-কে খুব পেটাত। তাই এই সিনটায় নায়ক নায়িকাকে পেটাচ্ছে। শুকনো পণ্ডিত বলবে, ইউরেকা, সোর্স মিল গয়া! কারণ সে শিল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফর্মেশনকে ভাবে, শিল্পের সত্য। আসল সিনেমা-প্রেমী বলবে: আমি দেখব, ছবিতে ওই সিনটা সুপ্রযুক্ত কি? অভিনয় কেমন হয়েছে? ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্সের ব্যবহারটা ভাল? এগুলো ছেড়ে যদি ওই ‘কোন ঘটনা অবলম্বনে’র দিকে মন যায়, সেটা ছবি-বিশ্লেষণ হল না, ফিল্মটাকে উপলক্ষ করে গল্প-গসিপে মন ঢালা হল। এমনকী বাবার মারধরের বাস্তব দৃশ্য থেকেই যদি ওই সিনের সংলাপ ও অভিনয় হুবহু টোকা হয়, তাতেও কিছু এসে যায় না। আসল জিনিস বাবার চড় নয়, নায়কের চড়, যেটা আমাদের সামনে শিল্পটায় ঘটছে। প্রকৃত রসিক ভাববে, চড়টার মধ্যে দিয়ে চরিত্রটার সাহিত্য-ব্যর্থতার জ্বালাটাই কি ফুটে বেরোল? ওই যে দ্বিতীয় সিনে একটা কলেজের মেয়ের দিকে সে তাকিয়ে ছিল টসটস করে, সেই চাউনিটাকে মনে রেখে এর পেছনে কি যৌন হতাশাও খুঁজে পাওয়া যায়? মানে, প্রশ্ন ও ভাবনার উপাদানগুলো আসছে সিনেমাটার মধ্যে থেকে, যেটা দেখানো হচ্ছে শোনানো হচ্ছে, তা থেকে। সেগুলোই সিনেমাটাকে ধারণ করে রেখেছে। অন্য সব মগজবাজির অধিকার ও দাপানি সিনেমাটার বাইরে।

প্রতি: কেন বাইরে? শিল্পের হয়ে-ওঠা’টা তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কেন নয়? সেটা খুঁজতে চাওয়া...

কাদম্বরী: একটা ভয়্যারিজ্ম আসলে। ওতে এক-আধটা অবান্তর খুঁটিনাটির ব্যাখ্যা হয়, প্রাণভোমরার হয় না। মংপুতে লেখা বলে কবিতাটায় পাহাড় এসেছে, তা জেনে ‘তাই তো!’ জাগে, কবিতাটাকে আদর করার ক্ষমতাটা বাড়ে না। ‘নষ্টনীড়’ আমাকে নিয়ে লেখা কি না, তা জানলে পাঠক চারুর বেদনা বেশি বুঝবে না। আর, শিল্পের ‘হয়ে-ওঠা’র ব্লুপ্রিন্ট বের করার সাধ্যি পৃথিবীতে কারও নেই। ধর, রবি একটা লেখা শুরু করল আমাকে ভেবেই। পরের দু’লাইনের মধ্যেই কখন এসে গেল অন্য নারী, বা স্রেফ ‘নারী’র আইডিয়া। আবার ছন্দের, মিলের, মানে টেকনিকের দায়ে, কখনও স্রেফ ন্যাকামি বর্জনের জন্য, বা যতটা লেখা হয়েছে তার ইনার্শিয়ার তোড়ে, ও হয়তো যেটা চাইছে তার উলটো লিখল! ইমেজগুলো বেঁকে গেল! লেখার প্রক্রিয়া এগজ্যাক্টলি কী, কোন ঘটনা থেকে কোন চৈতন্যপ্রবাহ এসে লেখককে অ্যাটাক করছে, কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব? কবির নিজের পক্ষে সম্ভব? একটা লাইন লিখে কোনও বাপের ব্যাটা হলফ করে বলতে পারবে এগজ্যাক্টলি এটা কেন লিখল? এর মধ্যে ক’পার্সেন্ট শৈশব-ট্রমা, কতটা ভণ্ড ক্ষমা? ‘আমূল’ লিখল হয়তো অবচেতনে মাখনের স্বাদ চায় বলে! তা ছাড়া, কবি তো ‘ক’-র সঙ্গে পেল্লায় প্রণয়ের সময়ও ‘খ’ সম্পর্কে লালা-ঝরঝর পেন নিয়ে কবিতা লিখতে পারে। বা, অসম্ভব খ্যাঁচা মন নিয়ে, তিনটে বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা সইতে সইতে, স্রেফ সম্পাদককে কথা দেওয়া আছে বলে কারুক্ষমতা বাগিয়ে একটা অপরূপ প্রেমের কবিতা বানাতে পারে। উঁকিবাজ পণ্ডিত সেগুলো বুঝবে কী করে?

প্রতি: ইস, ইন্টারভিউটা সিরিয়াস হয়ে গেল, কেউ পড়বে না!

কাদম্বরী: সে আমি জানি। সবাই সিক্রেট চুমুর বিবরণ এক্সপেক্ট করেছিল। আরে বাবা, আমাকে না জিজ্ঞেস করে আমার সুইসাইড নোট বেচছিস, এটুকু রিভেঞ্জ নেব না!

kadambari devi chandril bhattacharya rabindranath tagore film book
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy