Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: সূর্য

গরম বাড়েনি, নালিশ বেড়েছে

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: সূর্য

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

প্রতিবেদক: আপনাকে তো লোকে বলছে এসি কোম্পানির দালাল!

সূর্য: কেন!

প্রতি: কেন মানে? কিছু দিন আগেও এসি ছিল বড়লোকের বিলাসিতা। কিন্তু আপনি ভোল্টেজ অ্যায়সা বাড়িয়ে দিলেন, হুহু করে এসি বিক্কিরি হচ্ছে, এই ঠান্ডা মেশিন হয়ে যাচ্ছে আলুর চেয়ে বেশি কম্পালসরি। গরিব লোকে উপোস করে এসি কিনছে।

সূর্য: তা এত দিন তো আমায় ছাতা কোম্পানির দালাল বলিসনি! আমার জন্যেই তো যুগে যুগে বিক্কিরি হয়েছে জুতো সানগ্লাস টুপি। ভিজে গামছা। এখন এসি-র দাম বেশি বলে অমনি পুঁজিবাদের অ্যাঙ্গল!

প্রতি: এত দিন তো এই লেভেলে আগুন বর্ষাতেন না!

সূর্য: কে বললে? পৌরাণিক কাল থেকে অ্যাদ্দিনের পূর্ণ ডেটা তোর কাছে আছে? যে রোদ্দুর আমি অর্জুনের ঘাড়ে, বেহুলার মাথায়, চাঁদ সদাগরের চাঁদিতে ছুড়েছি, তা সম্পর্কে তোর ধারণা আছে? যে রোদ্দুর কাঁধে নিয়ে গাঁয়ের লোক লাঠালাঠি করে পরস্পরের মাথা ফাটাত, বা ঝোপে লুকিয়ে পরকীয়া করত, বা সেই পরকীয়া ধরা পড়লে গাধায় চাপিয়ে ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে গ্রামছাড়া করত, তুই কল্পনা করতে পারবি না।

প্রতি: তা তারা সানস্ট্রোক হয়ে মরত না?

সূর্য: না। কারণ ওরা তোদের মতো তুসু-পার্টি ছিল না। ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাব, তার পর সূর্যদেবের কুচ্ছো গাব, এই মেন্টালিটিই ওদের ছিল না। তখন লোকের তোদের মতো এত বোর লাগত না, এত চট করে সমাজ সম্পর্কে গরগরে লেকচার গজাত না, দড়াম করে ধৈর্যের টিনের দরজা ভেঙে যেত না। তোদের প্রো-অ্যাক্টিভ নালিশবাজি, পার্মানেন্ট বিরক্তি, ফেশিয়াল ফুঁড়ে ফেলিয়োর: এ সব অকল্পনীয় ছিল। আনন্দিত হওয়া মানুষের একটা সচেতন কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, এটার অনুশীলন একটা জরুরি অভ্যাস, এ রকমটা ভাবা হত। তখন পাতি কেরানি হাতি কিনতে চাইত না। রোববার মাংস হলেই খুশি থাকত।

প্রতি: মানে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না।

সূর্য: না রে গাধা, ইএমআই ছিল না। ইএমআই যে প্রবণতাটা হাড়ে সেঁধিয়ে দেয়, সেই জায়ান্ট নোলা-সকসক ছিল না। উদ্ভট লোভের তালে কোটি কোটি বামন চাঁদ ধরতে কোরাসে লাফাচ্ছে, এ স্ল্যাপস্টিক বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েনি। মানুষকে তো মেনে নিতেও শিখতে হয়। সূর্য প্রবল হয়েছে বলে সারা িদন কাঁইকাঁই কমপ্লেন করব কেন? একটু ছায়ায় দাঁড়াব। অনেক ক্ষণ ধরে ঘাম মুছব। বাড়ি এসে খালি গায়ে ছাদে বসে বসে হাওয়া খাব।

প্রতি: ছাদে তো টিভি নেই!

সূর্য: এই তো। তোরা সারা ক্ষণ ডিউটি দিচ্ছিস! আসলে কিন্তু হোয়াট্‌সঅ্যাপে চুটকিটা তক্ষুনি ফরওয়ার্ড করা তোর ডিউটি না। শাহরুখের লেটেস্ট ছবির ফার্স্ট লুক-টা দেখে ফেলা তোর ডিউটি না। কিন্তু তোরা এখন শ্বাস নেওয়ার মতোই, মার্কেটে ‘ইন’ থাকাটাকেও একটা বায়োলজিকাল নেসেসিটি ভেবে নিয়েছিস!

প্রতি: আগেকার লোক কিস্যু আবিষ্কার করতে পারেনি বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়িতে বসে স্লো মোশনে ঘামাচি চুলকোত, সেটাকে যে গ্লোরিফাই করে— সে সেকেলে, গোঁড়া, এবং ভাবনাচিন্তায় ঢ্যাঁড়শ। পৌরাণিক মানুষেরও প্রকাণ্ড বোর লাগত, কিন্তু তারা আইপিএল ভেবে বের করতে পারেনি। একটা সিনেমা হল-কে আমরা খণ্ড খণ্ড করে পঁচিশটা করে ফেলেছি, রক্তবীজের মতো। সঙ্গে চিজ পপকর্ন। মানুষের সেরা শত্রু বোরডমকে এক মোবাইলে আশি গোলে হারাচ্ছি!

সূর্য: ধুস! ‘মানুষের সেরা শত্রু বোরডম’— এই ধারণাটাই মানুষের সেরা শত্রু! শান্তিতে বসে চাউমিন খেতে পারছিস না, কোঁত করে তিন গ্রাস গিলেই তক্ষুনি ছবিটা আপলোড করে লিখতে হচ্ছে তুই সুখী, বাথরুমে গিয়ে ইয়ের ছবি আপলোড করে স্মাইলি দিয়ে লিখতে হচ্ছে ফিলিং আনকনস্টিপেটেড, সারা দিন নিজ জীবনের রানিং কমেন্ট্রি করে যেতে হচ্ছে গোটা পৃথিবীর কাছে, মানে সমস্ত জাগ্রত মুহূর্ত নিজের আন্ডারেই অফিস করছিস, টানা টেনশনে ভুগছিস, ক’টা লোক তোকে গ্রহণ করবে, ক’টা লোক তোর বন্ধুত্বকামী হবে, নিজেকে এক সেকেন্ডও চুপ বসে খুশকি খোঁটবার ফুরসত দিচ্ছিস না, এটা তোদের জিত? তা হলে হার কাকে বলে? ঘুম থেকে উঠেই সেল্‌ফি-রেডি, চুল আঁচড়ে পিচুটি মুছে! এত কীসের হট্টমেলায় আয়নাবাজির দায়? এত কীসের ইনসিকিয়োরিটি?

প্রতি: আরে! আমাদের খ্যামতা আছে, দম আছে, তাই সারা দিন হাজার লোকের সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়ে মস্তি করছি। সকালে উঠে সেল্‌ফিস্নিগ্ধ হওয়ার বদলে প্যান্তাখ্যাচাং ঢুলুনি, আর সন্ধেয় কোমরের কষি সরিয়ে পোষা দাদে চারানা দিয়ে অল্প চাপ দেওয়া— এটা একটা জীবন? ছি!

সূর্য: আমি বরং দাদ চুলকোনোটাকেই নম্বর দেব। ওটার মধ্যে তবু একটা ‘স্ব’ আছে। নিজেকে নিয়ে বুঁদ হওয়া আছে।

প্রতি: হোয়াট্‌স সো গ্রেট অ্যাবাউট স্ব?

সূর্য: গ্রেট হচ্ছে, দাদওলা লোকটা নিজেকে ভালবাসার জন্য অন্যের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল নয়। ঈশ্বর একটা সহজ রেলা দিয়ে আমাদের পাঠিয়েছেন। সে সেটাকে ডেলি উদ্‌যাপন করছে।

প্রতি: ভুল করছে। অন্যের চোখেই মানুষ বড় বা ছোট হয়। নিজেকে নিজে খুব পিঠ চাপড়ে বসে থাকা গাড়লের কাজ। আসলে আপনার এই ‘স্লো হ, চৌত্রিশ বার থুতনি চুলকো’, এগুলো হচ্ছে কুঁড়ের যুক্তি। নার্সিসাসের যুক্তি। আত্মপরতার চেয়ে পর-আত্মতা সব সময় ভাল। কিন্তু এই কথাগুলো উঠছে কেন? প্রশ্নটা তো, গরম বাড়ল কী জন্য?

সূর্য: উত্তরও এটাই। গরম বাড়েনি, তোদের চুলকুনি বেড়েছে। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে বালক আপনমনে ছাদে ঘুরে বেড়ায়, গরম নিয়ে কোনও নালিশই করে না। কারণ সে বিস্মিত হতে জানে। আর তার মা খাটে শুয়ে, ঘর অন্ধকার করে, পাখা চালিয়ে, সারা ক্ষণ প্লিচ প্লিচ করে।

প্রতি: বুদ্ধদেব বসু প্লিচ প্লিচ লিখেছিলেন?

সূর্য: আহা, সবটা কি মনে আছে? ওই গোছের লিখেছিলেন। তাও তো বুদ্ধদেব কোট করছি রে। ইয়ো ইয়ো হানি সিং না।

প্রতি: অ্যাই। ব্যাপারটা আসলে উলটো। বুদ্ধদেব বসুর যুগ চলে গেছে বলে, মানুষ বদলে গেছে বলে, সে নিজের মতো একশোটা ফুর্তির উপায় খুঁজে বের করে ফেলেছে বলে, আপনার মতো একটা আগুনের পিন্ডিকে পুজো করে কোনারকের মন্দির গড়ে সময় বিতাচ্ছে না বলে, আপনি রেগে কাঁই। আপনার পছন্দসই কাল তার তাবৎ ধর্ম নিয়ে ভাগলবা, এটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারছেন না। তাই চাঁইচাঁই টেম্পারেচার বাড়ছে। আমাদের নয়, আপনার বিরক্তির দিকে মন দিন। আপনার ক্ষমাশীলতা ও সহনশীলতা বাড়ান। তাইলেই সব ঠিক থাকবে।

সূর্য: কী বললি? যে লোকটার জন্যে এই গোটা সৌরজগৎটা চলছে, তাকে তুই জাস্ট একটা নির্দিষ্ট গ্রহের নির্দিষ্ট যুগের নির্দিষ্ট প্রাণীর মূল্যবোধের ওপর খেপে গিয়ে নিজের ধর্ম থেকে চ্যুত হওয়ার ইলজাম দিলি! আমি তোদের অগাধ প্রশ্রয় না দিলে তোদের অস্তিত্ব থাকত? তোদের অকথ্য বিন্দাসতা— যা প্রাণকে সম্মান না করে অবান্তরতাকে মাথায় তোলে— তা ক্ষমা না করলে কবে পুড়িয়ে ঝামা করতাম না?

প্রতি: আরে ছাড়ুন! কিস্যু আপনার হাতে না। নেচারের আইন অনুযায়ী যা হওয়ার, তাই হবে। প্লেন হিংসে আপনার, কারণ আপনি ডুবে যাওয়ার পর ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ শুরু হয়, আপনি দেখতে পান না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE