Advertisement
E-Paper

বিয়েবাড়িতে সানাই বেজে উঠেছে তাঁর মুখে

কালবৈশাখীর ঝড় থেকে বাউলের গান, বাঘ-সিংহ-ঝিঁঝিপোকার ডাক থেকে ট্রেন-ট্যাক্সির আওয়াজ, সবই প্রাণ পায় শুভেন্দু বিশ্বাস-এর গলায়। হরবোলা শিল্প বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর। হঠাৎ চারদিকে ঝড়ের শব্দ। ধীরে ধীরে সেই ঝড় যেন বাড়তে থাকল। গুরুগুরু রবে মেঘ ডাকা শুরু হল এক সময়। আর তার পরেই বৃষ্টি নামল ফোঁটায় ফোঁটায়। সেও বাড়তে বাড়তে এক সময় অঝোর বৃষ্টি। 

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
অনুশীলন: রবিবারের সকালে বাড়িতে ছাত্রদের শেখাচ্ছেন শুভেন্দু বিশ্বাস

অনুশীলন: রবিবারের সকালে বাড়িতে ছাত্রদের শেখাচ্ছেন শুভেন্দু বিশ্বাস

বৈশাখের গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। পাড়ার জলসায় মুখ্য আকর্ষণ যিনি, সেই কিশোরকণ্ঠী শিল্পী তখনও এসে পৌঁছননি। ঘোষক বারবার বলছেন, অধৈর্য হবেন না, কিন্তু গরমের মধ্যে অপেক্ষা করাটাও একটা শাস্তি। তাই অনেকেই উঠব উঠব করছেন। তখনই মঞ্চে এলেন শুভেন্দু বিশ্বাস। সূচি অনুযায়ী তাঁর হরবোলার অনুষ্ঠান ছিল একেবারে শেষে। কিন্তু প্রধান শিল্পীর দেরি দেখে তাঁকেই মঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শুভেন্দুবাবুকে মঞ্চে উঠতে দেখে দর্শক আরও ক্ষিপ্ত। কোথায় কিশোরকণ্ঠীর গলায় ‘মেরে সপনো কি রানি’ শুনতে এসেছেন তাঁরা, তার জায়গায় কিনা শুনতে হবে কুকুর-বেড়ালের ডাক?

হঠাৎ চারদিকে ঝড়ের শব্দ। ধীরে ধীরে সেই ঝড় যেন বাড়তে থাকল। গুরুগুরু রবে মেঘ ডাকা শুরু হল এক সময়। আর তার পরেই বৃষ্টি নামল ফোঁটায় ফোঁটায়। সেও বাড়তে বাড়তে এক সময় অঝোর বৃষ্টি।

সত্যিই বৃষ্টি নেমেছে না কি? দর্শকরা আকাশের দিকে তাকালেন। কই, আকাশে তো মেঘের ছিটেফোঁটা নেই! দর্শকরা অবাক হয়ে দেখলেন, ঝড়বৃষ্টি নেমেছে শুভেন্দুবাবুর গলায়। ঝড়ের আওয়াজই যেন এই গরমে দর্শকদের শরীর-মন ঠান্ডা করে দিল।

সে দিন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে কিন্তু সত্যিই ঝড়বৃষ্টি নেমেছিল, জানালেন শুভেন্দুবাবু। বরানগরের নিজের বাড়িতে বসে বলছিলেন, কুকুরের ডাক ডাকলে পাড়ার কুকুর চিৎকার করে উত্তর দেয়। এক অনুষ্ঠানে কুকুরের ডাক ডাকার পরে পাড়ার কুকুরগুলো এমন চিৎকার শুরু করেছিল যে অনুষ্ঠানই বাতিল হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। কাকের আওয়াজ করলে কাকেরাও জড়ো হয়ে যায়। তা বলে ঝড়ের আওয়াজ করে ঝড় নামানো? সে অবশ্য নিতান্ত কাকতালীয়, রবিবারের সকালে তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় বসে হেসে জানালেন আশি ছুঁই-ছুঁই শুভেন্দুবাবু: ‘‘ঝড়ের আওয়াজ করে ঝড়বৃষ্টি নামাতে পারি না। সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু এখনও সকালে উঠে অনুশীলনের সময় কাকের আওয়াজ করে দেখি আশপাশের কাক তার জবাব দিচ্ছে কি না। যদি কাক সাড়া না দেয়, মন খারাপ হয়ে যায়। আশঙ্কা হয়, তা হলে কি হরবোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি?’’

রবিবারের সকালে শুভেন্দুবাবুর ঘরে নানান বয়সের মানুষ। বাড়িতেই খুলেছেন হরবোলা অ্যাকাডেমি। সেই অ্যাকাডেমিতে হরবোলার শিল্প শিখতে এসেছেন সপ্তম শ্রেণির স্কুলপড়ুয়া থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আইটি কোম্পানিতে চাকরি করা যুবকও। আছেন তাঁর নিজের ছেলে শীর্ষেন্দু বিশ্বাসও। সবাইকে শেখানোর ফাঁকেই শুভেন্দুবাবু বলেন, “এই শিল্পটা তো মরে যাচ্ছে। তবু ভাল লাগে যখন দেখি, এত মানুষ রবিবার সকালে আমার কাছে হরবোলা শিখতে আসছেন। মনে হয়, কিছু মানুষকে তো শিখিয়ে যেতে পারব এই শিল্পের কারিকুরি। ওরাই হয়তো এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় হরবোলা শোনানোর জন্য ডাক পেয়েছেন শুভেন্দুবাবু। ঘুরেছেন জাপান, কানাডা, বাংলাদেশ। দেশের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বললেন, ‘‘কানাডা, জাপানে আমি ওখানকার দর্শকদের হরবোলার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছি।’’ সে কী ভাবে? জানালেন, শব্দের মাধ্যমেই পুরো শান্তিনিকেতন ভ্রমণ। প্রথমে প্লেনে করে পর্যটক নামলেন দমদম স্টেশনে। তার পর ট্যাক্সি নিয়ে যানজট পেরিয়ে হাওড়া স্টেশন। স্টেশন থেকে স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেনে চেপে দর্শকদের নিয়ে বোলপুর স্টেশন। সেখানে নেমে রিকশায় শান্তিনিকেতনের হোটেলে। ফের রিকশায় করে শান্তিনিকেতনের গ্রামে ঘোরার সময় বাউলের গান। বিকেলে হঠাৎ নামল কালবৈশাখীর ঝড়। রাতে হোটেলে ফিরতেই বৃষ্টি, তার শব্দ। শেষে শান্তিনিকেতনের মধ্যরাতে ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ, গ্রাম-বাংলার ব্যাঙের ডাক। প্লেনের শব্দ থেকে ট্রেন, ট্যাক্সি, রিকশা, ঝিঁঝিঁপোকা, মেঘ— সবই হরবোলার মাধ্যমে শোনানো। হরবোলার ফাঁকে ফাঁকে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরেছি।” প্রায় আশি বছর বয়সে বুকে পেসমেকার নিয়েও এখনও টানা অনুষ্ঠান করে যেতে পারেন তিনি। তবু আক্ষেপ, “এক সময় পুরস্কার, স্বীকৃতি সবই পেয়েছি। কিন্তু এখন আর কে ডাকবে আমাকে? মানুষ তো হরবোলাকে ভুলেই গিয়েছে।’’

অনেক মধুর স্মৃতি-মাখা ঘটনা শুভেন্দুবাবুর ঝুলিতে। আশির দশকের শেষ, এক বিয়েবাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন। যাঁদের বাড়িতে বিয়ে, তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল নয়। সানাইবাদক আনার আর্থিক সঙ্গতি নেই। সব দেখেশুনে কনের বাবার মুখে হাসি ফোটাতে শুভেন্দুবাবু মুখে শব্দ করেই সানাই বাজাতে শুরু করলেন। বিয়েবাড়ির অতিথিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন সেই সানাই। প্রতিবেশীরা তো অবাক, সানাইবাদক এলেন কোথা থেকে! কনের বাবার আর্শীবাদ ও ভালবাসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সে দিন।

১৯৮২ সালে ঘাটশিলায় মান্না দে-র জলসার অনুষ্ঠানে তাঁর গানের পরে শুভেন্দুবাবুর হরবোলার অনুষ্ঠান। কিন্তু অত বড় শিল্পীর গানের পরে হরবোলা কে শুনবে? সবাই বাড়ির পথ ধরেছেন। ভাঙা হাটে এমন সময় শোনা গেল কোকিলের ডাক। এত রাতে কোথায় ডাকছে কোকিল? শ্রোতারা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, স্টেজে কোকিল হয়ে সুর তুলেছেন হরবোলা শুভেন্দু। তার পর একে একে দোয়েল, ঘুঘু থেকে শুরু করে আরও কত কী ফুটিয়ে তুললেন হরবোলার মাধ্যমে। যারা বাড়ির পথ ধরেছিলেন, তাঁরা থমকে গেলেন। হরবোলা শুনে মান্না দে-ও মঞ্চে উঠে প্রশংসা করেছিলেন। শুভেন্দুবাবু পরে মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠান করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।

কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন তিনি। তাঁর গুরু হরবোলা রবীন ভট্টাচার্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর নাম দিয়েছিলেন হরবোলা। রবীনবাবু ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ এক দিন ক্লাস নিচ্ছেন, কিছুটা দূরে এক গাছের তলায় বসে বালক রবীন পাখির ডাক ডেকে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়ায় এক ছাত্রকে দিয়ে তিনি রবীনকে ডেকে পাঠান। তাকে বলেন আবার এক বার পাখির ডাক শোনাতে। বালক রবীন পাখির ডাক শোনাতে রবীন্দ্রনাথ একটা সাদা পাতায় তাঁকে লিখে দেন ‘হরবোলা রবীন ভট্টাচার্য’।

এক সময় সিনেমায়, যাত্রাতে নেপথ্যশিল্পী হিসাবে কাজ পেতেন হরবোলারা। শিকারিরাও হরবোলা সঙ্গে নিয়ে যেতেন। টিভিতেও হরবোলার অনুষ্ঠান হত। এখন কাজ কমে গিয়েছে অনেক। অনুষ্ঠানেও ডাক আসে না তেমন। তবু এই শিল্পকে ভালবেসে মাঝেমধ্যেই তিনি চলে যান বনজঙ্গলে। নতুন কোনও পাখির ডাক শুনলে তা নকল করার চেষ্টা করেন। চিড়িয়াখানা গিয়ে বাঘ, সিংহ, নানান পশুপাখির ডাক রেকর্ড করে আনেন। বাড়িতে চর্চা করেন, ভুল হচ্ছে কি না দেখেন।

সত্যজিৎ রায়ের ‘সুজন হরবোলা’ গল্পে হরবোলা সুজন মন জয় করেছিল এক রাজকন্যার। শুভেন্দুবাবু বলেন, “রূপকথার গল্পের সেই হরবোলার কদর বাস্তবে নেই। শিল্পটাই হয়তো এক দিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হরবোলা শিল্পীরাই তখন রূপকথার চরিত্র হয়ে যাবেন।’’

Mimicry Artist Mimicker
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy