ভারতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার শুরু ঔপনিবেশিক যুগে। এই প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের প্রথম পরিচালক আলেকজ়ান্ডার কানিংহামের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই আদি সময়ে পুরাতাত্ত্বিক প্রায় সবাই ছিলেন ইউরোপীয়। প্রাচীন বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক বলতে আমরা বুঝি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ননীগোপাল মজুমদার প্রমুখের কথা, কিন্তু আমরা ভুলে গেছি পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে, যিনি সম্ভবত প্রথম বাঙালি পুরাতাত্ত্বিক।
পূর্ণচন্দ্র ১৮৯৯ সালে লুম্বিনীতে বুদ্ধের জন্মস্থান ‘মায়াদেবী মন্দির’ খনন করে সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। তখন তরাই অঞ্চল ছিল অতি দুর্গম স্থান, সেখানে ছিল ম্যালেরিয়ার ও বন্যপ্রাণীর রাজত্ব। তখনও সেই অঞ্চলের উপযুক্ত মানচিত্রও ছিল না, আর নেপাল সরকার বাইরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে ছিলেন সন্দেহপ্রবণ। পূর্ণচন্দ্রকে সেই সময়ের এক নামী প্রাচ্যবিদ ড. ওয়াডেলের সঙ্গে কাজ করার জন্য মাত্র দু’মাসের জন্যে পাঠানো হলেও, ছয় সপ্তাহের মধ্যেই তিনি অসাধ্যসাধন করেন।
কখনও হাতির পিঠে, বেশির ভাগ সময়ে পায়ে হেঁটে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় ঘুরেছিলেন পূর্ণচন্দ্র। এক বার বাঘের মুখোমুখি হয়েও কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচেছিলেন। প্রথমে কোন ড্রাফটসম্যানও সঙ্গে দেওয়া হয়নি, যখন ড্রাফটসম্যান পেয়েছিলেন তখন অভিযান শেষের পথে। সবচেয়ে কঠিন প্রতিবন্ধক ছিলেন অভিযানের নেতা ওয়াডেল নিজে, যিনি পদে পদে পূর্ণচন্দ্রকে বাধা দিয়েছিলেন। মাত্র দু’মাসের কাজের মধ্যেও তাঁকে একাধিক বার ভারতে ডেকে নিয়ে এসে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছিল। লোকবল নেই, সময় অপ্রতুল, দুর্গম এলাকা, উপরওয়ালার অসহযোগিতা সত্ত্বেও তাঁকে থামানো যায়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি লুম্বিনী খনন করে বুদ্ধের জন্মস্থানকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কপিলাবস্তু হিসেবে তিলৌরাকোটকে শনাক্ত করেছিলেন এবং সাগরওয়াতে পূর্ববর্তী খননে নষ্ট হয়ে যাওয়া স্থাপত্যগুলির বর্ণনা শুনে শুনে এঁকে নিয়ে এসেছিলেন।
পূর্ণচন্দ্রের মুকুটে আরও অনেক পালক আছে, যার মধ্যে অন্যতম পটনায় খনন করে পাটলিপুত্র নগরী ও সম্রাট অশোকের প্রাসাদ আবিষ্কার। পূর্ণচন্দ্র ১৮৯৭ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে কুমরাহার, চমন তালাও, লশকরি বিবি টিলা, বাঁকিপুর রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে একটি ধ্বংসস্তূপ, বুলন্দবাগ-সহ কয়েকটি জায়গায় খনন চালান। লশকরি বিবি টিলায় তিনি একটি কাঁচা মাটির স্তূপের অবশিষ্টাংশ খুঁজে পান, যা পরে ইট দিয়ে মজবুত করা হয়েছিল। অন্যান্য জায়গাতেও তিনি বিভিন্ন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীর, মেঝে আর নিকাশি নালার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। চমন তালাওয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকে খাড়া ভাবে খননের পর তিনি একাধিক নির্মাণ পর্যায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পান। কল্লু পোখরার দক্ষিণ তীরে তিনি একটা বিশাল কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ খনন করেন, যা ছিল সম্ভবত একটা বিহার বা রাজপ্রাসাদ।
পূর্ণচন্দ্রের জীবন চলচ্চিত্রকেও হার মানায়। সামান্য কারণে কর্মক্ষেত্রে বার বার বঞ্চিত হয়েছেন, কালো চামড়ার জন্যে একাধিক বার বরখাস্ত হয়েছেন, দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তবু হার মানেননি। যত বার মনে হয়েছে যে, মানুষটিকে বোধহয় শেষ করা ফেলা গেছে, তত বারই নতুন কোনও আবিষ্কারের ঝলমলে আলো গায়ে মেখে তিনি নতুন ভাবে ফিরে এসেছিলেন।
১৮৪৯ সালের ১৯ জুন পানিহাটিতে তাঁর জন্ম। বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় আর মা প্রসন্নময়ী দেবী। গত বছরই ১৭৫তম জন্মবার্ষিকী পূর্ণ হয়েছে তাঁর। পূর্ণচন্দ্রের পড়াশোনা শুরু হয় আগরপাড়া ক্রিশ্চান স্কুল থেকে। সেখানে তাঁকে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্যে মনোনীত না করায় তিনি আজকের সোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৮৬৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরের বছরে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পারিবারিক অভাবের কারণে ডাক্তারি পড়ায় ইতি টানতে হয়েছিল। সেই বছরের শেষেই তাঁর বিবাহ হয় ছোট জাগুলিয়ার হরমোহন চক্রবর্তী কাঞ্জিলালের কন্যা রক্ষাকালী দেবীর সঙ্গে। কিছু দিন সাহিত্যচর্চা করেছিলেন। ১৮৭৬ সালে তাঁর নিজের উদ্যোগে ‘ভারতীয়ম্’ কাব্যের প্রথম সর্গ প্রকাশিত হয়েছিল, যার ছত্রে ছত্রে ছিল ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের যন্ত্রণার কথা।
এমন তেজস্বী মানুষটির চেহারা কিন্তু ছিল বেশ সাদাসিধে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যার বর্ণনায় পাই, “অতি সাদাসিধে, খর্ব্বকায়, দীর্ঘশিখাধারী পূর্ণবাবু দেখিতে শুষ্ক ও শীর্ণ ছিলেন। খুব ঝাঁঝাল ও স্বাধীনচেতা ছিলেন।” তিনি নিজের হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ পরিচয়ের জন্যে গর্ববোধ করতেন। সাহিত্য রচনা তিনি বেশি দিন না করলেও তাঁর আরও তিনটি শখের বিষয়ে জানা যায়। প্রথমটি হল ছবি আঁকা। তিনি সেকালের বোম্বের আর্ট স্কুল থেকে আঁকা শিখে এসেছিলেন। তাঁর বইতে অসাধারণ সব ছবি এঁকেছেন তিনি। তাঁর দ্বিতীয় শখটি হল গান গাওয়া। পূর্ণবাবুর তৃতীয় শখটি ছিল প্রেতচর্চা। তাঁর প্রেতচর্চার সঙ্গী ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নরেন্দ্রনাথ সেন ও রাজকৃষ্ণ মিত্র। তিনি যুক্ত ছিলেন থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে। পূর্ণচন্দ্রের প্রথম লেখা সোসাইটির মুখপত্র ‘দি থিয়োসফিস্ট’-এর বিষয়বস্তু ছিল সম্মোহন, মন্ত্রশক্তি বা অতিলৌকিক কার্যকলাপ।
পূর্ণচন্দ্র ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ লখনউ এসেছিলেন। সেখানকার ক্যানিং কলেজ থেকে তিনি ফাইন আর্টস-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ১৮৭৩ সালে তিনি বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। তিনি অওধ-রোহিলাখণ্ড রেলওয়ের চাকরি নিয়ে লখনউ এসেছিলেন, কিন্তু মাত্র ছ’মাস সে কাজ করার পর যোগদান করেন লখনউ জাদুঘরে। লখনউ জাদুঘরে থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে বোম্বেতে স্যর জামসেদজি জিজিবয় স্কুল অব আর্ট-এ ছবি আঁকা শিখতে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত দশ বছর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রফেসর ছিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর বাবা লকউড কিপলিং। রুডইয়ার্ডের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা ছিল সেই আর্ট কলেজের ক্যাম্পাসে। তাঁর ‘কিম’ উপন্যাসের একটি চরিত্র হল হরিচন্দ্র মুখার্জি। হরিচন্দ্র ছিলেন এক জন বাঙালি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ব্রিটিশ সরকারের হয়ে ভারতে কাজ করেন। ঊনবিংশ শতকে মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্রিটিশ ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে চলা গোপন প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে তাঁকে চিত্রিত করেছিলেন কিপলিং। অনেকের মতে এই হরিচন্দ্র মুখার্জি সম্ভবত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ই।
বোম্বে থেকে আঁকা শিখে এসে পূর্ণচন্দ্র লখনউ জাদুঘরে কাজ করতে শুরু করেন। লখনউ জুড়েই রয়েছে নবাবদের অসাধারণ সব স্থাপত্য। তখনও দু’দশকও হয়নি সিপাহী বিদ্রোহের আঁচে পুড়েছে লখনউ, সেখানকার স্থাপত্যগুলির মধ্যে অনেকগুলির অবস্থা তখন ভাল নয়। সেগুলি দেখে তাঁর শিল্পীমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাঁর স্বদেশপ্রীতি। তিনি হাত লাগিয়েছিলেন এক মহান কাজে যার ফলস্বরূপ লেখা হল, ‘পিকটোরিয়াল লখনউ: হিস্টরি, পিপল অ্যান্ড আর্কিটেকচার’। বইতে শুধু ইতিহাস নেই, সঙ্গে আছেন সাধারণ মানুষ, তাঁদের জীবনযাপন আর আছে ছবি। লখনউ নিয়ে এই বই প্রকাশ হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। এই বইয়ের মধ্যেও পূর্ণচন্দ্রের স্বদেশধারণার ছবি পাওয়া যায়। সিপাহিদের বিদ্রোহ তাঁকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, তাই তাঁর কলম থেকে আগুন ঝরল— “যদিও সমগ্র আওধ ব্রিটিশদের অন্যায় লোভে ক্ষুব্ধ ছিল এবং আত্মশাসনের অধিকারের জন্য প্রাণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, রাজা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা দমন করে কোম্পানির কঠোর আদেশ মেনে নেন।” সিপাহি বিদ্রোহের কয়েক বছর পর তার এক প্রাণকেন্দ্র লখনউতে বসে পূর্ণচন্দ্র লিখেছিলেন, সেই বিদ্রোহ ছিল বহু বছর ধরে চলে আসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভুখা মানুষদের বিদ্রোহ।
এহেন ব্যক্তিকে সহ্য করা যে ইংরেজ রাজের পক্ষে কতটা কষ্টকর হতে পারে, তা আজ আমরা অনুমানও করতে পারব না, কারণ সেই ঔপনিবেশিক সময়কে আমাদের কল্পনার পরিসরে আনা অসম্ভব। কিন্তু সব সাহেব এমন ছিলেন না। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর এবং অযোধ্যার প্রধান কমিশনার স্যর আলফ্রেড লায়েল পূর্ণচন্দ্রকে একাধিক বার সাহায্য করেছিলেন।
লখনউ জাদুঘরের রিপোর্টে দেখেছি যে, পূর্ণচন্দ্র ১৮৮৩-৮৪ সালে বুন্দেলখণ্ড থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মূর্তি সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তিনি তখন পুরোদস্তুর প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে নিয়োজিত। শুরুতে মাত্র ১১০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হলেও কাজের জন্যে, ২০০ টাকা বেতনের মাস্টার ড্রাফটসম্যান পদে তাঁর পদোন্নতি ঘটে। ১৮৮৫ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যালয়িস অ্যান্টন ফিউরারকে লখনউ জাদুঘরের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন লায়েল সাহেব। পূর্ণচন্দ্র হলেন তাঁর সহকারী। এর আগে কোনও ভারতীয় ব্যক্তি এই পদে পৌঁছতে পারেননি। পূর্ণচন্দ্রের মধ্যে যেমন নিরলস কাজ করার ক্ষমতা ছিল, তেমনই ছিল আঁকার দক্ষতা ও অসাধারণ ইংরেজিতে রিপোর্ট লেখার ক্ষমতা। কিন্তু ১৮৮৫ সালে ঘটে গেল এক অঘটন। আলেকজ়ান্ডার কানিংহামের অবসর গ্রহণের পর তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে জেমস বার্জেস সর্বেক্ষণের নতুন পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি এসেই পূর্ণচন্দ্রের নিয়োগ বাতিল করে তাঁর জায়গায় এডমন্ড উইলিয়াম স্মিথকে বেছে নেন। তবে লখনউ জাদুঘরের চাকরিটি গেলেও লায়েল তাঁকে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও অযোধ্যার পূর্ত বিভাগে আবার নিয়ে এসেছিলেন।
পূর্ত বিভাগে ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৮ অবধি শুধুমাত্র তৎকালীন ঝাঁসি জেলার ললিতপুর মহকুমার প্রাচীন স্থাপত্য, প্রত্নতত্ত্ব ও ভবনের সমীক্ষা করার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছিল পূর্ণচন্দ্রকে। তাঁর সেই কাজের ফল ‘অ্যান্টিকুইটিজ় ইন দ্য ডিসট্রিক্ট অব ললিতপুর’ নামে প্রকাশ হল ১৮৯৯ সালে।
১৮৮৮ সালে ললিতপুরের উপরে সমীক্ষার কাজ শেষ হল আর পূর্ণচন্দ্রের চাকরি গেল। তিনি তখন ছিলেন আগরায়। পূর্ণচন্দ্রের ধারণা ছিল, যে তাঁর আগের বড়কর্তা ড. ফিউরার কলকাঠি নেড়ে পূর্ত বিভাগে তাঁর এই চাকরিটি স্থায়ী করতে দেননি। এই সময় ১৮৯০ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৮৯১ সালে তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছিলেন টিটাগড়ের তালপুকুর নিবাসী কীর্তিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা নলিনী দেবীকে। এমন সময়ে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার লাটসাহেব স্যর চার্লস আলফ্রেড এলিয়ট। তিনি কলকাতার জাদুঘরের ট্রাস্টিদের বলে পূর্ণচন্দ্রকে জাদুঘরের অস্থায়ী পুরাতত্ত্বাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করার বন্দোবস্ত করিয়েছিলেন, আর তাঁর বেতনও আসত বঙ্গ সরকারের গ্রান্ট থেকে। সে হল ১৮৯২ সালের ঘটনা। তাঁকে মূলত বিহার থেকে ব্রডলি সংগ্রহের ভাস্কর্যগুলিকে কলকাতায় নিয়ে আসার কাজ দেওয়া হয়েছিল, এর সঙ্গে তিনি ওড়িশার প্রত্নস্থল নিয়েও কাজ করেছিলেন। তিনি বালি সরিয়ে কোনারকের মন্দিরের বিখ্যাত চাকার প্রায় অর্ধেকটি উন্মুক্ত করেছিলেন, আর মন্দিরের ভিত্তির অনেকটাই পরিষ্কার করেছিলেন।
এর পর পূর্ণচন্দ্রের জীবনের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের কয়েকটি নতুন পাতা যুক্ত হয়েছিল। তাঁর হাতে লুম্বিনী ও পাটলিপুত্রের ধ্বংসস্তূপ খনন এবং তার মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাসের সব যুগান্তকারী আবিষ্কারের কাহিনি তো অনেকেই পড়েছেন। বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মুখেও তিনি বিরাট এক অভিযান ও অনুসন্ধান করে একাধিক উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থল আবিষ্কার করেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল লুম্বিনী। যদিও তিলৌরাকোট আবিষ্কার, নিগলিওয়াতে ফিউরারের জালিয়াতি ধরা এবং সাগরওয়ার লুপ্ত নকশা উদ্ধার প্রত্নজগতে এক-একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তাঁর অনুসন্ধানের রিপোর্ট ‘আ রিপোর্ট অন আ ট্যুর অব এক্সপ্লোরেশন অব দ্য অ্যান্টিকুইটিজ় ইন তরাই, নেপাল: দ্য রিজিয়ন অব কপিলাবস্তু, ডিউরিং ফেব্রুয়ারি অ্যান্ড মার্চ, ১৮৯৯’ প্রকাশিত হল ১৯০১ সালে।
বইটির দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলেন ভিনসেন্ট স্মিথ। সেখানে তিনি লিখেছেন, “অভিযানে যে সব অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সে সব রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে এবং রাস্তার সব বাধা আর সময়ের অপ্রতুলতা বিচার করে আমার মনে হয় যে মি. মুখার্জি খুব ভাল কাজ করেছেন। সমস্ত ব্যবহারিক কাজ-কর্মের জন্যে তাঁর মানচিত্র (প্লেট ১) বেশ নির্ভুল ও মূল্যবান। যে সব অঞ্চলে অন্বেষণ চালানো হয়েছিল তার অধিকাংশ মুক্ত অঞ্চল, যেখানে একজন অভিযাত্রী একটি হাতির পিঠে চড়ে মাইলের পর মাইল ঘুরে দেখতে পারেন। মানচিত্রে জঙ্গলের সীমানাও দেখানো হয়েছে। বর্ণিত প্রত্নক্ষেত্রগুলির বেশ কয়েকটিতেই আমি একাধিক বার ঘুরে এসেছি আর তাই মোটামুটি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে মি. মুখার্জির কাজ যথাযথ।”
স্মিথের ভূমিকা-সহ পূর্ণচন্দ্রের লুম্বিনী ও কপিলাবস্তু আবিষ্কারের বইটি প্রকাশ হওয়ার পরে তাঁর নাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘প্রবাসী’র ১৩০৯ বঙ্গাব্দের একটি সংখ্যায় অক্ষয়কুমার মৈত্র, পূর্ণচন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া আলোকচিত্র ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘কপিলাবস্তু’ ও ‘পাটলিপুত্র’ নামে দু’টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ওই একই বছরে পূর্ণচন্দ্র ‘কলিকাতা পুরাদ্রব্যালয়’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
ইতিহাসবিদ উপিন্দর সিংহ বলেছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করা ভারতীয় ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন— রাম রাজ, পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র। যাঁদের মধ্যে একমাত্র পূর্ণচন্দ্রই ছিলেন পুরোদস্তুর পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদ। তাঁর প্রতিভা বহু ক্ষেত্রেই পশ্চিমি সাহেবদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে তাঁকে পদে পদে অত্যাচার সইতে হয়েছিল।
নেপালের কাজ শেষ করে পূর্ণচন্দ্র আরও অনেকগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি চম্পারণ, দারভাঙা, গয়া, শাহবাদ আর পটনা জেলায় অনুসন্ধান করে আসেন এবং অনেকগুলি অভিলেখের অনুলিপি নিয়ে এসেছিলেন। ছুটির পর তিনি অনুসন্ধানের জন্যে ভ্রমণ করেছিলেন ভাগলপুর জেলা, বর্ধমান ডিভিশন আর বালেশ্বর জেলা। তার পর তিনি চলে এলেন কলকাতায়। ১৯০২ সালের ১৩ মার্চ তিনি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের মহাপরিচালকের দফতরে ড্রাফটসম্যান হিসেবে যোগদান করেন। ওই একই বছরে তিনি বেঙ্গল সার্কলের প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষক থিয়োডর ব্লখ-এর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে তাঁর পুরনো পদে আবার ফিরে আসেন। ব্লখের রিপোর্টের জন্যে ছবির কারণে তাঁকে রোহতাসগড়, মুণ্ডেশ্বরী মন্দির এবং চৈনপুরে পাঠানো হয়েছিল। ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লখের সঙ্গে কাজ সেরে তিনি কলকাতা ফেরেন আর তার পর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্যে তিনি অসম, চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, যশোর, খুলনা, বর্ধমান, মেদিনীপুর জেলার অনেকগুলি স্থানে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট অনুসন্ধান করেছিলেন।
জীবনের শেষভাগে তাঁর সম্পূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মধ্যে অনেকগুলির গুরুত্ব বেশ উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় গয়ার গদাধর মন্দির থেকে আবিষ্কার করা একটি অভিলেখের কথা। চব্বিশ পরগনায় তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা জটার দেউলে তিনি গিয়েছিলেন এবং সেখানে খননের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলের ভিতরে থাকা ভরতগড় ও বিঞ্ছেলি বাড়িও তিনি ঘুরে এসেছিলেন। নদিয়ায় নবদ্বীপের বল্লাল ঢিপি ও বল্লাল দিঘি নামে দুই স্থানে তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন। এ ছাড়া শান্তিপুর, পালপাড়া, চাকদহ ছিল তাঁর অনুসন্ধানের ক্ষেত্র। যশোরের মাহমুদপুরে তিনি বিস্তারিত অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন এবং সেখানে একটি কৃষ্ণমন্দিরের বৃত্তাকার অভিলেখের সন্ধান পেয়েছিলেন। বর্ধমানে তাঁর অনুসন্ধান মূলত ছিল কালনায়, আর মেদিনীপুরে ছিল তমলুকে। এর পর তাঁকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে পাঠানো হয়েছিল ওড়িশার (তখনকার কটক জেলা) রত্নগিরি, উদয়গিরি ও ললিতগিরি। এই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কাজ। তাঁর এই কাজের রিপোর্টও সম্ভবত আর প্রকাশিত হয়নি।
১৯০৩ সালের ৪ অগস্ট রাত্রি তিনটের সময় (সূর্যোদয়ের আগে, বাংলা সনের হিসাবে তাই আগের দিন, ১৩১০ সনের ১৮ শ্রাবণ তারিখে) রক্ত আমাশয় রোগে মৃত্যু হয় তাঁর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫৩ বছর। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাহায্যে আজকের প্রত্নতত্ত্ব অনেক বলীয়ান, কিন্তু ভারতের প্রত্নতত্ত্বের সূচনাপর্বে যে সব মানুষ আমাদের ইতিহাসকে খুঁজে বার করতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তাঁকে বিস্মৃত হওয়া বাঙালির পক্ষে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)