E-Paper

রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধের শিহরন কলমে ধরেন দুই বাঙালি

ভীরু বলে যাতে বাঙালির বদনাম না হয়, তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার চিকিৎসক কল্যাণকুমার মুখোপাধ্যায় এবং চিকিৎসাকর্মী শিশির সর্বাধিকারী। একশো বছরেরও বেশি আগে মাকে লেখা চিঠি আর ব্যক্তিগত রোজনামচায় তাঁরা ধরে রেখেছিলেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিবরণ, ইতিহাসের বিস্মৃত দলিল। সে বিবরণ বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসও কম রোমাঞ্চকর ছিল না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫৮
যুদ্ধচিত্র: অটোমান তুর্কি সেনাপতি খলিল পাশার কাছে আত্মসমর্পণের পর মেজর জেনারেল টাউনসেন্ড ও অন্য পদাধিকারীরা।

যুদ্ধচিত্র: অটোমান তুর্কি সেনাপতি খলিল পাশার কাছে আত্মসমর্পণের পর মেজর জেনারেল টাউনসেন্ড ও অন্য পদাধিকারীরা।

এক বাঙালি চিকিৎসক, আর এক বাঙালি চিকিৎসাকর্মী। দু’জনেই কলকাতার বাসিন্দা। আজ থেকে ১১১ বছর আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির আবহে এঁরা গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। মাসের পর মাস যুদ্ধের ভয়াবহতা আর হিংস্রতার মধ্যে কেটেছে তাঁদের। ক্যাপ্টেন কল্যাণকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের অফিসার এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্যতম চিকিৎসক। আর শিশির সর্বাধিকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কোর’-এর সদ্য যুবা এক চিকিৎসাকর্মী। ঘটনাচক্রে দু’জনেরই গন্তব্য ছিল তৎকালীন মেসোপটেমিয়া বা ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্র।

যতই যুদ্ধভীরু, কোমলস্বভাব বলে বাঙালির দুর্নাম থাক, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে বহু বাঙালির যোগ দেওয়ার নজির রয়েছে। সে দিক থেকে কল্যাণকুমার বা শিশির ব্যতিক্রম নন। কিন্তু তাঁরা অনন্য অন্য কারণে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের কলমে তাঁরা তুলে ধরেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাত্যহিক, চোখে দেখা বিবরণ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় তা ইতিহাসের অমূল্য দলিলে পরিণত হয়েছে। সেই সময়ের দুই বাঙালির হাতে লেখা আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধের বিবরণ, সমাজ ও মানবিক সম্পর্কের এমন বিস্তারিত আখ্যান দুর্লভ।

দু’জনেই কিন্তু লিখেছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে, বাইরের কাউকে জানানোর বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁদের ছিল না। কল্যাণকুমারের লেখাগুলি ছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁর মাকে লেখা অজস্র চিঠি। আর শিশির লিখেছিলেন ডায়েরি। ১৯১৭ সালে উত্তর ইরাকের রাস-আল-আইনের এক যুদ্ধবন্দি শিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ‘স্ক্রাব টাইফাস’ রোগে আক্রান্ত হয়ে চৌত্রিশ বছর বয়সে চিকিৎসক কল্যাণকুমারের মৃত্যু হয়। এর ১১ বছর বাদে১৯২৮ সালে তাঁর ৮৫ বছরের দিদিমা মোক্ষদা দেবীর উদ্যোগে চিঠিগুলি একত্রিত করে বই আকারে প্রকাশ করেন কল্যাণের মামা ব্যারিস্টার সতীশচন্দ্র। ৫৫০ পাতার সেই বইয়ের নাম দেওয়া হয়, ‘কল্যাণ-প্রদীপ’।

শিশির সর্বাধিকারী যুদ্ধে বেঁচে যান। প্রায় চল্লিশ বছর পরে ১৯৫৮ সালে তাঁর পুত্রবধূ রমোলা সর্বাধিকারীর আগ্রহে ও অনুরোধে তাঁর ডায়েরিটি ২০৯ পাতার বই হয়ে প্রকাশিত হয়। নাম, ‘আভি লে বাগদাদ’। কিন্তু ইতিহাসবিমুখ বাঙালির দুর্ভাগ্য, দু’টি বই-ই রয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অন্ধকারে। পৃথিবীর হাতে-গোনা কিছু গ্রন্থাগারে দুষ্প্রাপ্য বইদু’টির কপি পাওয়া যায়। ইতিহাস ও গবেষণাপ্রেমী কিছু পাঠক তা পড়ে আজও বিস্মিত ও মুগ্ধ হন, যেমন হয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষ। দু’টি বই নিয়েই সবিস্তারে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সমাজমাধ্যমে লেখালিখিও রয়েছে। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হয়ে চলেছে রক্তক্ষয়ী সব হামলা। এই অশান্ত পরিবেশে ওল্টানো যাক একশো বছরেরও বেশি আগে দুই সাহসী বাঙালির লেখা যুদ্ধবর্ণনার পাতা।

দিদিমা মোক্ষদার স্মৃতিচর্চায় কল্যাণকুমার

‘কল্যাণ প্রদীপ’ বইয়ের ভূমিকার প্রথম ক’টি লাইনে মোক্ষদা দেবী লিখেছেন— “যে যায়, সে আর ফেরে না। আমার অনেক স্নেহে মানুষ করা ‘কল্যাণ কুমার’ যে ফিরিবে না, তা জানি। জানি বলিয়াই এই বৃদ্ধ বয়সে, রুগ্ন দেহে ও কম্পিতহস্তে লেখনী ধরিয়াছি— পাছে আমার মনের কথা মনেই থাকিয়া যায়, দু’চার কথা যা বলিবার, তা বলা হয় না। গত ইউরোপীয় বা জগৎজোড়া যুদ্ধে এমন ঘর ছিল না, যেখান থেকে একটি না একটি জ্বলন্ত প্রদীপ তারার মতো খসিয়া পড়ে নাই। এই মৃত্যুময় জগতে মানুষ তবে কেমন করে বুক বাঁধিয়া আছে, কেমন করে কোমর বাঁধিয়া কাজ করিতেছে, এটাই খুব আশ্চর্যের বিষয় নয় কি?”

মোক্ষদা দেবী ছিলেন কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবারের মহিলা। সে যুগে লেখালিখিতে নাম করেছিলেন। তাঁর বাবা গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হাইকোর্টের বিখ্যাত অ্যাটর্নি। স্বামী শশীভূষণ মুখোপাধ্যায় হাইকোর্টের উকিল, ভাগলপুরে প্র্যাকটিস করতেন। ১৮৬৪ সালে মোক্ষদার বড় মেয়ে বিনোদিনীর জন্ম। উদার, শিক্ষিত পরিবেশে বড় হওয়া। মেয়েকে ন’বছর বয়সে মণ্ডলঘাটের ঘোষাল বংশের ষোলো বছরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন হিন্দুমতে। কিন্তু বিয়ের দশ দিনের মাথায় টাইফয়েডে স্বামীর মৃত্যু হয়, বিনোদিনী ভাগলপুরে বাপের বাড়ি ফিরে যান। বাড়িতে মেমসাহেব আসতেন তাঁকে পড়াতে, ইংরেজি-অঙ্কে ছিলেন তুখোড়। তাঁর পরিবার বিধবাবিবাহের সমর্থক ছিল, ফলে আত্মীয়স্বজনের অনেকের আপত্তি ও ‘একঘরে’ করার হুমকি সত্ত্বেও ছেলে খোঁজা শুরু হয়। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দুর্গামোহন দাশের ঘটকালিতে পঞ্চদশী বিনোদিনীর সঙ্গে ব্যান্ডেলের বাসিন্দা, বিপত্নীক, বছর সাতাশের ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ব্রাহ্মমতে বিয়ে হয় ১৮৭২ সালে। ভাগলপুরের মামাবাড়িতেই কল্যাণকুমারের জন্ম, ১৮৮২ সালের ২৪ অক্টোবর।

গর্ভাবস্থার আট মাসে অতি রুগ্ণ অবস্থায় জন্মেছিলেন কল্যাণ। বিনোদিনী তখন খুবই অসুস্থ, ফলে মায়ের দুধ খেতে পারেননি। দিন-দিন শিশু রোগা হতে থাকে, গলার স্বরও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কাঁদারও ক্ষমতা ছিল না। মোক্ষদা দেবী লিখেছেন, “এক ডাক্তারের পরামর্শে কল্যাণকে গাধার দুধে একটু জল মিশিয়ে খাওয়ানো শুরু হল। তাতে তার শরীর বলিষ্ঠ হয়ে উঠল।” বিনোদিনীর সব ছেলেমেয়ের মধ্যে কল্যাণ ছিলেন তাঁর প্রাণ, আর কল্যাণও মা বলতে অজ্ঞান।

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস ও যুদ্ধে যোগদান

১৯০৬-এ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেন কল্যাণ। নীলরতন সরকার খুবই ভালবাসতেন তাঁকে। ডাক্তারি করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে অনেক জায়গায় নিয়ে যেতেন। মোক্ষদা জানিয়েছেন, ডাকাবুকো ও মিশুকে ছিলেন তাঁর নাতি। বরাবরই বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। মোক্ষদার নিকটাত্মীয়দের বেশ ক’জন তখন লন্ডনে, ফলে কল্যাণের থাকার সমস্যা ছিল না। বিলেতে যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে থাকলেন কল্যাণ। নীলরতন সরকার স্থানীয় এক রাজার কার্বাঙ্কল অপারেশন করেছিলেন, রাজার ক্ষতে রোজ ড্রেসিংয়ের কাজ করে ক্রমশ তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন কল্যাণ। সেরে উঠে রাজা খুশি হয়ে ন’শো টাকা উপহার দেন। তাতে বিলেত যাওয়ার সুরাহা হয়। ১৯০৭ সালের জুনে কল্যাণ জাহাজে চড়ে বসেন।

১৯১০-এ ইংল্যান্ডে ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস’ (আইএমএস) পরীক্ষায় পাশ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ডাক্তার হন তিনি। ছ’মাস ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণের পর মাইনে হয় সে যুগে চারশো টাকা! অক্টোবরে দেশে ফেরেন, সঙ্গে পোষ্য, ‘রাইজানা’ নামের এক কুকুর। কলকাতায় মায়ের কাছেই তাঁকে রেখে দেন। তিন মাস কলকাতায় থাকার পর তাঁর বদলি হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কোহাট-এ। ১৯১৪ সালে কোচবিহার রাজবংশের মেয়ে বিভাবতীর সঙ্গে বিয়ে হয় কল্যাণের। বদলি হন চুঁচুড়ায়, গঙ্গার ধারে বাড়ি ভাড়া নেন।

সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। ১৯১৪-র সেপ্টেম্বর নাগাদ সেনাবাহিনীর গোপন বার্তা এল, “তুরস্ক জার্মানির সঙ্গে মিলেছে বলে ইংল্যান্ডকে তুরস্কের সঙ্গে মেসোপটেমিয়ায় লড়াই করতে হবে।”

পারস্য উপসাগরকে ইংরেজদের দখলে রেখে তার উত্তর উপকূলে তুরস্কের বসরায় শিবির করে যুদ্ধ হবে তুরস্কের সঙ্গে। কোহাটে এর আগে যত অফিসার ছিলেন, প্রত্যেককে করাচি থেকে বসরা যেতে হবে বলে জানানো হল। টেলিগ্রাম এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

আত্মীয়-বন্ধুরা অনেকেই যুদ্ধে যেতে বারণ করলেন, চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পরামর্শ দিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত কল্যাণ উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি কুণো হয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকলে সমস্ত বাঙালি জাতিকে ভিরু, কাপুরুষ, নেমকহারামের বদনাম সইতে হবে। আমাদের জাতের এমনিতেই সে বদনাম আছে। আমার একটা প্রাণের জন্য ইজ্জৎ খোয়াবো! তার থেকে গলায় দড়ি দিয়ে কড়িকাঠ থেকে ঝুলে পড়া উচিৎ।”

নভেম্বরে কল্যাণের কন্যার জন্ম। তখন তিনি সেনাবাহিনীর কাজে বিদেশে। নাম রাখা হল বিনতা। ১৯১৫-র জানুয়ারিতে কল্যাণ ও তাঁর বন্ধু, পঞ্জাবি চিকিৎসক ডক্টর পুরী কলকাতায় এলেন। মোক্ষদার লেখায়, “তাহারা কেবলই যুদ্ধে যাইবার জোগাড়যন্ত্রের ব্যাপারে কলিকাতার মিলিটারি অঞ্চলে ঘুরিয়া বেড়াইত।” ১০ মার্চ পুরী আবার কোহাট থেকে কলকাতায় এলেন। তিনি ও কল্যাণ দিনের অধিকাংশ সময় কলকাতার কেল্লায় (ফোর্ট উইলিয়াম) কাটাতেন।

১৩ মার্চ সেনাবাহিনীর টেলিগ্রাম এল, “যে যেমন আছ, সেই অবস্থায় বেরিয়ে পড়ো।” পুরী ও কল্যাণ ১৩ মার্চ সন্ধ্যার ট্রেনে আগরা রওনা হলেন। এক সপ্তাহ বাদে সেখান থেকে করাচি পৌঁছে কল্যাণ তাঁর মাকে প্রথম চিঠি লেখেন, “দেশি-বিদেশি সব সৈন্য এসে পড়েছে। কী ভয়ানক কাজে যাচ্ছি, সেটা বোধহয় আমাদের থেকে বেশি পশুরা বুঝতে পারছে। যে খচ্চরগুলোকে মাল বওয়ার জন্য বসরায় নিয়ে যাওয়া হবে, তারা কিছুতেই জাহাজে উঠতে চাইছে না। শুয়ে পড়ে সামনের পা দু’টো লম্বা করে দিয়ে কাতর চিৎকার করছে। তাদের চার পায়ে দড়ি বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে জাহাজে তোলা হচ্ছে। আজকের মতো ‘গুডবাই’। আগামীকাল আমাদের জাহাজ করাচি ছাড়বে। এক সপ্তাহ লাগবে পৌঁছতে। ভেবো না। বসরায় পৌঁছে চিঠি লিখব।”

যুদ্ধকালীন চিঠিচাপাটি শুরু

‘আরব্য রজনী’র বসরার সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের বসরার মারাত্মক পার্থক্যে প্রথমেই ধাক্কা খেয়েছিলেন তরুণ চিকিৎসক। মাকে চিঠিতে লেখেন, বসরার কাদায় কেমন একটা আঠা-আঠা ভাব। রাস্তার দু’ধারে, ডোবার পাশে শুধু খেজুর গাছ। ম্যালেরিয়া আর মশার বিরাম নেই। যে বসরা খলিফা হারুন-অল-রশিদের গোলাপ বাগানোর জন্য বিখ্যাত ছিল, তার চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। অতি পুরনো শহর। এমন কোনও ভাল বাড়ি নেই, যেখানে ভদ্রলোকেরা থাকতে পারেন।

যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশদেরই দায়ী করে কল্যাণ লিখছেন, এই যুদ্ধ কুড়ি বছর চললেও তিনি অবাক হবেন না। কারণ, সাম্রাজ্যবাদের পথে হেঁটে একের পর এক দেশ দখল করে ব্রিটিশরাই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, “প্যাট্রিয়াটিজ়ম! পরের দেশ কেড়ে নিচ্ছি। হাজার হাজার লোক মেরে এক টুকরো জমি কেড়ে নিয়ে স্বদেশ প্রেম, স্বজাতি প্রেম, ইংরেজই শিখিয়েছে।... যতদিন এই সঙ্কীর্ণতা থাকবে, ততদিন প্যাট্রিয়াটিজ়মের নামে রক্তপাত থামবে না। গত এক বছরে এই যুদ্ধে প্রায় ১ কোটি লোক মরেছে বা আহত হয়েছে। আরও এক কোটি পরিবার প্রিয়জনের পথ চেয়ে মরমে মরছে। সেলফিস ন্যাশনালিজ়ম, আ মোস্ট ইনহিউম্যান সেন্টিমেন্ট।”

যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর আহত সিপাইদের সেবার জন্য বাংলায় তৈরি হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কোর’। যুদ্ধের ভয়াবহতা না বুঝেই অল্পবয়সি বাঙালি ছেলেরা সেখানে নাম লিখিয়েছিল আর এসে পড়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। নিতান্ত অল্পবয়সি সেই ছেলেদের অসহায়তার কথাও উঠে এসেছে কল্যাণের চিঠিতে। ১০ অক্টোবর তিনি লিখেছেন, “৩২ জন ছেলে ৫টি স্ট্রেচার নিয়ে আমাদের সঙ্গে মার্চ করছিল। বেচারারা এই ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যস্তই নয়। তাদের চোখ ও নাক দিয়ে জল পড়ছিল। সাহেবদের ধমক খেতে হয়, কার্যত কুলির কাজ করতে হয়, পছন্দের খাবার পায় না, তার উপর রোদে ২০ মাইল হাঁটতে হয়। বেশিরভাগই এখন বলে, ‘এ রকম আগে জানলে আসতাম না।’ যখন ওরা বলেছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্রে বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কর্প পাঠাবে তখনই আমি জানতাম যে, এই বাচ্চারা বুঝতে পারছে না যে, তারা কী করতে যাচ্ছে।”

প্রসঙ্গত, এই স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসাকর্মীদের দলেই ছিলেন কলকাতার ছেলে শিশির সর্বাধিকারী। তাঁর সঙ্গে রণক্ষেত্রে একাধিক বার দেখা হয় ক্যাপ্টেন কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের।

১৯১৫-র ২৮ অক্টোবরের একটা চিঠিতে মা-কে রুমাল পাঠাতে বারণ করেছেন কল্যাণ। কারণ, ‘যুদ্ধের দান’ হিসাবে ভারত থেকে মেয়েরা বাক্স করে অনেক রুমাল পাঠিয়েছেন। লিখেছেন, “কোথায় আইএমএস হয়ে শান্ত ভাবে দেশে থেকে কিছু গবেষণার কাজ করব, তোমাদের একটু শান্তি দেব, তা-না এইখানে পড়ে রয়েছি!” ৩০ অক্টোবরের চিঠিতে যুদ্ধক্ষেত্রে মাইলের পর মাইল ক্লান্তিকর হাঁটার বিবরণ রয়েছে। রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত হাঁটতে হয়। মাঝে বহু বার ১০-১৫ মিনিট করে দাঁড়ানো। দাঁড়ানোমাত্র সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়েন, তার পর আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় ফের হাঁটা। অফিসার বলে তাঁকে একটা ঘোড়া দেওয়া হয়েছিল। এক বার অসীম ক্লান্তিতে চলন্ত ঘোড়ার পিঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

৯ নভেম্বরের চিঠিতে জানিয়েছেন, আহতের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তাঁর পুরনো বন্ধু ডাক্তার পুরী এসেছেন শিবিরে, দেখা করতে। জানিয়েছেন পশ্চিম ভারতীয় এক বেহারার কথা, যিনি খুব ভাল পুরি-হালুয়া-জিলিপি-কচুরি, অমৃতি বানাতে পারেন।

প্রসঙ্গত, ষষ্ঠ পুণে ডিভিশনের কম্যান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল চার্লস টাউনসেন্ড ১৯১৫ সালের ৩ নভেম্বর বাহিনীকে ঘোষণা করেন: আমরা-সাহিল, কুর্না, কুত-আল-আমারা এবং আরও কিছু গ্রামে ব্রিটিশ সেনা যুদ্ধে সফল হয়েছে। এ বার লক্ষ্য বাগদাদ। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, পথে বিশাল তুর্কি বাহিনী ওত পেতে রয়েছে। তুমুল যুদ্ধ আর তুরস্কের হাতে হারের পর ২২ নভেম্বর থেকে ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটতে থাকে। ফেরার পথে কুত-আল-আমারায় ১৪০ দিনের জন্য ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে যাবতীয় খাবার-ওষুধ-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ আটক দেয় অটোমান তুর্কি বাহিনী। মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত টাউনসেন্ড ১৯১৬-র ২৮ এপ্রিল রসদ ও খাদ্যের অভাবে অটোমান তুর্কি সেনাপতি খলিল পাশার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।

কুত-আল-আমারায় ব্রিটিশ বাহিনীর কী রকম দশা হয়েছিল, কী করে সেনারা তিলে-তিলে শেষ হচ্ছিলেন, তার বিবরণও রয়েছে কল্যাণের চিঠিতে। ১৯১৬-র ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে মাকে জানিয়েছেন, পাঁচ মাস পরে চিঠি লিখছেন। মাঝের ক’টা মাস নিজেকে মানসিক ভাবে চিঠি লেখার জন্য চাঙ্গা করতে পারেননি। কোনও রেশন নেই। মাসখানেক ধরে সবাই আধপেটা খাচ্ছেন। ১০-১২ হাজার সৈন্য প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। “না খেতে পেয়ে দুর্বল হয়ে সবাই হাসপাতালে আসছেন, কিন্তু খাবারই তো নেই। ওষুধে আর কী হবে? তা ছাড়া, ওষুধও তো ফুরিয়ে গিয়েছে। আমরা অফিসারেরা সবাই খুব রোগা হয়ে গিয়েছি। রেশনে চার আউন্স আটার রুটি আর ১ পাউন্ড ঘোড়ার মাংস ছাড়াও বাজার থেকে কিছু বাড়তি জিনিস কিনে খেয়েছি। তাও রোগা হয়ে গিয়েছি। ভুঁড়ি কমে গিয়েছে।”

১ মে-র চিঠিতে বলা হয়েছে, বাহিনীর সঙ্গে যত খচ্চর ও ঘোড়া ছিল, তাদের কেটে সেই মাংস খেতে দেওয়া হচ্ছে। জল ঘোলা। সৈন্যরা সব দুর্ভিক্ষপীড়িত। তাঁদের থাকার জায়গায় টাইগ্রিসের জল ঢুকে কাদা হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের একাধিক চিঠিতে কল্যাণ শত্রুদের হাতে বন্দি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তা হলে যুদ্ধক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা গোলাগুলির মধ্যে থাকতে হবে না, যুদ্ধ করতে হবে না। তা ছাড়া, ডাক্তার-বন্দিদের তেমন কড়াকড়ির মধ্যে রাখা হয় না। শুধু চিঠি একটু কম লিখতে পারবেন। মাঝে যুদ্ধ চলাকালীন হাতে গুলি লাগায় বসরা চলে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল। সেই সুযোগ হাতছাড়া করায় আফসোসও করেছেন শেষের দিকের চিঠিতে। বার বার মা-কে লিখেছেন, “আমি ফিরে গিয়ে তোমাকে দেখতে চাই।”

মোক্ষদা দেবীর লেখা অনুযায়ী, ১৯১৬-র অক্টোবরে কল্যাণের লেখা দু’টি পোস্টকার্ড তাঁরা নভেম্বরে হাতে পান। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় রোগগ্রস্ত হয়ে নভেম্বরে কলকাতায় মারা যান বিনোদিনী। মায়ের মৃত্যুসংবাদ কল্যাণের কাছে পৌঁছয় ১৯১৭-র ৩ মার্চ। তার আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের পোস্টকার্ডে বন্দিশিবিরে মড়ক এবং তাতে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন কল্যাণ। সেই সময় তাঁর বন্ধু পুরীরও ‘স্ক্রাব টাইফাস’ হয়। কল্যাণ দু’মাসের চিকিৎসায় তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি। ২১ মে খবরের কাগজে, মহামারিতে তাঁর মৃত্যুর (১৮ মার্চ, ১৯১৭) খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘মিলিটারি ক্রস’ দিয়েছিলেন। আজীবন পেনশন দেওয়া হয় তাঁর স্ত্রীকে।

১৯১৭ সালের ২৫ মে কল্যাণের বন্ধু ডাক্তার পুরীর একটি চিঠি পান কল্যাণের বাড়ির লোক। সেখানে তিনি লিখেছেন, ৩ মার্চ চিঠিতে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর কল্যাণ ভেঙে পড়েন। কাজকর্ম, খাওয়াদাওয়া, কথা বলা বন্ধ করে দেন। সপ্তাহখানেকের মাথায় তাঁর জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকা শুরু হয়। বাংলায় শুধু ‘মা-মা-মাগো’ বলে যেতেন আর বিলাপ করতেন। ১৮ মার্চ সকালে সেই প্রলাপ বন্ধ হয়, সেই রাতেই নিবে যায় জীবনপ্রদীপ।

‘আভি লে বাগদাদ’

সবেমাত্র বিএ পাশ করে তখন চাকরি খুঁজছেন কলকাতার শিশির সর্বাধিকারী। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। লিখেছেন, প্রথমে একে মোটেই কেউ গুরুত্ব দেননি। এটা যে পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম মহাযুদ্ধ হতে চলেছে, তাও বোঝেননি। কিন্তু জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড যুদ্ধ ঘোষণা করার পর পরিস্থিতি রাতারাতি ঘুরে গেল। ভারত থেকে ফ্রান্সে সেনা পাঠানো হল। তখন ভারতীয়রা সচেতন হলেন। শহরের বিশিষ্টরা ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কোর’ গড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসাকর্মী পাঠিয়ে ইংরেজ শাসকদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই দলেই নাম লেখালেন একুশ বছরের শিশির।

১৯১৪ সালের ২৬ জুন স্বেচ্ছাসেবকেরা হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে ২৮ জুন মুম্বই পৌঁছন। ২ জুলাই ‘মাদ্রাজ’ নামে একটি জাহাজে তাঁরা বসরার উদ্দেশে রওনা হন। ৯ জুলাই বসরা পৌঁছে তাঁদের প্রথম আমারায় পাঠানো হয়, সেখান থেকে আজিজিয়া। জেনারেল চার্লস টাউনসেন্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে বাগদাদের পথে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন অ্যাম্বুল্যান্স কোর-এর সদস্যরাও। কিন্তু পথে ২২ নভেম্বর টেসিফনের যুদ্ধে তুরস্কের কাছে হেরে ব্রিটিশ বাহিনীকে পিছু হঠতে হয়।

শুরু হয় ব্রিটিশ বাহিনীর ‘রিয়ারগার্ড অ্যাকশন।’ অর্থাৎ শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে পশ্চাদপসরণ। এ ক্ষেত্রে সেনারা আগে পিছু হটবে। পিছনে পড়ে থাকবে আহতেরা ও তাঁদের স্ট্রেচার বহনকারী স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসাকর্মীরা। এই পিছনে চলার সময় এক বারও থামা যাবে না। শিশিরের ঠিক পাশেই হাঁটছিলেন ৬৬ পঞ্জাব রাইফেলস-এর এক মুসলমান সেপাই। তাঁর পায়ে সম্ভবত ফোস্কা পড়েছিল। তাই বুটজোড়া খুলে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাইফেল হাতে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। আচমকা ক্ষোভ ও ক্লান্তিতে তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল, “আভি লে বাগদাদ!” অর্থাৎ, খুব তো ব্রিটিশরা বাগদাদ দখল করবে ভেবেছিল, এ বার ঠেলা সামলাও। বাক্যটি মনে গেঁথে গিয়েছিল শিশিরের। বহু বছর বাদে তাঁর ডায়েরির ভিত্তিতে প্রকাশিত যুদ্ধের স্মৃতিকথার নাম দেন, ‘আভি লে বাগদাদ’।

ডায়েরিটি যুদ্ধ ও বন্দিদশায় শিশিরের সঙ্গে ছিল। বুটের মধ্যে তা লুকিয়ে রেখে অনেক অভিযানে গিয়েছেন। জেলেও সঙ্গে রেখেছিলেন। কুতে আত্মসমর্পণের পর তিনি ডায়েরির পাতাগুলি ছিঁড়ে বুটে ভরেন। পরে সেই টুকরোগুলি দিয়ে বাগদাদে নতুন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। হেঁটে নদী পেরোনোর সময় সেই ডায়েরিটিও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কপি পেনসিলে লেখা হয়েছিল বলে লেখা পুরোটা নষ্ট হয়নি। রাস-অল-আইনে ডায়েরিটি কিছুক্ষণের জন্য মাটিতে পুঁততে হয়েছিল। পরে আবার খুঁড়ে বার করে লেখা চালিয়ে গিয়েছেন।

টেসিফনের যুদ্ধ

প্রায় ২০ হাজার ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনা গোলা-বন্দুক-কামান-সহ পায়ে হেঁটে টেসিফন পৌঁছয়। প্রবল ঠান্ডায় ১৯১৫-র ২২ নভেম্বর শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মরফি তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শিশির তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, মাথার উপর আর চার দিকে শিলাবৃষ্টির মতো শেল, গোলাগুলি চলছে। গোলাগুলো মাটিতে পড়ে ফেটে যাচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে নিজেদের বাঁচাতে তাঁদের মাটিতে শুয়ে পড়তে হচ্ছে, হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে। যুদ্ধে প্রথম যাঁর ক্ষতে শিশির ব্যান্ডেজ বাঁধেন, তিনি ছিলেন ১১০ মরাঠা লাইন ইনফ্যান্ট্রি-র হাবিলদার গুল মহম্মদ। বসরা থেকে একই স্টিমারে তাঁরা এসেছিলেন।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলেও যুদ্ধ থামল না। চার দিকে মৃতের স্তূপ। হাঁটার সময় তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন যাতে কারও দেহের উপর পা না পড়ে, কিন্তু সব সময় তা সম্ভব হচ্ছিল না। আহতদের মধ্যে যাঁদের চোট তুলনায় কম, তাঁদের কোনও মতে উঠিয়ে ড্রেসিং স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আর যাঁদের গুরুতর আঘাতে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তাঁরা মৃত্যু অনিবার্য বুঝতে পেরে শুয়ে-শুয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিল। ২৩ নভেম্বর সকালে ঘুম ভেঙে উঠে বাইরে এসে শিশির দেখেন, চার দিকে শুধু মানুষ আর মালবাহী খচ্চরের মৃতদেহ। এক জনের উপর আর এক জন, সব দলা পাকানো। কাঁটাতারের লাইন বরাবর প্রচুর দেহ পড়ে। অনেক দেহ কাঁটাতারের উপর ঝুলছে। আবার তারে ঝুলন্ত অবস্থায় জীবন্ত কয়েক জনও ছিলেন! এক জন শিখ সেনাকে হাসিমুখে বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে দেখেছিলেন, তিনি আসলে মৃত!

যত রাত বাড়ছিল, ঠান্ডাও বাড়ছিল। কমছিল খাবার ও জলের সঞ্চয়। এরই মধ্যে আহতদের যেখানে রাখা হয়েছে, সেখানেও তুর্কিরা গুলি চালাল। অনেক আহত মারা গেলেন। আহতদের একটা গাড়িতে তুলে সরানোর কনভয়ে রেড ক্রসের বড় পতাকা ছিল না বলে তুর্কিরা তার উপরেও গুলিগোলা চালাল। তাতেও মারা পড়লেন বহু। ১২ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র এক বার তাঁদের দুটো করে রুটি আর এক বোতল জল দেওয়া হয়। খিদে-তেষ্টা সহ্য করতে না পেরে সহকর্মী অমূল্যর সঙ্গে খাবার খুঁজতে বেরোলেন। এক মৃত ব্রিটিশ সেনার ব্যাগ হাতড়ে এক টুকরো রুটি পেলেন। সেটা দু’জনে ভাগ করে নেওয়ার সময় কেমন অন্য রকম স্বাদ পেলেন। পরে বুঝলেন, রুটিতে সৈনিকের টাটকা রক্ত লেগে রয়েছে।

কুত-আল-আমারায় দীর্ঘ খাদ্যাভাবে ভারতীয় সৈন্যদের চেহারা।

কুত-আল-আমারায় দীর্ঘ খাদ্যাভাবে ভারতীয় সৈন্যদের চেহারা।

পিছু হটার গল্প

টেসিফনে হারের পর শুরু হল ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর পিছু হটা। পিছনে যেতে-যেতে এক দিকে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে চালানো, অন্য দিকে আহতদের শুশ্রূষা। আহতদের অনেককে প্যাডেল স্টিমারে তুলে সরানো হচ্ছিল। শিশিরেরা স্ট্রেচারে করে আহতদের স্টিমারে তুলেছিলেন। এ রকমই এক স্টিমারের ওয়ারেন্ট অফিসারের মুখে বাংলা শুনে চমকে গেলেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের মুসলমান। বাংলা থেকে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি পেট ভরে ডাল-ভাত খাইয়েছিলেন। কুতে পৌঁছনোর পথে অনেক সেনা তাল মিলিয়ে হাঁটতে না পেরে তাঁদের রেজিমেন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে আরব দস্যুদের হাতে খুন হন। শিশিররা একটি ভেড়া কিনেছিলেন। সে কিছু দিনের মধ্যেই বেশ পোষ মেনে গিয়েছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘টেসি’। সেও শিশিরদের সঙ্গে হেঁটে কুত পর্যন্ত এসেছিল। কুতে তাঁরা যখন তাঁরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন খিদের জ্বালায় অনেকেই টেসিকে কেটে খেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শিশিররা তা হতে দেননি। একেবারে শেষের দিকে তাকে অফিসারদের মেসে দিয়ে দেওয়া হয়।

৭ ডিসেম্বর, ১৯১৫ থেকে কুত-আল-আমারায় ব্রিটিশ-ভারতীয় সৈন্যরা অবরুদ্ধ হন। তাঁদের সমস্ত ‘সাপ্লাই লাইন’ বন্ধ করে দেন তুর্কিরা। সঙ্গে শুরু ২৪ ঘণ্টা গোলাগুলি। বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কোর-এর সদস্যদের সঙ্গে শিশিরকে একটা খেজুর বাগানের মধ্যে তাঁবুতে রাখা হয়েছিল। একটা গোলা এক বার গিয়ে পড়ল তাঁবুর ভিতর শুয়ে থাকা এক সৈনিকের বিছানায়। তিনি মুহূর্তে মারা গেলেন। রাজপুত রাইফেলস-এর এক সেনা শিশিরের পাশে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় মেশিনগানের আটটি গুলি তাঁর কাঁধে এসে লাগে।

১৯১৬-র জানুয়ারিতে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চার দিক কাদা আর জলে ভরে গেল। বাড়তে লাগল রোগ। ব্রিটিশ ত্রাণের অপেক্ষায় দিনের পর দিন কেটে গেল। কেউ এল না। জামাকাপড়ের অভাবে সেনা বা চিকিৎসাকর্মীদের কেউ পোশাক পরিবর্তন করতে পারেননি দীর্ঘদিন। প্রত্যেকের দেহ উকুনে ভরে গেছে। অনেকে স্কার্ভি রোগে ভুগছেন।

২৮ জানুয়ারি ডায়েরিতে শিশির লিখেছেন, “আজ থেকে ঘোড়ার মাংস খেতে দিচ্ছে। ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান সেনাদের অনেকেই তা খেতে চাইছেন না, তবে আমরা খেয়েছিলাম। খুব শক্ত। রেশনে আটা কমিয়ে দিয়েছে। ১১ এপ্রিল ৫০০ জন সেনা আর খিদে সহ্য করতে না পেরে ঘোড়ার মাংস খেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা তার পরেও খেতে চাননি তাঁদের উদ্দেশ্যে টাউনসেন্ড ফরমান জারি করেছেন। মাংস না খেলে পদচ্যুত করা হবে। ভয়ে ১৪ এপ্রিল থেকে বেশিরভাগই ঘোড়ার মাংস খেতে শুরু করেন।” তাও অপুষ্টি, অনাহার, ব্রঙ্কাইটিজ়, ডায়রিয়ায় ভারতীয়রাই মরছিলেন বেশি। ১৯ রেজিমেন্টের এক সেনা পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে গুলি করে মারা হয়।

১ মার্চ বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু হল। হাসপাতালের ডিউটি থেকে ফিরে শিশির তাঁদের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ শিসের মতো আওয়াজ শুনে দেখেন, একটি বিমান অনেক নীচে নেমে বোমা ফেলেছে। শিশির নিশ্চিত যে, এ বার সব শেষ। কিন্তু কলসির মতো দেখতে বোমাটা তাঁর সামনে পড়েও ফাটল না! পাশে গোর্খা সেনাদের একটা তাঁবুর সামনে এক গোর্খা সিগারেট খাচ্ছিলেন। একটা বোমা গিয়ে তাঁর সামনে পড়ে ফাটল। ধোঁয়া সরে যেতে সবাই দেখলেন, সেই জায়গায় শুধু মাংস আর রক্তের কাদা!

মার্চে ঘোড়ার মাংসে সামান্য তেল মাখিয়ে পুড়িয়ে, সেই সঙ্গে ময়দা জলে গুলে খাওয়া শুরু হয়েছিল। সেই ভয়াবহ সময়ে নো ম্যান’স ল্যান্ডে গুলির ঝড়ের মধ্যে অকুতভয় রণদা (বাঙালি সহকর্মী) গিয়ে ঘাস, পাতা ভেষজ তুলে নিয়ে আসতেন। সেগুলো ফুটিয়ে খাওয়া হত স্কার্ভি প্রতিরোধের জন্য। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকার তাগিদে শিশিররা ১৮ জন রাতে ঢোল বাজিয়ে গান গাইতেন, মজা করতেন। কুতে আটকে থাকার সময় আরও অনেকে মানসিক অবসাদ, শারীরিক যন্ত্রণা, খিদে আর বাড়ির চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন।

আত্মসমর্পণ ও তার পর

১৯১৬ সালের ২৯ এপ্রিল কুত-আল-আমারায় ব্রিটিশ বাহিনী তুর্কিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। শিশির সে দিনের ডায়েরির পাতায় লিখেছেন, তুর্কিরা তাঁদের কোনও কারণে মুক্তি দিতে চায় না। তাঁদের বাহিনীর সব অস্ত্র ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪০টি কামান ছিল। হাজার-হাজার রাইফেল ভেঙে পুড়িয়ে ফেলা হয়। গোলা-বারুদ-গুলি টাইগ্রিসের জলে ফেলে দেওয়া হয়। ৮ মে তাঁদের নদীর তীরে ডেকে তল্লাশি চালালেন তুর্কিরা। কী ভাগ্যিস, শিশিরের বুট খুলে দেখা হয়নি। কারণ, তার মধ্যেই লুকোনো ছিল তাঁর ডায়েরি। তুর্কিরা জানালেন, শিশিরদের ভারতে ফেরত পাঠানো হবে না। তাঁদের তুরস্কের জেলে ভরা হবে। ১২ মে ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনাদের নিয়ে স্টিমার রওনা দেয় বাগদাদের উদ্দেশে। শিশিরের ডায়েরি অনুযায়ী, পথে ব্রিটিশ সেনারা ভারতীয়দের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেন। তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে হারার জন্য তাঁরা ভারতীয়দের দায়ী করতে থাকেন। ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে ভারতীয় সেনার তফাত করা হত। স্টিমারে নীচের তলায় সুন্দর জায়গা দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশদের। আর ভারতীয়দের আনা হয়েছিল উপরের তলায়, খোলা আকাশের নীচে, গাদাগাদি করে— পশুর মতো।

বন্দি দশা ও ফেরা

রাস-আল-আইনের একটি তাঁবুর হাসপাতালে শিশিরকে প্রথমে অস্থায়ী কাজে রাখা হয়। সেখান থেকে ২০ নভেম্বর ট্রেনে পাঠানো হয় জার্মানদের তত্ত্বাবধানে থাকা আলেপ্পোর সেন্ট্রাল হাসপাতালে। প্রায় এক বছর সেখানে থাকার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নিসিবিনে জার্মান শিবিরে। এর মাঝে বেঙ্গল অ্যাম্বুল্যান্স কোর-এর সদস্যেরা সব একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। মসুলের যুদ্ধবন্দি শিবিরের দেওয়ালে শিশির তাঁর এক হারিয়ে যাওয়া সহকর্মী শচীন বসুর হাতে লেখা নাম দেখে চিনতে পারেন। পরে জানতে পারেন, তাঁর দুই বন্ধু অমূল্য চট্টোপাধ্যায় ও সুশীল লাহা দীর্ঘ পদযাত্রার দখল সইতে না পেরে মারা গিয়েছেন। রাস-আল-আইনে সহকর্মী, ষোলো বছরের ভোলার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। কিশোর ভোলা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, “দাদা, তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে আমি আর বাঁচব না।” এই পর্বে তাঁর সহকর্মীদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে প্রিয় রায়, ম্যাথু জ্যাকব, শৈলেন বসু এবং শিশিরের অতি প্রিয় কম্যান্ডিং অফিসার অমরেন্দ্র চম্পতি ছিলেন। এঁদের অনেকেই মৃত্যুর আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। শিশির নিজেও প্রায় প্রত্যেক দিন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে উঠে বসতেন। শেষে ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে একরাশ স্মৃতি আর অমূল্য ডায়েরি হাতে তিনি দেশে ফেরেন।

তথ্য সহায়তা

১। ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফাস্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার।

২। ‘কল্যাণ-প্রদীপ’— কল্যাণকুমার মুখোপাধ্যায়

৩। ‘দ্য হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ইরাক, ১৯১৫-১৭’—অমিতাভ ঘোষ

৪। ‘ইন্ডিয়া, এম্পায়ার, অ্যান্ড ফাস্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার কালচার’— শান্তনু দাস

৫। ‘আভি লে বাগদাদ’— শিশির সর্বাধিকারী

৬। ‘অন টু বাগদাদ’— অমিতাভ ঘোষ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

doctor World War I

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy