Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
তিনি সম্প্রীতি দেবী। একদা বিখ্যাত শিল্পী। পাশাপাশি অনামী চিত্রশিল্পীদের তুলে আনতে বের করেছিলেন কাগজ। মণীশ ঘটক ঋত্বিক ঘটককে মনে রাখলেও, বাঙালি ভুলে গিয়েছে তাঁকে। মেয়েদের ভবিতব্য?
Bengali Story

ঋত্বিক ঘটকের বোন যেন মেঘে ঢাকা প্রতিভা

সুরেশচন্দ্র  ঘটক ও ইন্দুবালা দেবীর মেয়ে সম্প্রীতির জন্ম সিলেটে, ১৯১১ সালের ২০ মে। প্রগতিশীল ঘটক পরিবারে শিল্প-সাহিত্যের আবহেই তাঁর বেড়ে ওঠা।

বহুমুখী: সম্প্রীতি দেবী। ডান দিকে তাঁর আঁকা মা ও শিশুর চিত্র। ছবি সৌজন্য: চান্দ্রেয়ী নিয়োগী, রীণা চক্রবর্তী

বহুমুখী: সম্প্রীতি দেবী। ডান দিকে তাঁর আঁকা মা ও শিশুর চিত্র। ছবি সৌজন্য: চান্দ্রেয়ী নিয়োগী, রীণা চক্রবর্তী

পৃথা কুণ্ডু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:২৯
Share: Save:

সেই তারিখটি ছিল ১৯৬২ সালের ২ ডিসেম্বর। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ এক মহিলা চিত্রকরের ছবির প্রদর্শনীর উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক ও সি গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা তথা ভারতের বিশিষ্ট মহিলা শিল্পীদের বারো জনের কথা বলেছিলেন। প্রথম জন অবশ্যই সুনয়নী দেবী— যাঁর প্রতিভা দীর্ঘ দিন ঢাকা পড়ে ছিল তাঁর বিখ্যাত দুই দাদা— অবনীন্দ্রনাথ আর গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আড়ালে। আর সে দিন যে শিল্পীর প্রদর্শনী উপলক্ষে গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় গিয়েছিলেন, এক দিক থেকে সুনয়নী দেবীর সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল। তাঁরও দুই ভাই স্বনামধন্য— ঋত্বিক ও মণীশ ঘটক। তা ছাড়া সংসার সামলাতে গিয়ে নাম-যশের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার সিদ্ধান্ত সম্প্রীতি দেবীর নিজেরই। অথচ দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর এই প্রিয় ছাত্রীর আঁকা ‘রাত্রি ও ধরিত্রী’ অনেক আগেই— ১৯৩৩ সালে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ জুরি-নির্বাচিত বিশেষ বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল— নন্দলাল বসু, অতুল বসু সহ আরও নামী শিল্পীদের কাজের পাশাপাশি।

সুরেশচন্দ্র ঘটক ও ইন্দুবালা দেবীর মেয়ে সম্প্রীতির জন্ম সিলেটে, ১৯১১ সালের ২০ মে। প্রগতিশীল ঘটক পরিবারে শিল্প-সাহিত্যের আবহেই তাঁর বেড়ে ওঠা। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ও ভাস্কর তাঁকে নির্বাচন করেছিলেন ছাত্রী হিসেবে, বলেছিলেন, “আমি নিজেই যখন কোনও শিক্ষার্থীকে বেছে নিই, তার কাছ থেকে কোনও সাম্মানিক নিই না।” ১৯২৯ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে বিবাহসূত্রে তাঁকে চলে আসতে হয় মধ্যপ্রদেশের বৈকুণ্ঠপুরে। সংসারের কাজে জড়িয়ে পড়লেও নিজের মতো করে তাঁর শিল্পচর্চায় ছেদ পড়েনি, বাড়ির দেওয়ালেই তৈরি করেছিলেন হরিণশিশুর সঙ্গে শকুন্তলা ও তাঁর দুই সখী, হরপার্বতীর যুগলমূর্তি ইত্যাদি ফ্রেস্কো। ক্ষিতীশচন্দ্র স্ত্রীর শিল্পচর্চায় উৎসাহ দিতেন। ‘পূজারী’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন সম্প্রীতি দেবী— এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি কবিতায় সুর দিয়েছিলেন হিমাংশু দত্ত।

কলাবিদ্যা-চর্চার বৃহত্তর পরিসরে সম্প্রীতি দেবীর নাম উঠে আসে ১৯৬২ সালে কলকাতায় ‘ইন্দো কন্টিনেন্টাল আর্টিস্টস সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই শিল্পী-সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক স্তরে শিল্পের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ও শান্তির বাতাবরণ গড়ে তুলতে সহায়ক হওয়া। স্থানীয়, স্বল্পপরিচিত শিল্পীদের প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে তাঁদের এগিয়ে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠন কাজ করত। ‘ইন্দো কন্টিনেন্টাল আর্টিস্টস সোসাইটি’-র মুখপত্র হিসেবে ‘আর্টিস্ট’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে— যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন সম্প্রীতি দেবী ও লোকেশ ঘটক— তাঁর আর এক ভাই। শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন রামকিঙ্কর বেজ, নন্দলাল বসু প্রমুখ। ঋত্বিক ঘটকও যুক্ত ছিলেন এই পত্রিকার সঙ্গে। পরে এর নাম হয় ‘আর্টিস্ট’স ওন’। ও সি গঙ্গোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অনিলকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রদ্যোৎ ঘোষ, মীরা মুখোপাধ্যায়ও লিখতেন এ পত্রিকায়। বিদেশি লেখকদের মধ্যে জেমস এল কোনেন বা নরম্যান স্মিথ-এর লেখা এই পত্রিকায় আন্তর্জাতিক মাত্রা যোগ করেছিল। শিল্পের জগতে অপেক্ষাকৃত অল্প-পরিচিত যে শিল্পীদের আর্থিক এবং অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়, তাঁদের কথা তুলে আনতেন এই পত্রিকার সম্পাদকগোষ্ঠী। পটুয়া বসন্ত জানা বা চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মতো স্বশিক্ষিত, বা একদা ‘অল্পখ্যাত’ শিল্পীকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করেছিল ‘আর্টিস্ট’স ওন’।

‘আর্টিস্ট’স ওন’ পত্রিকা দীর্ঘজীবী হয়নি, কিন্তু মাত্র দু’বছরের মধ্যেই শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে যে ধরনের ভাবনার পরিচয় রেখেছিল, তা বাংলার শিল্প আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রীতি দেবী পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সদস্য হয়েছেন, বাংলার ‘জাতীয় কলাকেন্দ্র’-র শিল্পবিভাগের ‘চেয়ারম্যান’-এর দায়িত্ব পালন করেছেন।

দীর্ঘ বিরতির পর যখন ১৯৯২ সালে ইন্দো কন্টিনেন্টাল আর্ট সোসাইটি-র কাজ নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ নেন সম্প্রীতি দেবী, তখন তাঁর বয়স আশির উপর। ১৯৯৩-তে নিউ জার্সিতে সোসাইটির পক্ষ থেকে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে প্রবাসী ভারতীয় শিল্পীদের কাজ স্থান পেয়েছিল। সম্প্রীতি দেবী তখন থাকেন আমেরিকা এবং কানাডায় তাঁর তিন কন্যার কাছে; মেয়েদের উৎসাহে তিনি ‘আর্টিস্ট’স গিল্ড অব টমস রিভার’-এর সভ্য হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন। নিউ জার্সির প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর ‘ভগবান সিতারি অ্যাট দ্য এজ অব নাইনটি সিক্স’— এক বৃদ্ধ সেতারশিল্পীর প্যাস্টেল-প্রতিকৃতি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দের সাদা-কালো প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তিনি (‘দ্য পোয়েট’, ‘দ্য মঙ্ক’), আবার প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলার আঙ্গিকে এঁকেছিলেন ‘উমা পেন্টিং দ্য পোর্ট্রেট অব মহাদেব’। কানাডায় থাকাকালীন তৈরি করেছিলেন দুর্গামূর্তি, সরস্বতীমূর্তি— সেগুলি আজও সযত্নে রক্ষিত সেখানকার প্রবাসী বাঙালি-পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কানাডার মল্টন আর্ট ফেস্টিভ্যাল-এও তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রবাসজীবনে এমিলি কার এবং ‘গ্রুপ অব সেভেন’-এর শিল্পকলার গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন তিনি; এমিলি কার-এর জীবনী বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন। এ ছাড়াও অনেকের অনুরোধে বিভিন্ন বই বা কত পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন, নিজের আঁকা উপহার হিসেবে দিয়েছেন, তার হিসেব রাখা যায়নি।

সম্প্রীতি দেবীর বহুমুখী সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখায়, সম্পাদনার কাজে, অনুবাদ-কর্মে, ছবিতে। ব্যক্তিগত ভাবে শিল্পী হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা বা ইচ্ছেও তাঁর ছিল না, কিন্তু ইন্দো কন্টিনেন্টাল আর্টিস্টস’ সোসাইটি তথা ‘আর্টিস্ট’স ওন’ পত্রিকার অন্যতম সংগঠক-সম্পাদক হিসেবে তাঁর কাজ যেন স্বীকৃতি পায়— এটুকু চাওয়া তাঁর ছিল জীবনের প্রান্তবেলাতেও।

২০০৬-এর জুলাই মাসে সম্প্রীতি দেবী প্রয়াত হন। তাঁর জীবন ও কাজের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন-সহ ‘আর্টিস্ট’স ওন’ পত্রিকা থেকে নির্বাচিত কিছু প্রবন্ধের একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেন চান্দ্রেয়ী নিয়োগী, ২০০৭-এ। ২০১০-১১ সালে তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে পরিবারের উত্তরপ্রজন্মের সদস্যদের উদ্যোগে ‘সম্প্রীতি স্মরণিকা’ নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলার শিল্পচর্চা ও শিল্প আন্দোলনের সামগ্রিক ধারায় আত্মপ্রচারবিমুখ এই শিল্পী আজও রয়ে গেছেন বিস্মৃত এক টুকরো ইতিহাসের অংশভাগী হয়েই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Ritwik Ghatak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE